রোখোর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্ল্যাকার্ড কোপাকাবানা বিচে। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
দিয়েগো মারাদোনা নাকি মাত্র ক’দিন আগেও তাঁর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছেন, “হ্যাঁ রে, কলকাতায় ব্রাজিলের ফ্ল্যাগের সংখ্যা কমার ব্যাপারে কিছু জানলি?” ছ’বছর আগে কলকাতায় দু’দিনের সফর মারাদোনাকে এত ছুঁয়ে গিয়েছিল যে, বারবারই তিনি বলে ফেলেন, “এত দেশে গিয়েছি। কিন্তু আর্জেন্তিনার বাইরে কোথাও যদি সবচেয়ে বেশি ভালবাসা পেয়ে থাকি, তা হলে এক নম্বর হল নাপোলি। দুই কলকাতা।”
দিয়েগোর বাংলা-প্রীতি দেখে তাঁর ম্যানেজার সেবাস্তিয়ান দে মন্তে দু’হাতে তাঁর ছেলেমেয়ের নামে দু’টো ট্যাটু করেছেন। দু’টোই বাংলা হরফে! রোববার কাপ ফাইনাল ব্রাজিলের মতো শত্রু দেশে খেলার বদলে সল্টলেক স্টেডিয়ামে হলে কি মারাদোনা-সহ আর্জেন্তিনীয়রা অনেক আশ্বস্ত বোধ করতেন?
উত্তর, ‘না’। আর্জেন্তিনা তো রিও-কে বিলক্ষণ বুয়েনস আইরেস বানিয়ে দিয়েছে! এখানকার বিশ্ববিখ্যাত ইপেনেমা বিচে শনিবার সকালে দেখলাম, চোদ্দোশো টাকায় আর্জেন্তিনার পতাকা বিক্রি হচ্ছে! দরাদরি করেও যখন কমলো না, তার মানে পতাকার বিশাল বাজার। রিও শহরের মাঝখানে তেরেইরো বলে একটা জায়গা রয়েছে, অনেকটা ধর্মতলা বাসগুমটির মতো। সেখানে এখন শ’য়ে-শ’য়ে তাঁবু পাতা। রিওর মেয়র এঁদের এখানে দয়াপরবশ হয়ে থাকতে দিয়েছেন। এঁরা সব সফরকারী আর্জেন্তিনীয়। হোটেলে ক’জনের ব্যবস্থা হবে? এক লক্ষের মতো লোক তো মেসির দেশ থেকে চলে এসেছেন! এমনিতে ফাইনালের বাজারে রিওর হোটেলগুলো যা দাম বাড়িয়েছে, তা অস্বাভাবিক! ডেকার্স লেনের ঘুগনি গ্র্যান্ডের ক্লাব স্যান্ডউইচের সমান টাকা দাবি করার মতো। যাঁরা এসেছেন তাঁদের অর্ধেকেরই না আছে টিকিট, না থাকার জায়গা।
পাবলো জাবালেতা অবাক হয়ে বলছেন, কেউ কেউ নিজের গাড়ি বিক্রি করে সেই টাকায় চলে এসেছেন। অথচ ম্যাচের টিকিট নেই। কাল রাত্তিরে মারাকানা প্রেসবক্সে বসে কাজ করা যাচ্ছিল না, বাইরে এত চিৎকার আর বাজনা। কী না, আর্জেন্তিনীয় সমর্থকরা ব্যান্ডপার্টি নিয়ে শোভাযাত্রা করছেন। আর সেই মিছিলটা ঘুরেফিরে বারবার মারাকানাতেই জমা হচ্ছে। কোপাকাবানা তটে তো শুধুই নীল আর সাদা। হলুদ রংটা যে দু’দিন আগে জ্বলজ্বল করছিল এবং তাদের আজ শেষ খেলাও রয়েছে কে বলবে! পোপের পোশাক এবং তাঁর মুখোশে এক আর্জেন্তিনীয় সমুদ্রের ধারে ঘুরছেন। সমর্থকেরা তাঁর কাছে হাঁটু গেড়ে বসছেন। আর তিনি যেন ভ্যাটিকানের আশীর্বাদ দিয়ে বলছেন, “বৎস, মনস্কামনা পূর্ণ হবে। গোলটা মেসিই করছে।” একটু এগিয়ে সমুদ্রের ধারে প্ল্যাকার্ড ঝুলছে, ‘রোখো, ক্ষমা চাইছি।’ এর নেপথ্যের গল্পটা হল, মেসির সতীর্থ মার্কাস রোখোকে নাকি আর্জেন্তিনীয় ফুটবল অনুরাগীরা কিছু দিন আগেও তীব্র কটাক্ষ করতেন। বলতেন, “ও জাতীয় দলে খেলার যোগ্যই নয়।” বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে এসে সেই অনুরাগীরাই রোখোর কাছে ক্ষমা চাইছেন। আর বলছেন আর্জেন্তিনা টিমে মেসি, রোখো আর বাকি ন’জন মিলে গেলেই জার্মানির জন্য যথেষ্ট। এই প্ল্যাকার্ডটা ঝুলিয়েছেন বুয়েনস আইরেস উপকণ্ঠের ছোট্ট শহর ক্যানুয়েলাসের লোকেরা।
কোপাকাবানা যেখানে শেষ হচ্ছে, ঠিক সেই দিকের এক প্রান্তে সোফিটেল হোটেল। ঢুকতে গিয়ে দেখি, বিশাল ভিড় আর পুলিশের গাড়ি কিলবিল করছে। কোনও ভিভিআইপি এখনই বেরোবেন। তাঁর জন্য জেড প্লাস নিরাপত্তা দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি কে? মারাদোনা তো এ দিকে নেই। থাকার কথাও না। এটা ফিফার হোটেল। তা হলে কি পেলে? জানা গেল, পেলেও নন। তবে?
জোসেফ ব্লাটার। এখনই বার হবেন তিনি। তা ফিফা মহাকর্তার গাড়ির সামনে পতাকা হাতে আর্জেন্তিনীয়রা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে দিলেন।
বন্য আবেগ ও দু’কূল ছাপানো ফুটবল-ভালবাসা যদি মাপকাঠি হতো, তা হলে বিশ্বকাপ ফাইনালে মেসিরা চার গোলে এগিয়ে থেকে খেলা শুরু করছেন! কিন্তু তা যে হয় না, জাতীয় সঙ্গীতের সময় নেইমারের জার্সি দুলিয়েও সাত গোল খাওয়া ব্রাজিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ!
আধুনিক ফুটবল-যুদ্ধ মানে বিজ্ঞান। ফিটনেস। শক্তি। আর চুলচেরা ব্যাপারেও নিখুঁত থাকা। এর সব ক’টা ধারায় জার্মানরা এগিয়ে। আর্জেন্তিনা সবচেয়ে ভয় পায় জার্মানদের বন্য শারীরিক শক্তিকে। আলেজান্দ্রো সাবেয়া রোববার ফাইনালের পর চাকরি ছেড়ে দিলে কোচ হিসেবে যাঁর নাম সবার আগে উঠছে, তিনি দিয়েগো সিমিওনে। এ দিন তিনি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন— জার্মানরা হাফ লাইন অবধি এগিয়ে যে অফসাইডের ফাঁদ পাতে, ওদের পেছনের সেই ফাঁকা জমিটাই কাজে লাগাতে হবে। সমস্যা হল, বোয়াতেং-সোয়াইনস্টাইগারদের সরিয়ে তবে তো ওই অবধি পৌঁছতে হবে! রিওতেই শোনা যায়, বিখ্যাত বাঙালি কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের নামে রাস্তা আছে। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ তাঁর কথা সত্যজিৎ রায় মনে না করিয়ে দিলে বাঙালি ভুলেই গিয়েছিল। মুখ্যত অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় সুরেশ অসমসাহসী যোদ্ধাও ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বছরে ব্রাজিলেই মারা যান। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ব্রাজিলীয় সেনাবাহিনীর হয়ে কখনও খালি হাতেও দুঃসাহসী সব যুদ্ধ করেছেন। রিওতে তাই এক সময় তাঁর এত প্রসিদ্ধি ছিল।
জার্মান ডিফেন্স ঐতিহাসিক ভাবেই এমন শক্ত গ্রানাইটে তৈরি যে, সেটা মারাকানায় ভাঙতে হলে স্কিলের আগে ফুটবলারের দরকার কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের মতো যোদ্ধার অদম্য সাহস। মারাদোনা, যাঁকে একই শহরে থেকেও টিমের কেউ ফোন অবধি করেনি, তিনি নিজে থেকে বলেছেন “মেসি, জিতলে কিন্তু লাল কার্পেট দেব তোমাকে।” মারাদোনা এখন দেশ ছেড়ে দুবাইয়ে চলে গিয়েছেন। ওখানেই থাকেন। সাবেয়া বিশ্বকাপের পর ছেড়ে দিলেও তাঁকে ফেরাবে না আর্জেন্তিনীয় ফুটবল সংস্থা। শুনছি মারাদোনা ভেনেজুয়েলার কোচ হয়ে যাবেন শিগগির। মেসির সংবর্ধনা তার মানে দুবাইয়ের কোনও শেখ বা ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতির আবাসে হওয়ার কথা। কিন্তু সে সবের আগে লাল কার্পেটের ব্যবস্থাটা কী ভাবে হবে? কে-ই বা করবে?
রিও-র অসম্ভব সৌন্দর্যের মাঝেই যেমন লুকিয়ে বিপদের চোরাবালি, জার্মান ডিফেন্সও তেমন। এখানকার পাহাড়, সমুদ্র, শনিবারের তুলনামূলক বেশি নীল আকাশ, সব একাকার হয়ে যাওয়া আর সুন্দর সুন্দর বিচ দেখে মনে হবে এটাই স্বর্গ। তখনই স্থানীয় বিশ্বস্ত মানুষেরা মনে করিয়ে দেবেন সতর্ক থাকার কথা। পাহাড়ের ধারে ওই যে বাড়িগুলো লম্বা লম্বা নেমে এসেছে, যাদের বলা হয় ‘সাবেলা’, সেগুলোর প্রত্যেকটা মাদকের আড়ত। মারিজুয়ানা, হাসিস, এলএসডি মুড়িমুড়কির মতো পাওয়া যায়। ব্রাজিলীয় হোটেল মালিক বলছিলেন, ব্রাজিলে একটা ফুটবলের দোকান পেতে একটু দেরি হতে পারে। ড্রাগ সব সময় হাতের কাছে!
জার্মান ডিফেন্সও যে কী মারাত্মক চোরাবালি, প্রথম ম্যাচে পর্তুগাল তা আবিষ্কার করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরেও শিক্ষা নেয়নি স্কোলারির টিম। ছকটা এই রকম জার্মানি প্রথম গোলটা করে দেওয়ার পর যেই বিপক্ষ কাউন্টার অ্যাটাকে উঠবে, একটা লুজ লম্বা বল দিয়ে দেওয়া হবে রাইট উইংয়ে মুলারকে। সেখান থেকে বাঁ দিকে ওজিল আর মাঝখানে ক্লোজে অপেক্ষা করে থাকবেন! এ দিন দেখছিলাম জাবালেতা বলেছেন, এই ফাঁদ সম্পর্কে আর্জেন্তিনা ওয়াকিবহাল। তারা বেলো হরাইজন্তের ব্রাজিল হবে না! মাসচেরানো বকলমে আর্জেন্তিনা টিমের ম্যানেজার। তিনি বাকিদের দিনভর বুঝিয়ে গেলেন, জার্মানি মানে শুধু পাওয়ার নয়। ফাঁদও। ম্যাচে সতর্ক থেকো।
ফাইনালের জন্য দু’টিম কী ফর্মেশন বাছে, সেটাও ফুটবল-গবেষকদের লোভনীয় খাদ্য হবে। চব্বিশ বছর আগে রোমের পরিস্থিতি আর নেই। এখন টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং অর্ডারের মতো প্রত্যেক ম্যাচে সুবিধে অনুযায়ী টিমগুলো ফর্মেশন বদলায়। কখনও ব্যাক বাড়িয়ে দিল। কখনও কমিয়ে মিডফিল্ডে লোক বাড়াল। কখনও আসল স্ট্রাইকারকে লুকিয়ে রাখল দুই স্ট্রাইকারের পিছনে নকল মাঝমাঠ করে। ফর্মেশন নিয়ে ফুটবল-আধুনিক দেশগুলোর ক্রমান্বয়ে এই বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখার মতোই আকর্ষণীয়!
জার্মানি যেমন প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে লাতিন আমেরিকা থেকে ট্রফি ছিনিয়ে নেওয়ার ঐতিহাসিক দাবিদার আর সেটাই তাদের চূড়ান্ত মোটিভেশন! আর্জেন্তিনা তেমনই চব্বিশ বছরের পুরনো ক্ষতের ন্যায়বিচার চায়। মারাদোনা যেমন টিমের কাছাকাছি এক বারের জন্যও না ভিড়ে টিভি নেটওয়ার্ক মারফত টিমকে চাগাচ্ছেন। বলছেন, “তোমরা ব্রাজিলের সঙ্গে ওদের রূপটা শুধু মনে রেখো না। মাথায় রেখো আলজিরিয়ার সামনে সে দিন জার্মানিকে কেমন অসহায় লাগছিল।” এর কারণ, নব্বইয়ের টিমের তাঁরা সবাই চব্বিশ বছরের একটা বদলা চান!
ওই টিমের অনেকে এখনও ক্লিন্সম্যান বা ফোলারের সঙ্গে কথা বলেন না। ক্লিন্সম্যান একটা ফলস ডাইভ দিয়ে লালকার্ড খাইয়েছিলেন মারাদোনার টিমকে। তারা অনেকটা সময় দশ জনে খেলেছিল। আর সেনসিনির ট্যাকলে ফোলার এমন ভান করেছিলেন যেন তাঁকে অসম্ভব অবৈধ ট্যাকল করা হয়েছে। ওই শরীরী ভাষাতেই নাকি মেক্সিকান রেফারি বিভ্রান্ত হয়ে পেনাল্টি স্পটে বল বসিয়ে দেন।
ব্রিটিশ প্রেস অবশ্য মনে করে বিচার তো হয়ে গিয়েছে। মেসিকে নিয়ে গত কাল যেমন আর্জেন্তিনার বিখ্যাত সাংবাদিক সের্জিও লোভোনেস্কির নতুন বই বার হল। তেমনই বিশ্বকাপ নিয়ে ইংল্যান্ডের বাজারেও নতুন বই এসেছে। তাতে লেখা, ন্যায়বিচার তো হয়ে গিয়েছে। নতুন আবার কী পাবে? ছিয়াশিতে চুরি করে হাত দিয়ে গোল করেছিল। ভুল পেনাল্টিতে চার বছর পর তার বিচার হয়েছে। সাংবাদিক এবং ফুটবলার মিলে এমনই মারাদোনা বিদ্বেষ ইংরেজদের যে, পিটার শিলটন বলেছেন, সে দিন দ্বিতীয় গোল দেওয়ার সময় গোলদাতা নাকি মাত্র এক জন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে কাটিয়েছিলেন। মারাদোনার সেই দ্বিতীয় গোল বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা। ইউটিউব কেন, যে কোনও স্পোর্টস লাইব্রেরিতেই সযত্নরক্ষিত। যখন-তখন চেক করা যায়। শিলটন নিজে গোলটা খেয়েছিলেন। তাঁর মনে নেই যে অন্তত চার জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ওই গোলটা করা!
মেসিদেরও একটা ছোট বদলার ব্যাপার রয়েছে। চার বছর আগে কেপটাউনে বিস্বাদ হয়ে যাওয়া বিকেলটা সুদে-আসলে এখন অনেক বেড়েছে। কিন্তু রোববারের মারাকানা যুদ্ধের প্রতীকী হিসেবে চার বছরটা নিতান্ত কম সময়। এর নির্যাস অনেক গভীরে।
লিওনেল মেসি সম্ভবত জানেনও না যে, রোববার নব্বই মিনিটে তাঁর বাঁ পায়ের ঠিক ব্যবহারের ওপর ইতিহাসের কত ঝরা পাতারা সানন্দে চিরবিশ্রামে চলে যাবে। কত সবুজ পাতাই বা যে গজাবে!