স্বাধীনতা দিবসে ক্রিকেট-পরাধীনতায় ফিরে যাওয়ার অশনিসঙ্কেত

‘আ টেল অব টু সিটিজ’-এ যেমন উল বুনতে থাকা মহিলারা গিলোটিনে ধড়াধ্ধড় খালাস হতে থাকা লাশগুলো গুনত এক, দুই, তিন... তেমনই বিশ্বের তাবড় ক্রিকেট-রেকর্ড রক্ষকরাও অবিরাম গুনে চলেছে— এগারো, বারো, তেরো। চাই আর তিন।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪৫
Share:

‘আ টেল অব টু সিটিজ’-এ যেমন উল বুনতে থাকা মহিলারা গিলোটিনে ধড়াধড় খালাস হতে থাকা লাশগুলো গুনত এক, দুই, তিন... তেমনই বিশ্বের তাবড় ক্রিকেট-রেকর্ড রক্ষকরাও অবিরাম গুনে চলেছে— এগারো, বারো, তেরো। চাই আর তিন।

Advertisement

তা হলেই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি হয়ে যাবেন বিদেশের মাঠে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি টেস্ট হারা অধিনায়ক। ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের ধারণা, শুক্রবার থেকে শুরু ওভাল টেস্টে যা-ই ঘটুক, রেকর্ডটা মাস ছয়েকের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার বুকে ঘটে যাবে। মাইকেল ক্লার্ক যে বসে আছেন কোহলিদের সঙ্গে সবুজ ঘাসে দেখা করার জন্য!

তখন ধোনি দাঁড়িয়ে থাকবেন একই সঙ্গে পূর্ণিমার চাঁদ এবং চাঁদের কলঙ্ক হয়ে! ভারতের সর্বকালের সফলতম অধিনায়ক! একই সঙ্গে প্রবাসে বিশ্বের সবচেয়ে হতমান অধিনায়ক। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এমন কন্ট্রাডিকশন ক্রিকেটের ত্রিসীমানায় কখনও কেউ দেখেনি!

Advertisement

তিন বছর আগে তেন্ডুলকর-দ্রাবিড় সমৃদ্ধ ভারত যখন কুকের দেশে ০-৪ চুরমার হয় তখনও যাবতীয় অবিশ্বাসী বিপর্যয়ের মধ্যে দ্রাবিড়ের ব্যাট মশালের ন্যূনতম দিগনির্দেশ করেছিল। অথচ এ বার লর্ডস জিতে উঠেও অবিরাম শিরশিরানির সঙ্কেত।

ভারতীয় ক্রিকেট মহলের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই মনে হচ্ছে, সিরিজ হার বা ড্র করাটা তাৎক্ষণিক। আসল আতঙ্ক হল সেই অনুভূতি। যা অসাড়ে শিরায় ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রবাসে আমরা সর্বগ্রাসী অসহায়। অন্তত দু’জন প্রাক্তন অধিনায়ক ব্যক্তিগত আলোচনায় বলছেন, আবার তো সেই আজহারের আমলে ফেরত যাচ্ছি আমরা। যখন দেশের মাঠে টার্নার বানাতাম আর বিদেশে পৌঁছলেই সভয়ে হারাটা রুটিন ছিল।

এঁরা কেউ অবশ্যই মুখ খুলবেন না। ওয়াড়েকর, বেঙ্গসরকর এবং বেদী। তিনটে টেস্ট কেস প্রমাণ করে দিয়েছে যে ধোনির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণাত্মক হয়েছ তো কী, ভারতীয় বোর্ডের দমননীতির আওতায় চলে যাবে! শ্রীনিবাসন সেটা তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ বলে ধরে নেবেন। সিপিএমের আমলে নির্লজ্জ তোষামোদগিরি এবং সব রকম সুবিধে ভোগ করেও একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে সমাদর পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু শ্রীনির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অত দয়াপরবশ হওয়ার ব্যাপার নেই। এক বারের বেচাল কী চিরন্তন নির্বাসন। বিদেশি ভাষ্যকার হলেও একই নিয়ম! নমুনা প্রয়াত টনি গ্রেগ।

সুতরাং সৌরভ জমানায় ক্রিকেট উদারীকরণে উন্নীত আধুনিক ক্রিকেট-ভারত যে সাবেকি পরাধীনতার আপাতত অন্ধকার ছায়ার মধ্যে, তা নিয়ে কোনও কথাই হচ্ছে না। কেউ জিজ্ঞেস করার নেই যে, পরপর তিনটে সিরিজ তোমরা খেলছ সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড আর এ বারে ইংল্যান্ড। কেন প্রত্যেকটাতেই এমন হাল হচ্ছে?

মাইক ব্রিয়ারলি টেস্ট সিরিজ দেখে লিখছেন, ভারতীয় স্লিপ ফিল্ডাররা বড্ড গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াচ্ছে। আর দাঁড়াচ্ছেও বড় সোজা-সোজা। পজিশনের ভঙ্গিটা ঠিক হচ্ছে না। এই ধরনের সমালোচনা লোকে স্কুল টিম সম্পর্কে করে। বিয়াল্লিশ অল আউটের দুঃসময়েও ব্রিটিশ মিডিয়া এই পর্যায়ের হেনস্থা টিমকে করেনি।

এ বারে করার কারণ পর্যাপ্ত। চার টেস্টে ১১ ক্যাচ ফেলেছে ধোনির ভারত। স্লিপে তার মধ্যে পড়েছে সাতটা। মোট ক্যাচ মিস থেকে গচ্চা গিয়েছে ৩৩৭ রান। এখানেই শেষ নয়, ভারতের চার নম্বর ব্যাটসম্যান অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে ৩০ বল খেলে করেছেন মাত্র ৭। আউট হয়েছেন চার বার। তিন নম্বর ব্যাটসম্যানের স্ট্যাটিসটিক্স হাতড়ে দেখা যাচ্ছে বিদেশে শতকরা ৪৮ শতাংশ আউট হয় এলবিডব্লু নইলে বোল্ড। মানে ভেতরে আসা বল খেলতে সমস্যা হচ্ছে। এটা রাহুল দ্রাবিড়ের শেষ প্রহরে গিয়ে হত। দ্রাবিড় বংশের উত্তরাধিকারের যদি এখনই হতে থাকে, তা হলে সেই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী!

এগুলো সব স্ট্যাটস। কারও ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ নয়। কিন্তু উত্তর দেবে কে? এত গুরুত্বপূর্ণ টেস্টের দু’দিন আগে ভারত অধিনায়ক কেন প্র্যাকটিসে এলেন না জানানোর ইচ্ছেও কারওর নেই। জেমস অ্যান্ডারসন যদি মাঠের বাইরে প্রধান শত্রু হন, তা হলে সেই নমিনেশনে ভারতীয় মিডিয়া দু’নম্বরে কাছাকাছি থাকবে। যত কম এদের সঙ্গে কথা বলা যায়, তত ভাল। এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ তো উঠেই গিয়েছে যেন ব্রিটিশ আমলের একটা চরম জঘন্য অভ্যেস ছিল।

কোচ ডানকান ফ্লেচার মিডিয়ার সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক রাখেন না। বাঘের দুধও জোগাড় করা যেতে পারে, তাঁর একক ইন্টারভিউ নয়। নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান সন্দীপ পাটিল তো কথাই বলেন না। কথাবার্তায় এমন অনর্গল, প্রাক্তন টিভি বিশ্লেষক গত সাত বছর ধরে ক্রিকেট সাংবাদিকদের সামনে বোবা। তিন বছর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান হিসেবে। চার বছর জাতীয় নির্বাচক কমিটিতে। শ্রীনির জমানায় আসলে নৈঃশব্দ্য সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মুখ খুললেই চৈত্রের শেষ বিকেলে সেলের মতো ভ্যালু কমে গেল।

সমস্যা হল যে কোনও পারফর্মিং আর্ট, তা সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য সবেই বিচার দু’ধরনের হয়। একটা তৎক্ষণাৎ। একটা ঐতিহাসিক।

আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর পরে অনেকের বিশ্বাস মতো ধোনি যদি ঝাড়খন্ড থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত সাংসদও হয়ে যান, ইতিহাসের বিচার ঠেকানোর মতো প্রতাপ তাঁর থাকবে না। কোনও শ্রীনিবাসনও পারবেন না সেই বিচারের দাঁড়িপাল্লাকে কিনে নিতে। কুমার সঙ্গাকারার কোনও শ্রীনি নেই। অথচ আধুনিক বা ভবিষ্যৎ কোনও ইতিহাসেরই বিচারের তাতে বেশি-কম হওয়ার উপায় নেই। সঙ্গাকারা সেই বিরল পাঁচ ক্রিকেটারের একজন যাঁদের টেস্ট আর ওয়ান ডে দু’টোতেই এগারো হাজার রান আছে। এর সঙ্গে যোগ করুন ৩৭ সেঞ্চুরি। টেস্টে ৫৯ গড় আর কিপিং না করা টেস্টে ৭০ গড়।

ডিকেন্সের উল-বুনিয়েরা অনাবেগী ভাবে এক-একটা শব দেহের সংখ্যা গুনত। ক্রিকেট ইতিহাসও তাই ধোনি নিয়ে তেমনই নিষ্ঠুর রায় দিয়ে দেবে, ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টিতে ভারতের সর্বোত্তম। কিন্তু ক্রিকেট-পৌরুষের আসল সরণি বিদেশের টেস্ট সিরিজে ক্রিকেট- স্বাধীন দেশকে পরাধীনতায় ফিরিয়ে দিয়েছিল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement