ব্রিসবেন নদীতে পড়ে থাকল সাতষট্টি বছরের স্বপ্ন

গ্লেন ম্যাকগ্রার গলাই তো! ফেয়ারফ্যাক্স রেডিওর বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকার তিনি। ওয়েবের দুনিয়ায় তখন সবে www.cricket.com.au ঘোষণা করেছে ২-০। কী অসাধারণ অনুভূতি! ম্যাকগ্রা কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট পরিবারের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের সঙ্গে একমত না হয়ে অন্য কথা বলছিলেন। “আমি শুরু থেকে বলেছিলাম ৪-০ হবে। এখনও তাই বলছি।”

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

ব্রিসবেন শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩৬
Share:

কোহলি। ২-৭৬।

গ্লেন ম্যাকগ্রার গলাই তো!

Advertisement

ফেয়ারফ্যাক্স রেডিওর বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকার তিনি। ওয়েবের দুনিয়ায় তখন সবে www.cricket.com.au ঘোষণা করেছে ২-০। কী অসাধারণ অনুভূতি! ম্যাকগ্রা কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট পরিবারের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের সঙ্গে একমত না হয়ে অন্য কথা বলছিলেন। “আমি শুরু থেকে বলেছিলাম ৪-০ হবে। এখনও তাই বলছি।”

প্রত্যুত্তরে কিছু বলার নেই। অ্যাডিলেডের জেতা টেস্ট ৪৮ রানে রেখে আসার পর ব্রিসবেনে জেতা ম্যাচও ভারত হেরে বসল চার উইকেটে। বিষেণ বেদী টিমের কোচ হলে নির্ঘাত্‌ গোটা দলকে গাব্বার পাশে ব্রিসবেন নদীতে ছুড়ে ফেলতে চাইতেন। সেই নদীতে অবশ্য ক্রিকেটেরই কিছু ছুড়ে ফেলা হয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেটের মৃত স্বপ্নকে। যা সাতষট্টি বছরেও অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সিরিজ জিততে দেখল না!

Advertisement

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্ময় ভরা কিছু কথা বলে গেলেন। যার একটা “গত বারের মতো একপেশে হয়নি। তুলনায় আমরা অনেক ভাল খেলেছি।” মানে কী? গত বার অস্ট্রেলিয়া টিমে ছিলেন পন্টিং, হাসি, মাইকেল ক্লার্ক, পুরো ফিট জেমস প্যাটিনসন। এই যে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত প্রথম দিন চার উইকেটে তিনশোর ওপর করেও হারল, সেটা পুরো ফোঁপরা টিম। এক নম্বর ব্যাটসম্যান ক্লার্ক নেই। সবচেয়ে ভাল স্ট্রাইকরেট সম্পন্ন পেসার রায়ান হ্যারিস নেই। আগের বারের অজিরা যদি মাপকাঠি হয়, এটা ‘বি’ টিম!

অস্ট্রেলিয়া যখন মাত্র ১২৮ তাড়া করতে নামছে, উত্‌সাহব্যঞ্জক একটা টুইট চোখে পড়ল। চতুর্থ ইনিংসে ভারতের সঙ্গে এ দেশের মাঠেই মাত্র ১৪৩ তাড়া করতে গিয়ে ৮৩ অল আউট হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই টিমের ক্যাপ্টেন এ দিন গাব্বায় নেই। পরিবারের সঙ্গে বড়দিন কাটাতে কালকেই মেলবোর্নের প্লেন ধরেছেন। কিন্তু তাঁর, গ্রেগ চ্যাপেলের একাশির সেই বিশ্বদাপানো টিমকেই যদি একশোর কমে ফেলে দেওয়া যায়! এরা নয় কেন!

ইশান্ত শর্মা শুরু করলেনও ভাল। দুটো উইকেট ঝটাঝট ফেলে দিয়ে। কিন্তু আধুনিক ভারতীয় বোলিংয়ের সমস্যা হল, তার কপিল দেব তো নেই-ই। একটা দিলীপ দোশীও নেই যে ভাঙা পিচে যতক্ষণ উইকেট পাবে না, ততক্ষণ রানটাও বিলোবে না। কোহলি আবার একটা স্লিপ ক্যাচ ছাড়লেন। উমেশ যাদব অফস্টাম্পের বাইরে ক্রমাগত ড্রাইভযোগ্য বল জুগিয়ে গেলেন। শেষ দিকে মিনি সঙ্কট তৈরি হল ঠিকই ব্যাগি গ্রিন শিবিরে। কিন্তু এই ছোট পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করতে গেলে যা হয়, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

ছয় উইকেটের পর তাই আর ধস নামানো গেল না। ম্যাচের শেষ দিকটা চ্যানেল নাইন ভাষ্যকাররা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিলেন ভারতীয় মনোভাবের। এই লড়াইটা নাকি বাকি সিরিজে ভারতের ক্রেডিট ব্যালান্স হয়ে থাকল। শুনে চ্যানেল নাইনেরই একদা মালিকের মন্তব্য মনে পড়ে গেল গ্যালান্ট লুজার হল সেই ব্যক্তি যে বেশির ভাগ সময় হারে! প্যাকার ক্রিকেটে ঘটলে মালিক টিমকে নদীতে ফেলার হুমকি না দিয়ে হয়তো সোজা সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট ধরিয়ে দিতেন।

জেফ টমসনের ব্রিসবেনে খেলা শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ার অন্য মাঠের আধ ঘণ্টা আগে। দশটায়। তা সওয়া এগারোটা নাগাদ দেখা গেল ক্রিজে পূজারা-ধবন। ভারত তো এটাই চেয়েছিল যে, গত কালের অপরাজিত ব্যাটসম্যানেরা অন্তত এক ঘণ্টা পার করে দিক। আসল ছবি ঠিক উল্টো। ততক্ষণে ভারতের মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ে সেই আচমকা মড়ক যা গোটা সিরিজে তাদের সংক্রমণ হয়েছে।


রাহানে। ৩-৮৬।

অ্যাডিলেডে ২৪২-২ থেকে অল আউট ৩১৫ = ৭৩ রানে ৮ উইকেট।

৩৬৭-৪ থেকে অল আউট ৪৪৪ = ৭৭ রানে ৬ উইকেট।

ব্রিসবেনে ৩২১-৪ থেকে ৪০৮ = ৮৭ রানে ৬ উইকেট।

আজ ৭৬-১ থেকে ১১৭-৬ = ৪১ রানে ৫ উইকেট।

সকালে মিচেল জনসন একটা দুধর্র্র্ষ স্পেল করলেন। মাঝে এতটা গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে, ব্র্যাড হাডিনের সঙ্গে স্টাম্পের দূরত্বের চেয়ে কম দূরত্ব ছিল পেছনের সাইটস্ক্রিনের। তখন জনসনকে দেখাচ্ছে বাঁ-হাতি জেফ টমসন। একটা বল কিপারের মাথার ওপর দিয়ে বাই চার হয়ে গেল। এমনিতেই গাব্বা উইকেটের ওপরটা ফেটে গিয়েছিল। তার ওপর ওই গতি, যেটা স্পটে পড়ে উঠছে খেলার অবস্থায় থাকছে না। পরপর চারটে উইকেট এই সময় চলে গেল। মাত্র ২০ বলে। ভারতের কাহিনি তখনই শেষ!


রোহিত। ৪-৮৬।

দ্রুত অস্ট্রেলিয়ার রেডিও-টিভিতে বিশেষজ্ঞরা কালকের বলাটাই আরও উচ্চমার্গীয় করে দিলেন যে, মিচেল জনসনকে রাগাতে গিয়ে ভারত এই আত্মহত্যা করল। জনসনকে স্লেজ করাটা খুব বোকামি হয়েছে। তক্ষুনি প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার টুইট করলেন, ‘আমরা স্লেজ করলে সেটা হয় বোকামি। অস্ট্রেলিয়া স্লেজ করলে আবার সেটাই হয়ে যায় অ্যাগ্রেশন। আসল কারণ সেটা নয়। আসলে কাল জনসনকে আমরা খুব বাজে বল করেছি।’ টুইটকারীর নাম ভিভিএস লক্ষ্মণ।

তখন লক্ষ্মণ যে কত ঠিক, ভাবার সময় নেই। হঠাত্‌ ভারতীয় শিবির থেকে একটা মেল আর পিঠোপিঠি মিডিয়া ম্যানেজার ডক্টর আর এন বাবা প্রেসবক্সে এসে হাজির। সাধারণ ভাবে মিডিয়া ম্যানেজারদের কাজ হল প্রেসবক্স চত্বরে মিডিয়ার সঙ্গে থাকা। কিন্তু শ্রীনির আমলে এই সব পদ পলিটিক্যাল পোস্টিং। ডক্টর বাবাকে তাই প্রেসবক্সের ত্রিসীমানাতেও দেখা যায় না। এহেন তিনি রিলিজ হাতে নিয়ে আবির্ভূত। যা নজিরবিহীন। রিলিজের বক্তব্য: ভাল প্র্যাকটিস পিচ বারবার চেয়েও পাচ্ছে না ভারত। ক্ষয়ে যাওয়া পিচে অনুশীলন করতে হচ্ছে। যেখানে করার মতো অবস্থা নেই। আজ যেখানে দেওয়া হয়েছিল সেখানে শিখর ধবনের এমন লেগেছে যে, ব্যাট করতে যেতে পারেননি। তাঁকে এক্স-রে করাতে হবে। কোহলিরও লেগেছে। ভারত এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

রিলিজটা ঠিক খেলা শুরুর সময় এলে কী ভাবে দেখা হত জানি না। কিন্তু এমন সময় এল যখন রিলিজ পৌঁছনোর পক্ষে খুব খারাপ টাইম। পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছে। রোহিত আউট। ধোনি জঘন্য ভাবে আউট। পরিষ্কার মনে হচ্ছে ভারতের এই অনুশীলনে তাজা উইকেট চেয়ে না পাওয়াটা স্রেফ বাহানা। গাব্বা মাঠের পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরা হল একটু পরে: ভারত যে তাজা উইকেট চেয়েছে সেটা তৈরি হবে ২৩ ডিসেম্বর। তার আগে যে প্র্যাকটিস পিচে অস্ট্রেলিয়া খেলছে সেটাই তো ওদের দেওয়া হয়েছে।


ধোনি। ৫-৮৭।

শিখর ইতিমধ্যে নেমে পড়েছেন। যে রকম ব্যাট করছিলেন তিনি সকাল থেকে খেলতে পারলে ভারত হয়তো একটা ব্যাটিং ছন্দ তৈরি করতেও পারত। কিন্তু কোহলি কেমন গুটিয়ে থাকলেন। রোহিত শর্মা আবার প্রমাণ করলেন তিনি ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের যুগল হংসরাজ। প্রতিশ্রুতি প্রচুর, কিন্তু পাঁচ দিনের ম্যাচে আবার সেই প্রতিশ্রুতির কোনও ডেলিভারি নেই। রোহিতের এই ম্যাচে ছাপ রাখা বলতে অনর্থক মিচেল জনসনকে স্লেজ করা। অশ্বিন বরং দুই ইনিংসেই ভাল ব্যাট করলেন। তাঁকে ফিরিয়ে দিল আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত। যা কারণে-অকারণে বারবার ভারতের বিরুদ্ধে গেল।

শেষ দিকে পিচের ফাটলগুলো যেমন বেড়েছিল, চতুর্থ ইনিংসে কিছুতেই আড়াইশো পেরোত না অস্ট্রেলিয়া। গাব্বায় তাদের ছাব্বিশ বছর অপরাজিত রাজত্বের রেকর্ডটা ভেঙে তখন বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি জেতার কথা ভাবা যেত! এখন যা দাঁড়াল ২-২ করতে পারলে একমাত্র ওটা রেখে দেওয়া সম্ভব।

জেতা নয়। জেতার স্বপ্ন বললাম তো কোথায় পড়ে আছে!

ভারত প্রথম ইনিংস: ৪০৮

অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৫০৫

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৭১-১)

ধবন এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ৮১
পূজারা ক লিয়ঁ বো হ্যাজলউড ৪৩
কোহলি বো জনসন ১
রাহানে ক লিয়ঁ বো জনসন ১০
রোহিত ক হাডিন বো জনসন ০
ধোনি এলবিডব্লিউ হ্যাজলউড ০
অশ্বিন ক হাডিন বো স্টার্ক ১৯
উমেশ ক হাডিন বো জনসন ৩০
অ্যারন ক হ্যাজলউড বো লিয়ঁ ৩
ইশান্ত ন.আ. ১
অতিরিক্ত ৯,
মোট ২২৪।
পতন: ৪১, ৭১ (ধবন), ৭৬, ৮৬, ৮৬, ৮৭, ১১৭, ২০৩, ২১১।
বোলিং: জনসন ১৭.৩-৪-৬১-৪, হ্যাজলউড ১৬-০-৭৪-২, স্টার্ক ৮-১-২৭-২, ওয়াটসন ১৩-৬-২৭-০, লিয়ঁ ১০-১-৩৩-২।

অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস

রজার্স ক ধবন বো ইশান্ত ৫৫
ওয়ার্নার ক ধোনি বো ইশান্ত ৬
ওয়াটসন ক ধোনি বো ইশান্ত ০
স্মিথ রান আউট ২৮
শন মার্শ ক ধোনি বো উমেশ ১৭
হাডিন ক কোহলি বো উমেশ ১
মিচেল মার্শ ন.আ. ৬
জনসন ন.আ. ২
অতিরিক্ত ১৫
মোট ১৩০-৬।
পতন: ১৮, ২২, ৮৫, ১১৪, ১২২, ১২২।
বোলিং: ইশান্ত ৯-২-৩৮-৩, উমেশ ৯-০-৪৬-২, অ্যারন ৫.১-০-৩৮-০।

ভারতের ব্যাটিং মড়ক

অ্যাডিলেড

৩৬৭-৪ থেকে ৪৪৪ অল আউট

৭৭ রানে ৬ উইকেট

২৪২-২ থেকে ৩১৫ অল আউট

৭৩ রানে ৮ উইকেট

ব্রিসবেন

৩২১-৪ থেকে ৪০৮ অল আউট

৮৭ রানে ৬ উইকেট

৭৬-১ থেকে ১১৭-৬

৪১ রানে ৫ উইকেট

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement