মাতৃমন্দির।
পুরনো শহর, ফরাসি স্থাপত্য, তামিল সংস্কৃতি, ঋষি অরবিন্দের অধ্যাত্ম্যবাদ এবং এর সব কিছুকে নীল-সবুজ সমুদ্র দিয়ে ঘিরে রেখেছে শহর পন্ডিচেরী। ২০০৬ সালের পর থেকে যে শহরের নাম হয়েছে পুদুচেরী। নাম পরিবর্তন হলেও তার ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম কিন্তু এক ফোঁটাও কৃত্রিম হয়নি কোনও অংশে। আর সবচেয়ে বড় কথা, শহরটায় পা রেখেই একটা মিঠে বাঙালি আমেজ আপনাকে ছুঁয়ে দেবে। তার এক নম্বর কারণ, বহু বাঙালি সেখানে পাকাপাকি ভাবে বাস করেন। কিন্তু কয়েকটা দিন শহরে ঘুরতে গিয়েও দেখতে পাবেন, কসমোপলিটান শহরটায় বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় মানুষও বাংলা ভাষাটা ভালই জানেন। শুধু তা-ই নয়, অন্য রাজ্যের মানুষও সেখানে কী অনায়াসে বাংলা ভাষাকে আত্মস্থ করে নিতে পেরেছেন!
পুদুচেরী শহরটা যেন সকলের জন্যই পছন্দের পশরা সাজিয়ে নিয়ে বসে রয়েছে! স্থাপত্য, শিল্প, ফ্যাশন, খাবার, রোম্যান্স— সব কিছুই এই ফ্রেঞ্চ টাউনে মন ভরানো। তবে এ শহরে খাবারেই যা বৈচিত্র, তাতেই শহরটার কসমোপলিটান পরিচয় আরও পাকাপোক্ত ভাবে বসে যায় মনে। ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ঐতিহ্যশালী ডিশগুলোর সঙ্গে পেয়ে যাবেন সনাতনী চেট্টিনাড় বা তামিল থালিও। খাঁটি কন্টিনেন্টাল খাবারের খোঁজে থাকলে হোয়াইট টাউনেই থাকার কথা ভাবুন। শহরের সবচেয়ে শান্ত-সুন্দর, ছবির মতো জায়গা। পুদুচেরী স্টেশন থেকে অটো নিলে মিনিট পাঁচেক দূরত্বে হোয়াইট টাউন। নামে কলোনিয়াল হ্যাংওভার রয়ে গিয়েছে ঠিকই। তবে এই অংশটায় ঢুকলে প্রথমেই নীল বঙ্গোপসাগর থেকে সতেজ-নোনা বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দেবে। এক দিকে বিস্তীর্ণ খোলা সমুদ্র, পারের কালো ব্যাসল্টের চাঁইগুলো তাতে বুক ডুবিয়ে শহরটাকে আগলে রেখেছে যেন। অন্য দিকে সারি সারি ফ্রেঞ্চ বাংলো। তার মধ্যে কোনওটা আধুনিক হোটেল, কোনওটা বা স্থানীয়দের বাড়ি। মাঝখানের লম্বা-টানা রাস্তাটা যে কোনও মহানগরকে লজ্জায় ফেলে দেবে, এত পরিচ্ছন্ন! এখানেই পায়ে হেঁটে ঘুরে নিতে পারবেন অরবিন্দ আশ্রম, লাইটহাউস, পুরনো চার্চ, জাহাজঘাটা, মিউজ়িয়াম।
হোয়াইট টাউনে কন্টিনেন্টাল ছাড়াও যেটা অবশ্যই খাবেন, সেটা হল উড ফায়ার্ড পিৎজ়া। সাফ্রেন স্ট্রিট পেরিয়ে এম জি রোডের উপরে বেশ কয়েকটা রেস্তরাঁ রয়েছে, যেখানে উড ফায়ার্ড পিৎজ়া পাবেন। উডেন আভেনে পিৎজ়া ব্রেড বেক করা হয় বলেই এমন নাম। জিনিসটা ইটালি থেকে আমদানি। মিডিয়াম থিন ক্রাস্ট ব্রেডের উপরে সানড্রায়েড টম্যাটো, কালো জলপাই, মাশরুম, কর্ন, চিকেনের টুকরো এবং মোজ়ারেলার ভিন্ন ভিন্ন কম্বিনেশনে তৈরি। এ ছাড়াও গোটা হোয়াইট টাউন জুড়ে খানবিশেক রেস্তরাঁ রয়েছে, যেখানে ফ্রেঞ্চ খাবার উপাদেয়। রেড ওয়াইনে স্টু করা চিকেন, তুলসীপাতা ও অন্যান্য হার্ব দিয়ে বানানো সসে রান্না করা বেকড মাটন কিমা, বাটার সসে গ্রিল করা বিফ ফিলে— আশ মিটিয়ে খান। বাদ দেবেন না কন্টিনেন্টাল সি ফুডও। লোভনীয় ক্র্যাব কেক উইথ টার্টার সস, হোয়াইট ওয়াইন-মোজ়ারেলা-মাশরুম সহযোগে রাঁধা গলদা চিংড়ি— ফ্যান্সি অপশনের কিন্তু শেষ নেই!
উড ফায়ার্ড পিৎজ়া
পন্ডিচেরী মিউজ়িয়াম, ভারতী পার্ক, বটানিক্যাল গার্ডেন তো হোয়াইট টাউনে থেকেই দেখে নিতে পারবেন। একটু দূরে যাওয়ার কথা ভাবলে কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার পাবেন। হোয়াইট টাউন থেকে মোটামুটি ৯-১০ কিলোমিটার গেলে পৌঁছে যাবেন ড্যানিশ পোর্ট টাউন— ট্রাঙ্কেবার। আসল নাম তরঙ্গমবারি। ডেনমার্কের লোকেদের অপারগ জিভে সেই নামই হয়েছে ট্রাঙ্কেবার। সমুদ্রের ধারে প্রাচীন দুর্গ, সংগ্রহশালা, ড্যানিশ গভর্নরের বাংলো, লাগোয়া লাইব্রেরি, জ়িয়ন চার্চ— ইতিহাস চুঁইয়ে পড়ছে পোর্ট টাউনের প্রতিটি কোণ থেকে। বিচে ঝিনুক কুড়োতে গিয়ে তেষ্টা পেলে গলা ভিজিয়ে নিন ‘সুকা কাপি’ (কফি) দিয়ে— এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ, ব্রাউন সুগার দিয়ে বানানো ব্ল্যাক কফি ইনফিউশন। তরতাজা লাগবে চুমুক মেরে।
প্রন থার্মিডর
ট্রাঙ্কেবার যাওয়ার পথে তামিলনাড়ুর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নৌকো চেপে ঘুরে আসতে চাইলে চলে যান পিচ্চাভরমে। ব্যাকওয়াটার্সে খানিক ঘোরা হবে। আবার সুন্দরবন ছাড়াও যে ম্যানগ্রোভ তার শিকড় উঁচিয়ে অন্যত্র বিস্তার পেয়েছে, সেটা চাক্ষুষও হবে। বোটিং সেরে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিন পথচলতি কোনও ভাতের হোটেলে। সেখানেই পেয়ে যাবেন বিশুদ্ধ তামিল থালি— মচ্ছিওয়ালি! এক থালিতে চার-পাঁচ রকম মাছের বাহার! কেরা, ওয়ারা, সরা— নামও বিচিত্র তাদের। কোনওটা নারকেলবাটা-সর্ষে ফোড়নে কারিপাতার স্বাদ, কোনওটা তেঁতুল-টম্যাটোর পাতলা ঝোলে আদাবাটার ঝাঁঝ— রসম-সম্বর সহযোগে তৃপ্তি করেই খান। আরও একটু রোমাঞ্চ চাইলে শার্কের ভুরজিও খেতে পারেন! হাঙরের মাংস শুকিয়ে নিয়ে, হলুদ-রসুন-কাঁচালঙ্কা-সর্ষেবাটা দিয়ে কষানো রান্না। জিভে লেগে থাকবে!
