আলেপ্পির জলপথ।নিজস্ব চিত্র
দু’দিকে নারকেল গাছের বন। মাঝেমধ্যে ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাড়ি। সেই সব বাড়ির সামনে বাঁধা আছে ছোট্ট ডিঙি নৌকা। বাজার-হাট হোক বা চায়ের দোকান— যে কোনও জায়গায় যেতে হলে ডিঙি নৌকাই ভরসা।
কেরলের আলেপ্পিকে কেন প্রাচ্যের ভেনিস বলা হয় তা আলেপ্পির ব্যাক ওয়াটারে শিকারা বা হাউসবোটে ভাসতে ভাসতে অনুভব করা যায়। আলেপ্পি এমন একটি সমুদ্র শহর, যার রয়েছে বিশাল ব্যাকওয়াটার আবার সমুদ্রতটও।
থেক্কাডি থেকে সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে আলেপ্পির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ুন। আলেপ্পি দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গেলে হোটেলে বা হাউসবোটে উঠে শিকারা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন ব্যাকওয়াটার ভ্রমণে। আলেপ্পির ব্যাকওয়াটারে দু’ভাবে ঘোরা যায়— শিকারা অথবা হাউসবোটে। হাউসবোটে ঘোরার খরচ শিকারার দ্বিগুন। তবে শিকারাগুলিও অনেক বড়। দশ থেকে বারো জনের একটি দলের একটা শিকারাতেই হয়ে যাবে। ন্যূনতম তিন ঘণ্টার জন্য শিকারা ভাড়া পাওয়া যায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে। দরদাম করতে পারলে ২০০০ টাকাতেও মেলে।
এ রকম এক শিকারায় জলপথে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম ব্যাকওয়াটারের ধারে একটি বাড়িতে এক গৃহবধু নিজে নৌকা চালিয়ে বাজার করতে যাচ্ছেন। তিনি জানালেন, তাঁর দশ বছরের ছেলেও দারুণ নৌকা বাইতে পারে। বাচ্চাদের সাইকেল শেখানোর আগে এখানে নৌকা চালানো শেখানো হয়। নৌকা না চালাতে জানলে সত্যিই দৈনন্দিন কাজ করা খুবই কঠিন।
ব্যাকওয়াটার কোথাও বিশাল চওড়া আবার কোথাও আবার সরু খালের মতো। মাঝেমধ্যে মনে হবে এ যেন গলির রাস্তা দিয়ে যাওয়া। শুধু পিচের রাস্তার বদলে রয়েছে জলপথ। এ রকমই ব্যাকওয়াটারে ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে আপনার শিকারা নোঙর ফেলবে কোনও ছোট্ট রেস্তোরাঁর সামনে। ওই রেস্তোরাঁয় আপনি দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে পারবেন। আর তা না চাইলে কেরলের বিশেষ মাছ ভাজা তো আছেই। ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় ওই ধরনের ভাজা মাছ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পাবেন না। মাছভাজা খেয়ে ফের শিকারায় উঠে ঘুরে বেড়ান। আপনি যে দিকে শিকারা নিয়ে যেতে বলবেন শিকারা সে দিকেই যাবে। যেতে যেতে দেখবেন, নানা ধরনের হাউসবোট ভাসছে। হাউসবোটে থাকলে সেখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। হাউসবোটের ব্যালকনিতে বসে এই জলপথের দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
কন্যাকুমারী। নিজস্ব চিত্র
তবে ব্যাকওয়াটারে ঘুরতে ঘুরতে কিন্তু আলেপ্পির সমুদ্রতটে যেতে ভুলে যাবেন না। বিকেলে আলেপ্পির সমুদ্রতটে সূর্যাস্ত দেখতে যান। আলেপ্পিতে হোটেল বা হোম স্টে ছাড়াও রয়েছে প্রচুর হাউসবোট। তবে হাউসবোটে ওঠার আগে হাউসবোটের মান কেমন তা ভাল করে পরীক্ষা করে নিন। অপেক্ষাকৃত কম দামের হাউসবোটের পরিকাঠামো নিয়ে নানা অভিযোগও ওঠে।
আলেপ্পিতে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন সোজা চলে যান কোভালাম। সমুদ্রের পাড় দিয়ে ঘণ্টা চারেকের পথে টুক করে দেখে নিন ভারখালা বিচ। এখানে থাকাও যায়। অসাধারণ এই বিচটি কার্যত বিদেশিদের দখলে। এখানে সমুদ্রের জলের রং দেখলে আপনি মোহিত হয়ে যাবেন।
ভারখালা বিচ দেখে সোজা চলে যান কোভালাম। কোভালাম যাওয়ার পথেই পড়বে তিরুঅনন্তপুরম। তিরুঅনন্তপুরম থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরেই কোভালাম। তাই কোভালামে যাওয়ার আগে তিরুঅনন্তপুরম শহর ঘুরে নিতে পারেন। তিরুঅনন্তপুরম গেলে অবশ্যই পদ্মনাভ মন্দির দর্শন করুন। তবে এই মন্দিরে প্যান্ট বা সোলায়ার কামিজ পড়ে ঢোকা যায় না। মন্দিরের সামনেই ধুতি ভাড়া পাওয়া যায়। ছেলেদের প্যান্ট ছেড়ে ধুতি পড়তে হবে। মেয়েদের সালোয়ার কামিজ বা জিনস পড়া থাকলে সালোয়ার বা জিনসের উপরে ধুতি জড়িয়ে নিলেই হবে। ধুতির দাম মাত্র ৬০ টাকা। ধুতি যেখান থেকে কিনবেন সেখানেই মোবাইল ফোন, চটি— সব জমা রাখা যায়। তবে এত কিছু কাণ্ড করে মন্দিরে ঢোকা কিন্তু বিফলে যাবে না। মন্দিরের কারুকার্য আর বিগ্রহ আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই মন্দিরের প্রসাদও বেশ অভিনব।
কোভালামের সমুদ্রতট। নিজস্ব চিত্র
পদ্মনাভ মন্দির দর্শন করে সোজা চলে আসুন কোভালাম। কোভালামের হাওয়া বিচ অথবা লাইটহাউস বিচে থাকুন। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ভ্রমণ ম্যাগাজিনে লাইটহাউস বিচকে আমাদের দেশের সেরা ১০টি বিচের মধ্যে রাখে। সেটা যে কেন তা আরব সাগরের জলের রং দেখলেই বোঝা যাবে। এমন স্বচ্ছ সমুদ্রের জলের ঢেউ বিরল। কোভালাম বিচও প্রায় বিদেশিদের দখলে। কোভালাম বিচে অবশ্যই স্নান করুন। তবে এখানে খাওয়ার খরচ বেশ বেশি। সকালে বা বিকেলে কোনও একটা সময়ে লাইটহাউসের উপরে উঠে যান। লিফট় রয়েছে। লাইটহাউসের উপর থেকে কোভালাম বিচ আর দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
কোভালামে রাত কাটিয়ে সকালে উঠে প্রাতরাশ সেরে গাড়ি নিয়ে চলে যান কোভালাম থেকে মাত্র ৮৫ কিলোমিটার দূরে, কন্যাকুমারীতে। কেরল থেকে তামিলনাড়ু রাজ্যে ঢোকার পরেই রাস্তার দু’ধারে পড়বে নারকেল গাছের বন। আড়াই ঘণ্টা এই দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কখন কন্যাকুমারী পৌঁছে যাবেন টেরই পাবেন না।
দেশের শেষ প্রান্ত কন্যাকুমারীর মূল আকর্ষণ বিবেকানন্দ রক। টিকিট কেটে লঞ্চে উঠে সমুদ্রের হালকা দুলুনি খেতে খেতে পৌঁছে যান বিবেকানন্দের স্মৃতি বিজড়িত এই রকে। বিবেকানন্দ রকে ইচ্ছা করলে ধ্যান কক্ষে বসে ধ্যানও করতে পারেন। ১৮৯৩ সালে এই পাথরখণ্ডের উপরেই ধ্যানে বসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ রকের সামনেই আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর মিশেছে। বিশাল এই তিন সমুদ্রের জলের রং দেখে মুগ্ধ হতে হয়। কন্যাকুমারীতে সূর্যাস্ত অবশ্যই দেখবেন। এখানে থাকাও যায়। কন্যাকুমারীতে এক রাত থাকলে ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখতে ভুলবেন না।
কী ভাবে যাবেন
• বর্ধমান থেকে কলকাতা এসে শালিমার থেকে তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেস বা হাওড়া থেকে গুয়াহাটি-তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেসে চেপে কোচি চলে আসুন। তিরুঅনন্তপুরম থেকেও ঘোরা শুরু করতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
• কোচি থেকে শুরু করে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। আলেপ্পিতে হোটেল বাদেও রয়েছে হাউসবোট। রয়েছে কম দামের হোম-স্টে। যেখানেই থাকুন না কেন, আগে থেকে বুকিং করা ভাল। তা হলে কিছুটা কম দামে ভাল ঘর পাওয়া যায়। কেরল ভ্রমণের জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করুন। মুন্নার, থেক্কাডি বাদে শীতে কেরলে কোথাও ঠান্ডা সে ভাবে মালুম হয় না। কোভালাম, আলেপ্পি, কন্যাকুমারীতে ডিসেম্বরেও রীতিমতো গরম লাগে। তাই নভেম্বর থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি, বড় জোর মার্চ পর্যন্তই কেরল ভ্রমণের সেরা সময়। অনেকে অবশ্য বর্ষায় কেরলের রূপও দেখতে যান।