হাত বাড়ালেই পাহাড়। সিমানাদারায় থাকার ব্যবস্থা একদম খাদের ধারে। —নিজস্ব চিত্র।
হাত বাড়ালেই পাহাড়! যেন তা অস্তিত্বের ভিতর এসে জাহির করছে নিজেকে। ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে। দূরে নয়, একদম কাছেই। আঙুলের স্পর্শের নাগালেই।
পাহাড় মানে একটা-দুটো নয়, অগুনতি। একের পর এক, ঢেউ খেলানো। হয়তো বা ছুঁয়েই ফেলা যাবে। শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে রক্তের ভিতর পাহাড়ের এমন টগবগে উপস্থিতি, আগে টের পাইনি। প্রথম দেখাতেই সিমানাদারা তাই অদ্ভুত শিরশিরানি আনল। এমন রোমাঞ্চ তো আগে হয়নি!
সকালে কাফের থেকে বেরিয়ে প্রথমে গিয়েছিলাম লোলেগাঁওয়ের বিখ্যাত ‘হ্যাঙ্গিং ব্রিজ’ দেখতে। আমার যদিও বার দু’য়েক ঘোরা ছিল আগেই। তবু দুলতে দুলতে দড়ির সেতুতে হাঁটার রোমাঞ্চ চিরনতুন। লোলেগাঁওয়ের জঙ্গলের আঘ্রাণ প্রাণভরে নিয়ে উঠলাম গাড়িতে। লাভার রাস্তা খারাপ বলে ও দিকে গেলাম না। লোলেগাঁও খাসমহল, রেলিখোলা পেরিয়ে উঠে এলাম আলগাড়া, পেডং। আরও কিছুটা দিয়ে বাঁ দিকে ক্রস হিলের রাস্তা। উল্টো দিকের পাহাড়ই সিকিম। পাকইয়ং বিমানবন্দর ও দিকেই। বিমানের আনাগোনা চোখে পড়ল গাড়িতে আসতে আসতে। পাহাড়ে এটা নতুন অভিজ্ঞতা।
একের পর এক পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আর কত বাকি? খানিক ক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিলাম। যথারীতি আশ্বাস আসছিল, এই তো, আর কিছু ক্ষণ। অবশেষে সারথি সঞ্জয় বলে উঠলেন, “এ বার আমরা একেবারে অরিজিনাল হোমস্টে-তে যাচ্ছি। এখানে পুরোটাই প্রকৃতি।” হোমস্টে তো অনেক দেখেছি, থেকেওছি। অরিজিন্যাল হোমস্টে আবার কী? আগ্রহ বাড়ছিল।
বলতে বলতেই রাস্তা থেকে হঠাৎ ডান দিকে মাটি-পাথরের সরু রাস্তায় পড়ল গাড়ি। দু’পাশে বাহারি ফুলের গাছ। সামনে লাল রঙের একটা দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকেও গাছপালার আড়ালে একটা কাঠামো আছে। তবে পাহাড়গুলোই চোখে পড়ছে বেশি। ভয়ও লাগছে, গাড়ি এক বার গড়িয়ে পড়লেই হল আর কি!
আরও পড়ুন: পাহাড়-জঙ্গলের বুকে হারিয়ে যাওয়ার অনুপম ঠিকানা কাফের
ছোট্ট উঠোন মতো একটা জায়গায় থামল গাড়ি। এ বার টের পেলাম যে জায়গাটা পাহাড়ের একেবারে প্রান্তে। খাদের কিনারায়। সিমানাদারার সীমানায় এটাই রাজেশ মোকতান আর বন্দনা সুব্বার পাহাড়ে ঘেরা মোকতান হোমস্টে। হ্যাঁ, একেবারে প্রকৃতির অঙ্গই হয়ে উঠেছে তা। যাকে বলে, একেবারে ‘অরিজিনাল হোমস্টে’!
বাঁ পাশে খান তিনেক ঘর। লাগোয়া রান্নাঘর। যাঁদের হোমস্টে, তাঁদের থাকার জায়গা। একটা পুজোর ঘরও রয়েছে। ডান দিকে দোতলা একটা কাঠামো গড়ে উঠেছে। সেখানে উপর-নীচ মিলিয়ে খান চারেক ঘর।
ওই দূরে অনেক নীচে রংপো নদী।
রাজেশ-বন্দনা অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন এই হোমস্টে। হোটেলের মতো ঝাঁ-চকচকে ব্যবস্থাপনা নাই বা থাকল, সারল্য আর ভালবাসায় মুগ্ধ করবেনই দু’জনে। ভাবাই যায় না, এতটাই আন্তরিক। সর্দি-কাশি দেখে রাজেশ তো পাহাড়ি দাওয়াই পর্যন্ত তৈরি করে দিলেন। বললেন, খেয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পড়ুন। কমে যাবে সর্দি। সোনার চেয়েও দামি এই আতিথেয়তা।
গাড়ি থেকে নেমেই উপলব্ধি করলাম শোঁ শোঁ হাওয়া। পাহাড়ের মাথা বলেই হয়তো হাওয়ার তেজ মারাত্মক। পারলে উড়িয়েই নিয়ে যায়। লাঞ্চ তৈরি ছিল। ব্যাগপত্র রেখে জলদি বসে পড়লাম খাওয়ার ঘরে। গরম-গরম ডাল, শাক, ডিমের ডালনা।
বন্দনাজি বললেন, এখানে সূর্যাস্ত অসাধারণ। সত্যিই অসাধারণ! পশ্চিমের আকাশ ক্রমশ হতে লাগল লাল। রক্ত-রঙা একটা গোলার মতো হয়ে উঠল সূর্য। ডুবতে যাওয়ার মুখে চমক। ভাসমান মেঘে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল সেই গোলা। তার পর মেঘকে ড্রিবল করে টুপ করে পাহাড়ের কোলে ডুবে যাওয়া। রক্তিম একটা আভা থেকে গেল খানিক ক্ষণ। সেটাও ধীরে ধীরে বিলীন। ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার। ছায়া ঘনিয়ে এল পাহাড়ে পাহাড়ে।
শেষ বিকেলে সূর্য ও মেঘের লুকোচুরি।
আর তার পরই ভোজবাজি। অন্ধকার দিগন্তে একটা-দুটো করে জ্বলে উঠতে থাকল আলো। সামনের পাহাড়গুলো ঝকমক করে উঠল। নিকষ কালোর মধ্যে অজস্র তারার ঝকমকানি। আর তা যেন করমর্দনের দূরত্বেই। মুহূর্তে প্রকৃতির ক্যানভাসে জন্ম নিল অপূর্ব এক ছবি। এমন পাহাড় জুড়ে জোনাকি তো সিমলাতেও দেখিনি!
বোঝা গেল, পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অজস্র বাসস্থান। দিনের বেলায় যা উধাও হয়ে থাকে। সন্ধে নামার পর আলোয়-আলোয় ঘটে ম্যাজিক।
উঠোনের প্রান্তে খাদের ধারেই রয়েছে বসার ছাউনি। সেখান থেকে ঝিকমিক আলোগুলো আরও কাছে। কনকনে ঠাণ্ডায় অবশ্য বেশি ক্ষণ থাকা গেল না বাইরে। ঘরের জানলা দিয়েও অবশ্য পাহাড় জুড়ে আলোর ঝলকানি দৃশ্যমান। তা দেখতে দেখতেই রুটি আর গরম দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে ডিনার।
সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক...।
সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। এখানে সূর্যোদয় দেখা যায় না। তবে সামনের পাহাড়ের মাথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় ভালমতোই। ইচ্ছে ছিল, কাঞ্চনে রঙের খেলা দেখব। কিন্তু খাদ থেকে পাক খেয়ে উঠে আসা কুয়াশার আড়ালে মুখ লুকিয়েই থাকল ঘুমন্ত বুদ্ধ। কুয়াশা সরলে ডান দিকে অবশ্য উঁকি মারল নাথুলা পাস, দ্য ব্ল্যাক মাউন্টেন।
বন্দনাজি চেনাতে থাকলেন, ওই যে সরু ফিতের মতো নীচে, ওটা রংপো নদী। ওই যে নদীর ধারে বড় বিল্ডিং, সেটা একটা ওষুধের কোম্পানির ফ্যাক্টরি। উল্টো দিকের পাহাড়ে ওই যে গাড়ি যাচ্ছে, ওটাই রংপো যাওয়ার রাস্তা। আর ওপাশের পাহাড়ের পিছনেই সিলারি গাঁও, ইচে গাঁও।
গরম-গরম রুটি, সব্জি আর বার দু’য়েক চা-পানে ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে হাঁটতে বেরলাম। গড়ানে পথ দিয়ে উঠলেই পিচের রাস্তা। দু’পাশে সাজানো-গোছানো বাড়ি। খেলছে বাচ্চারা। বাড়িগুলোর সামনে খানিকটা বাগান। নানা রঙের ফুল। শান্ত জীবন। আমাদের প্রতি দিনের দৌড়ঝাঁপের জীবন থেকে একেবারে উল্টো। অথচ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম এখানেই তীব্র। প্রতিকূলতা অনেক। আর তা মেনে নিয়েই পাহাড়িয়া জীবন অভিযোগহীন। মুখে এক চিলতে হাসি, সর্ব ক্ষণ।
পাহাড়িয়া ফল শোভা বাড়িয়েছে প্রকৃতির।
হোমস্টে-তে ঢোকার মুখে রাস্তাতে রয়েছে বসার জায়গা। ফিরে এসে সেখানেই খানিক ক্ষণ আড্ডা। রাজেশও যোগ দিলেন। সরকারি কর্মী তিনি। কিন্তু, সকালে ঘণ্টাখানেকের বেশি কাজ থাকে না। বাইক চালিয়ে ফিরে এসে লেগে যান হোমস্টের কাজে। তরিতরকারি ফলানো থেকে শুরু করে পাশেই বন্ধুর জমিতে বাড়ি তৈরির ভিত গড়ায় হাত লাগানো পর্যন্ত, সবসময়েই কিছু না কিছু করে চলেছেন। পাহাড়ের মাথায় জমি কিনে বন্দনাজি আর তিনি গড়ে তুলেছেন এই হোমস্টে। প্রথমে ছিল তিনটি ঘর। পাশেই লাল চালের আরও খান চারেক ঘর তৈরি করছেন। আর ঘর বাড়াবেন না। প্রকৃতি আদি-অকৃত্রিম থাকুক, এটাই চাইছেন। এখানে ফলিয়েছেন নানা ফসল। ফুলকপি, বাঁধাকপি। তা তুলে এনে রাঁধছেন তরকারি। একেবারে টাটকা। আছে চিনির চেয়েও মিষ্টি আখ।
সিমানাদারা থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে কাশ্যেমেও ঘুরে আসতে পারেন। প্রকৃতি একেবারে হাতের নাগালে। উচ্চতা হাজার চারেক ফুট। এখান থেকে সিকিম একেবারে কাছে। সকালে বেরিয়ে ফিরে আসা যায় যে কোনও জায়গা থেকে। সিমানাদারার উচ্চতা অবশ্য কাশ্যেমের চেয়ে কিছুটা বেশি, ৫০০০ ফুটের মতো। তবে বাসিন্দা মাত্র ২৪ ঘর লোক। লোকজন বিশেষ নেই। চুপচাপ, শান্ত। প্রকৃতির একেবারে কোলে। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে বসলাম হোমস্টের উঠোনের প্রান্তে ছাউনিতে।
আরও পড়ুন: আবার আসার নিমন্ত্রণ পাঠাল ঘালেটর
পাশেই শাকসব্জির চাষ হয়েছে। রয়েছে সরষে খেত। ওপাশে আরও খানিকটা গেলে রাজেশের জমির সীমানা। একটা কাঠের তক্তা দিয়ে বেঞ্চ পর্যন্ত করা। সেখানে বসেও দারুণ ভিউ। পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ গিয়েছে। শুনলাম ঢালু সেই পথ দিয়ে নামা যায় একেবারে নদীর ধার পর্যন্ত। দুই মজুরকে দেখলাম বাড়ি করার জন্য সিমেন্টের বস্তা পিঠে নিয়ে ওই পথেই চলে যেতে। ফের টের পেলাম, আপাত হাসির আড়ালে জীবন এখানে কত কঠিন, কত সংগ্রামী।
সিমানাদারা ক্রমশ মায়াবী হয়ে উঠতে থাকল বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে। দূরে বয়ে চলা নদী হতে থাকল ঝাপসা। দিগন্তজোড়া একটার পর একটা পাহাড় ঘিরে ধরতে থাকল মেঘ। অনন্ত শূন্যতাকে রঙিন করে তুলল বিদায়ী সূর্য। রক্তিম আভা আবার মুছতে শুরু করল। নেমে এল অন্ধকার। ফের ম্যাজিকের মতো জ্বলে উঠল এ দিক-ও দিক থেকে বিন্দু বিন্দু আলো। সেই আলোর উৎসবে নিজেকে মনে হল ক্ষণিকের অতিথি। সিমানাদারা থাকবে প্রকৃতির ভরপুর আশীর্বাদ নিয়ে। নীল আকাশ, সূর্যাস্ত, এক পাহাড় জোনাকি নিয়ে।
পথের শেষে খাদের কিনারায় থাকার জায়গা।
যাত্রাপথ: কালিম্পং থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা। পেডং, আলগাড়া হয়ে। রাস্তা ভালই। আবার রংপো থেকেও আসা যায়। ওখান থেকেও ঘণ্টা দেড়েক। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা।
ভাড়া: এনজেপি থেকে বোলেরো গাড়িতে এলে লাগে চার হাজার টাকা। ছোট গাড়িতে লাগে সাড়ে তিন হাজার টাকা। একবার কথা বলে ঠিক করে নেওয়াই ভাল যাওয়ার আগে।
রাত্রিবাস: মোকতান হোমস্টে।
যোগাযোগ: রাজেশ মোকতান ৮১৪৫৮৭৬৯৩৯, বন্দনা সুব্বা ৮৪৩৬৫১১৪৯১
থাকা-খাওয়া: জনপ্রতি দৈনিক ১০০০ টাকা।
গাড়ির জন্য বলতে পারেন: সঞ্জয় রাই ৯৮০০৪০৮৪৫৬