অনেকেই পুদুচেরী গেলে অরোভিলে থাকতে চান। কারণ ঋষি অরবিন্দের চিন্তায় শ্রীমার তৈরি এক অনন্ত শান্তির আশ্রয় অরোভিল। সেখানে শুধু ভারতীয় নয়, দেশের বিভিন্ন রাজ্য এবং বিদেশ থেকেও পর্যটকরা এসে থেকে যান কয়েকটা দিন। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বিশ্বাসের মানুষের মিলনস্থল বলা যেতে পারে অরোভিলকে। আসলে মানবজাতির অখণ্ডতা অনুভব করানোই অরোভিলের উদ্দেশ্য। বহু মানুষ দূরদূরান্ত থেকে আসেন শুধু মাত্র ওই উপলব্ধিটুকু পেতে।
গাঁধীমূর্তির পাদদেশে।
অরোভিলের অন্যতম আকর্ষণ মাতৃমন্দির। তবে তাকে কোনও চিরাচরিত মন্দির ভেবে ভুল করবেন না। মাতৃমন্দিরে প্রবেশ করা সম্পর্কে আগে থেকে ইন্টারনেটে তথ্য জোগাড় করে নেবেন। অরোভিলের যে সবুজ ছায়াঘেরা টানা প্রায়-নিস্তব্ধ রাস্তা মাতৃমন্দিরে আপনাকে পৌঁছে দেবে, তার দু’পাশে দেখবেন ছড়ানো ছিটোনো বহু রিসর্ট, হোমস্টে, কাফে, বেকারি। ফেরার পথে অরোভিল বেকারি কিন্তু মিস করবেন না। পথেই পড়বে। আসলে দোকানটা চোখে পড়ার আগেই মাখনভরা পাউরুটি আর সিনামন রোলের উষ্ণ-মধুর গন্ধ আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে ভিতরে। বেকারিতে ডিমের বিভিন্ন পদের সঙ্গে পাবেন নানা রকম স্যান্ডউইচ, ক্রসো, টার্ট, পেস্ট্রি। ভিতরে-বাইরে সুন্দর ইউরোপীয় কাফের ধাঁচে বসার জায়গা। ওখানকার পাইন্যাপল পেস্ট্রি, ডেট চকলেট পেস্ট্রি, কোকোনাট কুকিজ়ের আলাদাই স্বাদ!
কেনাকাটা
খাবারদাবারের সঙ্গে শপিংয়েও মন দিতে পারেন। হোয়াইট টাউনে পাবেন হাতে বানানো বিভিন্ন খেলনা, নোটবই, ল্যাম্পশেড, ওয়াল ডেকোরেশন। অরোভিলে পাবেন দারুণ সব হ্যান্ডলুমের জামাকাপড়, ব্যাগ, কানের দুল, সেরামিকের পাত্র
তবে পন্ডিচেরী মূল শহর থেকে অরোভিল বেশ খানিকটা দূরে। আর জায়গাটা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি গ্রাম। ফলে ইচ্ছেমতো গাড়ি পাবেন না। নিজেদের গাড়ি থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। তবে গোটা জায়গাটা ভাড়া করা সাইকেলেই ঘুরে ফেলা যায়। দু’চাকায় ভর করে বেরোলে দেখতে পাবেন, আপনার মতো দেশি-বিদেশি বহু মানুষই ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাইকেল চেপে। কেউই কারও তেমন পরিচিত নয়। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সৌজন্যে কোনও কার্পণ্য নেই কারও...