প্রণব মুখোপাধ্যায় ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। ভারতরত্নও। বঙ্গবাসী ও বঙ্গভাষী হিসেবে আমরা সবাই এ জন্য গর্ববোধ করি। তবে আমার মতে, প্রণবদা ছিলেন রাজনীতির রত্ন। তাঁর মতো রাজনীতি-অন্তপ্রাণ ব্যক্তির পক্ষে এটাই বোধ হয় সব চেয়ে বড় শিরোপা!
পিছনে তাকিয়ে ভাবছি, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কত দিনের পরিচয় আমার? ১৯৮৪-তে আমার প্রথম লোকসভা নির্বাচনের টিকিট পাওয়ার পিছনে প্রণবদা ছিলেন। সেই কথা পরে বলব। মনে পড়ছে তারও আগে ১৯৮৩ সালের কথা। সুব্রতদা, মানে সুব্রত মুখোপাধ্যায় তখন প্রণবদার টিম করেন। আমরা কাজ করতাম সুব্রতদার সঙ্গে।
কলকাতায় এআইসিসি-র অধিবেশন। প্রতিনিধিদের থাকার বন্দোবস্ত দেখাশোনার দায়িত্বে সুব্রতদা। সেই সংক্রান্ত কাজের সূত্রেই আমার প্রথম প্রণবদার কাছাকাছি যাওয়া। তিনি তখন কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী। কলকাতায় এলে উঠতেন আমির আলি অ্যাভিনিউয়ে সরকারি ভবন ‘কপার হাউস’-এ। ওটি তখন ছিল ছোট দোতলা বাংলো।
কী জানি, হয়তো আমার নামে আগেই কিছু ভাল কথা শুনেছিলেন প্রণবদা! তাই প্রথম আলাপেই তাঁর স্নেহের ছোঁয়া পেলাম। উৎসাহ দিলেন। প্রশংসাও করলেন। যোগাযোগের সেই শুরু। এর অল্প দিন পরেই আর একটি ঘটনা। জম্মু-কাশ্মীরে কংগ্রেস কর্মীদের উপরে গুলি চলল। নিহত হলেন কয়েক জন। ফারুক আবদুল্লা তখন কলকাতায়। পর দিন খুব ভোরে ফিরে যাবেন। দিল্লি থেকে প্রণবদা নির্দেশ দিলেন, ‘‘কাল ফারুক আবদুল্লাকে বিমানবন্দরে তোরা বিক্ষোভ দেখাবি।’’ সেই মতো শীতের ভোরে ৪টের সময় একটি গাড়ি জোগাড় করে বেরোলাম। সঙ্গে আমার ভাই অমিত, সুব্রত বক্সী। পথে জয়ন্ত ভট্টাচার্য এবং অশোক দেবকে তোলার কথা।
রাস্তায় কাঠের গুঁড়ি বোঝাই একটি লরিতে ধাক্কা মারল গাড়ি। তবু প্রাণে বাঁচলাম। ভাঙা গাড়িতেই বাকিদের তুলে বিমানবন্দরে বিক্ষোভ দেখিয়ে সব খবর দিলাম প্রণবদাকে।
আরও পড়ুন: বিদায় প্রণব মুখোপাধ্যায়, ২২ দিনের যুদ্ধ শেষ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির
আরও পড়ুন: ‘ওঁর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা যেত’
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রণবদা বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা, বর্ষা-বসন্ত, কঠিন পরিস্থিতি, সহজ সমাধানের অংশীদার ও সাক্ষী। আমরা জানি, ইন্দিরা গাঁধীর মন্ত্রিসভায় প্রণবদা ছিলেন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ইন্দিরাজি তাঁর উপর নির্ভর করতেন চোখ বুজে। এই ভাবে অনেক কাজ তখন সমাধা হয়েছে। সেই বিশ্বস্ততা প্রণবদা অর্জন করেছিলেন।
তবে রাজীব গাঁধীর সঙ্গে প্রণবদার সম্পর্ক ভাল ছিল না। ইন্দিরাজি যে দিন নিহত হন, আমরা সে দিন রাজীবজির সঙ্গে সফর করছি। কাঁথির পথে কনভয় থামিয়ে আমাদের গাড়ির কাছে এসে রাজীবজি বললেন, ‘‘মাম্মি কো গোলি লাগা…’’।
তৎক্ষণাৎ ফিরে যাওয়া। বিমানে বরকতদার সঙ্গে সে দিন প্রণবদার কটু বাক্য বিনিময় হয়েছিল। যা-ই হোক, রাজীবজি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হন। তার পরে ১৯৮৪-র ভোট।
যাদবপুরে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের নাম উঠছিল। কিন্তু প্রণবদা আমার নাম সুপারিশ করেন। সুব্রতদার কাছ থেকে নামটি গিয়েছিল প্রণবদার কাছে। প্রণবদা ফোন করে জানতে চান, ‘‘তুই লড়তে পারবি তো?’’ তাঁকে বলেছিলাম, ‘‘সুযোগ পেলে লড়ে যাব। পালাব না।’’ তিনি আমার জন্য প্রচারে এসেছিলেন। বারুইপুরে, বেহালায় সভা করেছিলেন।
আমি লোকসভায় যাওয়ার পরে রাজীবজি আমাকে পছন্দ করেছিলেন। রাজ্যে সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁর কাছে অনেক সুযোগ ও প্রশ্রয় পেয়েছি। কিন্তু প্রণবদার সঙ্গে রাজীব গাঁধীর দূরত্ব বাড়ছিল। তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। বরকতদাকেও নয়। দলেও প্রণবদা চাপে ছিলেন। মন স্বাভাবিক ভাবেই ভারাক্রান্ত তখন।
এক দিন আমাকে বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে রাজীবের আলাদা কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?’’ রাজীবজিকে অনুরোধ করে রাজি করালাম। সম্ভবত ১৯৮৭। ত্রিপুরায় সেই বৈঠক হল।
তবু কংগ্রেস ছেড়ে প্রণবদা রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গড়লেন। রাজ্যে ১৯৮৭-র বিধানসভা নির্বাচনে কয়েকটি আসনে লড়ে শোচনীয় ভাবে হারল তাঁর দল। তিনি আবার পরে কংগ্রেসে মিশে গিয়েছিলেন। শুধু এটুকুই বলব, ওই সময় দল গড়তে গিয়ে প্রণবদা হয়তো ঠিক করেননি। সেই সাংগঠনিক পরিকাঠামোই তাঁর ছিল না। উপর তলায় নেতা থেকে শিল্পপতি সবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। নিচু তলায় নয়।
যখন প্রণবদা কংগ্রেসে থেকেও চাপে বা আমি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেছি, তখনও কোনও দিন তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। ১৯৮৯-তে লোকসভা নির্বাচনে আমি জিততে পারিনি। দিল্লিতে গিয়ে থাকব কোথায়? প্রণবদার বাড়ি ছিল আমার ঠিকানা।
সেই সময় এক বার তাঁর বাড়িতে দেখি, দোতলার ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রলোক এসেছেন। মুখটা চেনা লাগছে। কোথাও কোনও ছবিতে যেন দেখেছি। প্রণবদাকে আড়ালে ডেকে বললাম, ‘‘উনি কি ধীরুভাই অম্বানী? যদি তা-ই হন, তা হলে একটু বলুন না, আমাদের ওখানে ‘স্যাপ’ কারখানাটি যাতে খুলে দেন। অনেক লোক বিপন্ন।’’ প্রণবদা হেসে বলেছিলেন, ‘‘তুই তো সাঙ্ঘাতিক!’’
প্রণবদা যেখানে যে পদেই থাকুন, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি, দিল্লি গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করা ছিল আমার বাঁধা রুটিন। তিনি কলকাতায় এলেও তাই। দিনের কাজ সেরে বেশি রাতে আড্ডা জমত।
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তাঁর কাছে নালিশ করেছি অনেক বার। আমাকে মুখে তিনি এক রকম বলতেন। কিন্তু শুনতাম, তিনিও নাকি ভিতরে ভিতরে বিষয়টি মদত দেন। এ নিয়ে কত ঝগড়া-লড়াই যে হয়েছে তাঁর সঙ্গে! আজ সেই স্মৃতিগুলিও মনে পড়ছে।
প্রণবদার আচরণে চোখের জলও ফেলতে হয়েছে আমাকে। ২০০৯-এর দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শরিক ছিল তৃণমূল। মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বে আমি রেলমন্ত্রী, আমাদের আরও ছ’জন বিভিন্ন রাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রণবদা ছিলেন ওই সরকারে অর্থমন্ত্রী। ঘটনাটি তখনকার।
প্রসঙ্গত এটাও বলি, সনিয়াজি না-চাইলে সে বার কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের জোট হত না। হনুমন্ত রাও এসেছিলেন রাজ্যে কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক হয়ে। প্রণবদার ভূমিকা তখনও খুব ইতিবাচক ছিল বলে মনে করি না।
কোনও নতুন প্রকল্পে বা চালু কাজের জন্য টাকা দিতে বরাবর ভীষণ কার্পণ্য করতেন অর্থমন্ত্রী প্রণবদা। সেই সময় এক দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে হয়ে গেল চরম অশান্তি।
কলকাতায় মেট্রোর কয়েকটি নতুন প্রকল্প ও সম্প্রসারণের জন্য টাকা চেয়ে ফাইল পাঠিয়েছিলাম। কাজগুলি পরিকল্পনা বহির্ভূত নয়। তবু তিনি টাকা ছাড়বেন না। বৈঠকে আমি বললাম, কেন দেবেন না? উনি হঠাৎ বলে বসলেন, ‘‘তোর দলে তুই একা ক্যাবিনেটে আছিস। কী ভাবিস নিজেকে? তোর এত বেশি কথা শুনব না। টাকা পাবি না।’’
অপমানে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। কেঁদে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, ছুটে এলেন আমার এক সতীর্থ মন্ত্রী শেলজা। আমাকে হাত ধরে বসালেন। শান্ত করার চেষ্টা করলেন। প্রণবদা তখনও নিজের জেদে অটল। পরে অবশ্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন আমি আদায় করতে পেরেছিলাম। প্রণবদাকে কাছের মানুষ ভাবতাম বলেই বোধ হয় তাঁর কাছে পাওয়া আঘাত ভুলিনি।
জানি, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে অবসর যাপনের দিনগুলি পর্যন্ত প্রণবদা মানসিক ভাবে খুব ভাল ছিলেন না। কংগ্রেসের সঙ্গে, রাজনীতির সঙ্গে এমন দূরত্ব তিনি মানতে পারেননি। যদি তিনি কংগ্রেসে থাকতেন, তাঁর পরামর্শে তাদের হয়তো আজকের অবস্থায় পড়তে হত না। আসলে প্রণবদার বৈদগ্ধ, অভিজ্ঞতা, কর্মকুশলতা— এ সবের তো জুড়ি নেই।
হৃদয়ের উষ্ণতাই বা ভুলি কী করে! তাঁর রাষ্ট্রপতি পদে শপথে আমি যাতে থাকি, তাই বিশেষ বিমান পাঠিয়েছিলেন যাতায়াতের। সংসদের সেন্ট্রাল হলে একদম পিছনে বসেছিলাম। শপথ সেরে আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা সহকারে বেরোচ্ছিলেন যখন, আবেগে ডেকে ফেললাম, ‘‘প্রণবদা...!’’ মাননীয় রাষ্ট্রপতি দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন, ‘‘কোথায় ছিলি তুই? দেখতেই পেলাম না!’’
মন বলছে, আর তো কোনও দিন আপনার সঙ্গে দেখা হবে না, প্রণবদা! অসুস্থ হওয়ার আগের সপ্তাহেও ফোন করেছিলাম। বললেন, ‘‘ভাল লাগে না রে! কোনও কাজ নেই।’’ বলেছিলাম, ‘‘লিখুন, পড়ুন। আপনি তো লেখাপড়া করতে ভালবাসেন।’’ শুনে হেসেছিলেন শুধু।
সেটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা। ফোনে শোনা হাসিটুকু থাক স্মৃতি হয়ে।
(অনুলিখন: দেবাশিস ভট্টাচার্য)