ক্রীড়ারত: চাঁদের পাহাড়ের সামনে
জুলাইয়ের ভরদুপুরে স্যান্ড নদীর ধারে হাজির আমরা। চোখের সামনে হাজার হাজার উইল্ডিবিস্ট। হঠাৎ ওরা উল্টো দিকে দৌড় দিল। ছবি তুলব বলে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পরে বিফল মনোরথে ফেরার পথে পা বাড়ালাম। আর তখনই আমাদের অবাক করে দিয়ে তানজ়ানিয়ার সেরেঙ্গিটির জঙ্গল থেকে পালে পালে উইল্ডিবিস্ট কেনিয়ার মাসাই মারার জঙ্গলে প্রবেশ করতে লাগল নদী পেরিয়ে। এত দিন এ রকম দৃশ্য পর্দায় দেখেছি। এমন অনেক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাক্ষী হয়েছি দশ দিনের কেনিয়া সফরে।
দু’দিন আগে এসে পৌঁছেছি নাইরোবির জোমো কেনিয়াট্টা বিমানবন্দরে। নাইরোবির আবহাওয়া আমাদের গ্রীষ্মকালীন পাহাড়ি শহরের মতো। ভোরের আলো ফুটতেই পৌঁছলাম জিরাফ রেসকিউ সেন্টারে। সকালের দিকে পর্যটকরা হাতে করে খাবার খাওয়াতে পারেন জিরাফদের। পরের গন্তব্য এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ, মাতৃহারা হস্তিশাবকদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরলাম নাইরোবি শহরে। ক্যামেরা তুলে নিলাম হাতে। গাইড সতর্ক করলেন, জানালার ধারে ক্যামেরা রাখলে ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। প্রমাদ গনলাম। ক্যামেরা গুটিয়ে ব্যাগে রেখে শহরের বিপণিগুলি ঘুরে দেখলাম। সংগ্রহ করলাম মাসাইদের হাতে তৈরি চাদর, স্মারক, কাঠের তৈরি গন্ডার, হরিণ, সিংহ, চিতা।
পরের দিন গন্তব্য মাসাই মারা। পথে পড়ল দ্য গ্রেট রিফ্ট ভ্যালি। দিগন্তবিস্তৃত উপত্যকা ছাড়িয়ে নারকে পৌঁছলাম। সেখানে গাড়ি বদল, হুডখোলা জিপ নিয়ে হাজির গাইড। পশুপাখির গতিবিধি তাঁর নখদর্পণে। বর্ষায় অভয়ারণ্য জুড়ে কেবল ছোট-ছোট ঘাস। এখানেই মাসাই মারার আকর্ষণ। ঘাসের আড়ালে পশুরা লুকিয়ে থাকলেও দর্শন পাওয়া কঠিন নয়। জ়েব্রা, ইম্পালা, হরিণের দল, বুনো মহিষ, গন্ডারের দল ক্যামেরায় ধরা দিল সে দিন।
পরের দিন গাইড খবর দিলেন, এক জায়গায় সিংহীর পরিবারকে দেখা গিয়েছে। তড়িঘড়ি সেখানে গিয়ে দেখি আটটি সিংহী প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। আরও এগোতে চোখে পড়ল জিরাফ দম্পতি। কিন্তু গাড়ির জটলায় আটকে গেলাম। কয়েকটি চিতাও চোখে পড়ল। এত গাড়ির মাঝে ছবি তুলব কী ভাবে? বুদ্ধি দিলেন গাইড। সব গাড়ি যে দিকে ছুটল, তার ঠিক উল্টোদিকে গাড়ি ছোটালেন তিনি। রাস্তায় জল, কাদা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চমক। চিতাগুলো আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক।
হিংস্র: শিকারের অপেক্ষায়
চলার পথে এক গাছের উপরে আধখাওয়া হরিণের দুটো পা ঝোলার দৃশ্যে ক্ষণিক থমকে গেলাম। একদল শকুন পশুর মৃতদেহে ভোজন সারছে। জান্তব আবহে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এ দিকে দিনের আলো পড়ে আসছে। গাইড ইশারায় বোঝালেন, কোনও খবর এসেছে। অদূরে ঘাসের মধ্যে একটি সিংহী লুকিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি দূরের জঙ্গলে, নিজেকে প্রস্তুত করেই একটি হরিণশাবকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছবি তোলার আনন্দের সঙ্গে বিষাদও গ্রাস করল সমগ্র মন। কিন্তু তা ভুলিয়ে দিল মাসাইদের গ্রাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে লাঠি ঘষে আগুন জ্বালিয়ে আজও তাঁদের দিনযাপন। তাঁদের আন্তরিকতার ওম মন ভাল করে দেয়।
মাসাই মারা পর্ব শেষে নাইভাসার লেকের দিকে পাড়ি দিলাম। লেকের অন্যতম আকর্ষণ ক্রিসেন্ট আইল্যান্ড। এক দিকে লেক, তার মধ্যে বড় মাঠের মতো দ্বীপ। লেকের জলে ফিশ ঈগল, লেসার ফ্লেমিংগো, পেলিকান ও হরেক কিসিমের পাখি। নাইভাসা লেকের ধারে এলসামেয়ার লজে থাকা ছিল বাড়তি পাওনা। ১৯৬৬তে ‘বর্ন ফ্রি’ ছবির শুটিং হয়েছিল এই লজেই। সিংহী এলসা ও তার পালক পিতা জর্জ অ্যাডামসনের স্মৃতি সযত্ন রক্ষিত।
সাফারির শেষে গেলাম ক্রেটার ওয়াকে। একটি মৃত আগ্নেয়গিরির উপরে লেক আর জঙ্গল। ফেরার পথে অস্তমিত সূর্যের লালচে আভায় চোখে পড়ল সঙ্গমরত দুই উটপাখি।
আসল রোমাঞ্চ ছিল সফরশেষে, অ্যামবোসেলির ন্যাশনাল পার্কে। কুয়াশার চাদর সরিয়ে ভেসে উঠল চাঁদের পাহাড়। সামনে হাতির দল। ক্লান্ত শরীরে নাইরোবির এক রেস্তরাঁয় গেলাম ডিনার সারতে। গিয়ে জানলাম সেখানে ২০৬ রকমের মাংস পাওয়া যায়। এমন সুস্বাদু কুমিরের মাংসের স্বাদ ভুলব না ইহজীবনে। সঙ্গে সারস, উটপাখি, জ়েব্রা...
ছবি: পলাশ সাধু