কলকাতার সব থেকে নামজাদা লাল বাতি পল্লির উল্টো ফুটে দেখা মেলে সেই বিগতযৌবনার।
চড়া মেকআপের বাহুল্য নেই। বরং বয়সকে থোড়াই কেয়ার স্পর্ধা। অগোছালো, অকুতোভয়। ব্যস্ত রাজপথের অকিঞ্চিৎকর ল্যান্ডমার্ক বয়ে আনছে সেই পোড়খাওয়া ধ্রুপদী সুরভি।
কিংবা আমাদের আবহমান নাগরিক বিকেলের তা আবহসঙ্গীত! থেমে থেমে খুঁড়িয়ে হাঁটা প্রবীণকে যা বয়স ভুলিয়ে দিতে পারে। বেলা চারটে বাজতেই অচেনা ছুটির ছোঁয়া এনে দেয় ক্ষয়াটে নাগরিকতায়।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখ এড়িয়ে যেতেও পারে সেই আটপৌরে অনুজ্জ্বল অস্তিত্ব। কিন্তু ঘ্রাণের মাদকতাটুকু অব্যর্থ। যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ যেখানে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে উঠছে, তার ঠিক কয়েক কদম আগে থমকে আছে কলকাতার দেড়খানা শতাব্দী!
৪০/১ যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ। অ্যালেন্স কিচেন। এসি-র প্রশ্ন নেই। তবে প্যাচপেচে গরমের শহরে কফি-তেষ্টার টানে একটু আরামের ‘ঠান্ডা ঘর’ সন্ধানী যে তরুণ রক্ত, তাকে তখন কৃপার পাত্র মনে হয়! ব্যাটা অর্বাচীন মাইরি জানলও না, কাকে উপেক্ষা করে সে ক-ত সামান্যর পিছে ছুটছে।
দরজার গায়ে ক্যাটকেটে সবুজরঙা পোঁচ, হলদেটে দেওয়াল, কড়িকাঠের ঝুলে তাকিয়ে থাকে উদাসীনতা। তবে সেকেলে উনুনের চুল্লির বদলে গ্যাস জ্বলছে। একটা ফ্রিজও চোখে পড়ছে ইদানীং!
এ সব চোখে না-পড়লেও কিছু যাবে আসবে না। প্লেট ভরা সোনালিরঙা সুখটুকু হাতে নিলে আপনিই আবেশে চোখ বুজে আসবে।
দৈত্যাকার লবস্টার বা দুর্মূল্য গলদার সঙ্গে পাল্লা দেবে অ্যালেনের প্রন কাটলেট। প্রাণপ্রতিমা না হোক, প্রনপ্রতিমা তো বটে! এ-ও কলকাতার সিগনেচার। চিন লোক লাগালে কী হবে বলা শক্ত! তবে অ্যালেনের এই চিংড়ি কাটলেটের নকল আজ অবধি কেউ বের করতে পারেনি। কলকাতার দ্বাপর-ত্রাতার সাক্ষী এই চিংড়ি উৎকর্ষ।
ইতিহাস লেখাজোখা নেই বলাই বাহুল্য! তবে জীবনকৃষ্ণ সাহার পুতি সুব্রত সাহা যা বললেন তাতে আন্দাজ, জোড়াসাঁকোর বাড়ির সব থেকে গুণী ছেলেটির তখনও নামডাক ছড়ায়নি। কিংবা নরেন দত্তের বিবেকানন্দ হতেও ঢের দেরি। জীবনবাবু সম্ভবত ডালহৌসি পাড়ার কিংবদন্তীপ্রতিম স্পেনসেস হোটেলে কাজ করতেন। সাহেবি রান্নায় সেখানেই নাড়া বাঁধা আহিরীটোলার ঘটির। পরে স্পেনসেসের মন্ত্রগুপ্তি রপ্ত করেই চিৎপুরে খুলবেন তাঁর নিজের হেঁসেল।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ধারের দোকান তার ঢের পরের কথা। বছর দশেক আগে ওই তল্লাটে এ-স্বাদরহস্যের খোঁজখবর করতে গিয়ে প্রায় গলাধাক্কা খেয়েছিলুম। ভরসন্ধেয় তিন ভয়ানক গম্ভীর বৃদ্ধ তখন একটি কথা না-বলে হোটেলের যাবতীয় কর্মকাণ্ড দেখভাল করতেন। জীবনকৃষ্ণের নাতি তাঁরা তিন জন। চপকাটলেট ভাজাভুজি থেকে শুরু করে ক্যাশ সামলানো— সব করেন স্বহস্তে। আর কোনওরকম প্রশ্ন শুনলে ভয়ানক ক্ষেপে ওঠেন। মিডিয়ার খবরওয়ালার কৌতূহলও সেই মগ্নতায় টাল খাওয়াতে পারেনি। স্বনামধন্য চিংড়ি কাটলেটের রেসিপি দূরে থাক, এত বড় ঐতিহ্যমণ্ডিত দোকানের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা বাক্যও তিন বৃদ্ধের পেটে বোমা মারলে বেরোত না।
আজকের অ্যালেন তুলনায় পাল্টেছে। চিংড়ির আঁতুড়ঘরের বহিরঙ্গের টুকটাক বদলটাই সব নয়, জীবনকৃষ্ণের তিন নাতি মানিকলাল, হীরালাল, বীরেনকুমার সাহারা এখন রিটায়ার্ড। মানিকলালের পুত্র সুব্রত সাহাও প্রন কাটলেট নিয়ে যথেষ্ট স্পর্শকাতর। চুপিচুপি শুধু এটুকু বলবেন, এর আসল মাহাত্ম্য হল সেই কড়ায় ছাড়ার কসরতে। গড়পড়তা ব্যাটারফ্রাই মাত্রেই অর্থহীন পেটমোটা ডিমের গোলার পাহাড়। ভেতরে মাছটা কাঁচা। কিন্তু অ্যালেনের খেলাটা অন্য। মুচমুচে ব্যাটারের মোড়কে খাঁটি ঘি সুরভিত চিংড়ির কাটলেট মূর্তিমান সভ্যতা। রসিকজনের স্বাদকুঁড়ি চরিতার্থ করতে কলকাতার একটি বিশিষ্ট অবদান।
দোকানের প্রাক্-ফ্রিজ যুগে কদাচিৎ চিংড়ির মানে হেরফের হতো। এ যুগে চিংড়ির আকশছোঁয়া দরে কাটলেট খানিক রোগা হয়েছে। দামও গত এক যুগে ৪২ থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা। কিন্তু কৌলীন্য যে কে সেই! খাঁটি ঘি বা সেরা চিংড়ির মানে আপস না-করে যৎসামান্য লাভের ভাগ রাখা হয়। অ্যালেনের ভেটকি বা চিকেনের স্পেশাল কাটলেটও একই ঘরানার সৃষ্টি। এবং প্রন কাটলেটের থেকে কিছু কম যায় না।
নিজে ডাকসাইটে কন্টিনেন্টাল রান্নাকুশলীদের এক জন সুব্রত। একদা তাজ বেঙ্গলের চেম্বার্সের তারকা শেফ সুভাষ বসুর হাতে-গড়া। কিন্তু শেফ বসুর শত অনুরোধেও পারিবারিক সম্পদ প্রন কাটলেটের তুকতাক ফাঁস করেননি। তবে সুব্রতও না কি ভাজার এই কসরতের ৮০ ভাগ রপ্ত করতে পেরেছেন। তাঁর খুড়তুতো ভাই দীপক, গৌতম বা কাকা উজ্জ্বল সাহারা টানা অভ্যাসে আরও সড়গড়। কলকাত্তাইয়া ঘটি এই সাহাদের রক্তে রান্নাপ্রতিভা। বাড়ির ছেলেরা অনেকেই দেশে-বিদেশে বড়বড় হোটেলের হেঁসেলে বাজিমাত করছেন। কিন্তু কড়ায় কাটলেট ছাড়ার পরম্পরা পরিবারের বাইরে যেতে দেননি।
কম-বেশি ১২০-৩০ বছরে চিংড়ির কাটলেটের সফরে অবশ্য নানা বাঁক। আদি ঠিকানা সে-কলকাতার নেটিভপাড়ার সব থেকে ভারিক্কী রাস্তা চিৎপুর রোড লাগোয়া অ্যালেন মার্কেটের গায়েই। অ্যালেন মার্কেট কবে ভ্যানিশ। কিন্তু চিংড়ির কাটলেটের ব্র্যান্ড-মহিমায় তার নামটুকু বেঁচে আছে।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে আবির্ভাব গত শতকের ’৫০-এর দশকে। স্টার থিয়েটারের উল্টো দিকে কিংবা বালিগঞ্জে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের গলিতেও ম-ম করত প্রনপ্রতিমার সৌরভ। সাহাদের জ্ঞাতিগুষ্টিরা অনেকে সরে আসায় বন্ধ হয়েছে সে-সব দোকান। ’৮০-র দশকে চিৎপুরের আদি দোকান তথা মাস্টার কিচেন উঠে যায় সুব্রতর দাদু দুলাল সাহার আমলে। সবেধন নীলমণি ঠিকানা এখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়েই।
খাঁটি ঘিয়ের সৌরভ যে গল্পকথা নয়, তা আজকের কলকাতাকে বোঝাতে জলজ্যান্ত সত্যের নাম অ্যালেন। কাটলেট-কবিরাজি ছাড়াও কলকাতায় একমেবাদ্বিতীয়ম ঘি-সুরভিত চিকেন স্টেক। চিনিপোড়া হাল্কা পেঁয়াজের রসে মরিচের ঝটকায় সামান্য বীর রসের সঞ্চার। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরানার ডিপফ্রায়েড আলুর খোলে ঠাসা পুরভরা মাছমাংসের চপেরও জুড়ি নেই। আর আছে শিলে-বাটা সাহাদের হোমমেড কাসুন্দির স্বাদ। মিক্সিতে দিলেই না কি তা তেতো হয়ে যায়।
উনুনের যুগাবসানে হারিয়েওছে অবশ্য অনেক কিছু। কয়লার ঢিমে আঁচে অ্যালেনের মাটন শাম্মি কাবাবও একদা প্রন কাটলেটের মতোই জনপ্রিয় ছিল। তার এখন দেখা নেই। শ্যামবাজারের থিয়েটারপাড়ার রমরমার দিনে অহীন্দ্র চৌধুরী থেকে উত্তমকুমার— কে না-আসতেন অ্যালেনে। দোকানের সামনে তখন মেলা গাড়ির ভিড়। কমার্শিয়াল থিয়েটারে যবনিকাপাত শেষে সে-সব দিনও গিয়েছে। বড় হোটেলের চাকরি ছেড়ে পারিবারিক কারবারে ফিরেছেন সুব্রত। মাথা খাটিয়ে চিকেনের কয়েকটা নতুন ভাজাভুজিও মেনুতে যোগ করেছেন তিনি।
না, বহুজাতিক বার্গার-বীরদের মতো বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখেনি কলকাতার সাহারা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এককাট্টা পরিবারের দুর্লভ সৃজনশীলতাকে বাঁচানোর লড়াইটাই আশ্চর্য রূপকথা! বিকেল চারটে থেকে বড়জোর আটটা-ন’টা— টিম অ্যালেনের স্টক ফুরোবে এর মধ্যেই। চাহিদা থাকলেও এর বেশি ধকলের সাধ বা সাধ্য নেই। প্রনপ্রতিমার বয়স হলেও তাই ফিকে হয়নি আকর্ষণ। নাগরিক সন্ধের সীমা ছুঁয়ে এই চেনা শহরের অচেনা মোড়ে জেগে থাকে তার অমোঘ হাতছানি।
সেই আহ্বানে নিছকই অপেক্ষা নয়, মিশে আছে স্পর্ধিত অহঙ্কার।
(ছবি: অনিমেষ সাহা)