লুই ফিলিপ স্কোলারি এই মুহূর্তে ব্রাজিলের ঘৃণ্যতম মানুষ!
সকাল থেকে ব্রাজিলের এফএম রেডিও এবং টিভি চ্যানেলগুলোয় জনতার যে মনের ভাব বেরিয়ে আসছে, তাতে স্বচ্ছন্দে মনে করা হচ্ছে জনমানসের ধিক্কার-তালিকায় এক নম্বর থাকা প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ-কেও পেছনে ফেলে দিয়েছেন ব্রাজিলীয় কোচ। আমজনতা তো বাদই দিচ্ছি, দেশের নামী শিল্পপতিরা পর্যন্ত তাঁকে ‘উদ্ধত’, ‘অসভ্য’, ‘গোঁয়ারগোবিন্দ’, ‘মর্কট’— নানান বিশেষণে ভরিয়ে দিচ্ছেন!
ব্রাজিলীয় মিডিয়াও খুব রেগে গিয়েছে। বুধবার সিনিয়র দু’তিন জন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তারা এ দিন সাও পাওলো মিডিয়া সেন্টারে থুত্থুড়ে এমন এক সাংবাদিককে হাজির করেছিল যিনি উনিশশো পঞ্চাশের ‘মারাকানাজো’ মাঠে বসে দেখেছেন। তিনি এ দিন মিডিয়াকে বলে দিলেন, “ওটা ছিল অসীম মহালজ্জা। আর কালকেরটা মহালজ্জারও মহালজ্জা।” ব্রাজিলীয়রা এত বছর বলে এসেছেন, তাঁরা জীবনে শোকাবহ ঘটনা বলতে বোঝেন তিনটে। হিরোশিমায় বোমাবর্ষণ। ৯/১১ হত্যালীলা। আর মারাকানাজো। অভিশপ্ত ১-৭ আপাতত তিন নম্বরে চলে এসেছে মারাকানাকে হঠিয়ে দিয়ে।
সকালে টোস্টাও ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে এবিপি-কে ফোনে বলছিলেন, “ইংরেজি কেন, পর্তুগিজেও এখন কথা বলার মতো মনের অবস্থা নেই।” শুনলাম একই কথা এ দিন বন্ধু সাংবাদিককে বলেছেন রোনাল্ডো। অন্য দিন স্টুডিও থেকে গ্লোবো টিভির কাজ করেন। মঙ্গলবার তা না করে মাঠে গিয়েছিলেন। সেখানে দুটো চরম অশান্তির ঘটনা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেন। ক্লোজের তাঁর এত বছরের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে দেওয়া। আর এগারো মিনিটে জার্মানির চার গোল। গ্যারি লিনেকারের মতোই রোনাল্ডো বলেছেন, “যত বছর খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছি, যত বছর খেলার কথা এর-তার মুখে শুনে বড় হয়েছি, এমন বিহ্বল করে দেওয়া কিছুর সাক্ষাৎ পাইনি। একটা সময় মনে হচ্ছিল টিভি প্রোগ্রামটাই বুঝি শেষ করতে পারব না।”
কাল খেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদে যখন এস্তাদিও মিনেইরো থেকে বেরোচ্ছি, নিরাপত্তা অফিসার এগিয়ে এলেন। বললেন, “কিছু সতর্কবাণী আছে। আপনারা যাঁরা সাভাসির দিককার হোটেলে যাচ্ছেন, সবাই প্রেস কার্ডটা খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিন। আর একটা কথা, বাস থেকে নেমে এমন ভাবে হাঁটাচলা করবেন না যাতে বিদেশি মনে হতে পারে। দামি সেলফোন থাকলে ওটাও ব্যাগের ভেতরে চালান করে দিন। আজ কিন্তু হাঙ্গামা হতে পারে। সাভাসিতে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে খবর আছে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের প্রেস শাটল সাভাসির মোড়ে থেমে যেতে বাধ্য হল। রাত দশটাতেও এত মানুষ সেখানে। প্রচুর বন্দুকধারী পুলিশ চার ধার ঘিরে দাঁড়িয়ে। কিছু পরে তারাও তেড়ে এল। কিন্তু কোনও রকম অশান্তি ঘটেনি। জনতা একটা সময় ফুটবল গুন্ডাদের মতো করছিল ঠিকই, ব্রাজিলীয় জার্সির পেছনে ৯ নম্বর লেখা কয়েক জনকে খুলিয়ে খালি গা করল। যেহেতু এটা সার্বজনীন চক্ষুশূল ফ্রেডের জার্সি। বেলোর ওই রকম অভিজাত রাজপথে গণপ্রস্রাব শুরু করে দিল। দু’এক জনকে দেখলাম হতাশায় নিজেদের মোবাইল ফোন ছুড়ে ভাঙছে। আতঙ্কে নিমেষে এলাকার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রিও-সাও পাওলোয় শুনলাম কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। তবে বেলোর যে জায়গাটায় ছিলাম সেখানে কিছু দেখলাম না। বরং অনেক রাত্তির অবধি মহল্লায় থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পানীয়তে ডুবে থাকল। হারের যন্ত্রণা ভুলল যেন মদের গ্লাস আর মৃদু বিলাপে।
আসলে এই টিমটা চ্যাম্পিয়ন না হতে পারে এমন একটা ধারণা ব্রাজিল দর্শকের মনে চিলি ম্যাচ থেকেই নির্মিয়মাণ! তা বলে এ রকম গণ অপদস্থ হতে হবে, কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এ দিন কিছু কিছু ব্রাজিলীয়কে বলতে শুনলাম, নেহাত সেকেন্ড হাফটা জার্মানরা আমাদের কৃপা করেছে বলে। চাইলে ওরা দশ গোল করতে পারত।
স্কোলারি কাল মাঝরাত্তিরেই টিম নিয়ে বেরিয়ে এ দিন সকালে তেরেসোপলিসের বেসক্যাম্পে পৌঁছে যান। সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা প্রচুর বাড়িয়ে এ দিন টিমকে মিনেইরো থেকে ফেরত পাঠানো হয়! সকালে ক্যাম্প পৌঁছে টিম অবশ্য আবিষ্কার করে, কোনও বিক্ষোভকারীর দেখা নেই। আঙুলে গোণা যায় এমন সংখ্যক সমর্থক দাঁড়িয়ে। আর তারা মেন গেটের ওপর দুটো পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়েছে। ‘লজ্জা’ আর একটায় ‘হাইস্কুলেও কেউ ২৯ মিনিটে পাঁচ গোল খায় না’। দাভিদ লুইজদের চোখে পোস্টারদুটো পড়ার আগেই ব্রাজিলীয় পুলিশ সেগুলো সরিয়ে ফেলে।
বিদেশি পর্যটকদের অনেকেরই চরম বিস্ময়কর ঠেকছে, যে ব্রাজিল সব কিছুতে এমন অগ্নিগর্ভ। ফুটবলের ব্যাপারে যারা সবচেয়ে ফুটন্ত। তারা ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের বৃহত্তম লজ্জার পরেও এমন স্তব্ধবাক কেন? খুচখাচ বাসে আগুন। মোবাইল ভাঙা। রাস্তায় প্রস্রাব। এগুলো ব্রাজিল ফুটবল সমর্থকের মাপকাঠিতে শিশু সাহিত্য। উরুগুয়ের কাছে ফাইনালে হেরে এর চেয়ে লক্ষগুণ বেশি হাঙ্গামা হয়েছিল।
দু’রকম ব্যাখ্যা পাওয়া গেল স্থানীয়দের মুখে! এক, কাল মনের দুঃখে লোকে এত রাত অবধি মদ খেয়েছে যে, জাগবে অনেক দেরি করে। হাঙ্গামা হলে বিকেল-সন্ধেয় হতে পারে। দুই, মানুষের উত্তেজিত হওয়ার মতো মনের অবস্থা নেই। তারা কাল যা দেখেছে, দেখে শকে মৌনপ্রায় হয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থা থেকে ফিরতে সময় লাগবে।
সাও পাওলো বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার সময় ট্যাক্সিতে দেখছিলাম, দাভিদ লুইজ টিভি ক্যামেরার সামনে ঝরঝর করে কাঁদছেন আর দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছেন। গ্যালারির তোলা একটা শট তার ঠিক সঙ্গেই দেখাচ্ছে। এক বৃদ্ধ, তাঁর হাতে মিনিয়েচার বিশ্বকাপ, স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে যেন পুত্রশোকে বিদ্যুৎপৃষ্ট! বৃদ্ধ বোধহয় মারাকানাজোর সময় কিশোর ছিলেন। ভেবেছিলেন মাঠ থেকেই সে লজ্জা মিটিয়ে নেওয়া যাবে। বাস্তবে ব্রাজিলের স্টেডিয়াম আরও বড় লজ্জায় ঠেলে দিল ব্রাজিলকে! দাভিদ লুইজ তাই কাঁদছেন আর বলছেন, দেশবাসী মার্জনা করুন। ক্ষমা চাইছি দলের তরফ থেকে।
থিয়াগো সিলভা এই বিপর্যয়ের মধ্যেও চোয়াল শক্ত করে বলেছেন, “জার্সিতে ওই ছ’নম্বর ক্রসটা যখন চাই বলেছি (ছ’বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারা) তখন আমার চাই-ই। পরের বিশ্বকাপেও ছাড়ব না। আবার লড়ব।” কিন্তু চারপাশে এমন বিষাদের আস্তরণ যে, কে দেখছে তাঁর চোয়াল শক্ত করা? টিমের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে কী ভাবে আর তৃতীয় স্থানের জন্য খেলি! যা হওয়ার সব তো পুড়েই গিয়েছে। মার্সেলো বলেছেন, “ব্রাজিল খেলে তো এক নম্বর হবে বলে। এই সম্মানহানির পর ওই ম্যাচটা আর কী দিতে পারে?”
মার্সেলো অবশ্য হিটলিস্টে এখন ওপরের দিকেই আছেন! তাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, অন্তত দুটো গোলের জন্য দায়ী। কখনও পজিশনে থাকছিলেন না। খেলা দেখে বোঝা যায়নি, লেফট ব্যাক না উইঙ্গার। দাভিদ লুইজ আর এক জন। তাঁর মুভমেন্ট চার্ট দেখাচ্ছে, গোটা ম্যাচে মাত্র তিনটে ট্যাকল আর একটা হেড করতে পেরেছেন। গতকাল খেলা দেখতে মাঠে এসেছিলেন মিক জ্যাগার। রোলিং স্টোন-খ্যাত গায়ক এ দিন দাভিদ লুইজকে পাঠানো বার্তায় বলেছেন, “তুমি ব্রাজিলের বেস্ট প্লেয়ার। একটা ম্যাচ তোমাদের সবার খুব খারাপ গিয়েছে। তোমারও গিয়েছে। তাতে মাথা হেঁট কোরো না।” চেলসিতে লুইজের কোচ মোরিনহোর কলামেও একই কথা: গোটা ব্রাজিল টিম স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। একা দাভিদ কেন বিপর্যয়ের সুদ গুনবে?
মোরিনহোর মনে হচ্ছে, ব্রাজিল ডুবেছে খেলার চেয়ে বেশি স্পিরিট নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে। ব্রাজিলীয় মিডিয়ারও তাই মত যে, “শুরু থেকে আমরা বলে আসছি টিমের কম্বিনেশন তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু স্কোলারি তাতে উল্টে আমাদের প্রকাশ্যে গাল পেড়েছেন। ক্যাম্পেও কখনও দেখিনি একটা দারুণ মুভমেন্ট শেখানো হচ্ছে। পুরোটাই সুখী পরিবার তৈরি করে এগনো। তাতে কি বিশ্বকাপ জেতা যায় নাকি?”
সুখী পরিবারের দুই মুখ পওলিনহো আর দানি আলভেজ আবার দল নীতির বিরুদ্ধে সরকারি ভাবে যুদ্ধই ঘোষণা করে দিয়েছেন এ দিন। আলভেজ বলেছেন, স্পিরিট দিয়ে খেলার দিন শেষ। এ বার আমাদের ধরন বদলাতে হবে। কোস্টারিকাকে কেন আমরা দেখছি না? বা কলম্বিয়াকে? পওলিনহো বলেছেন, স্ট্র্যাটেজি অন্য ভাবেও করা যায়। কিন্তু যেটা করে দেওয়া হয়েছে, ফুটবলাররা সেই অনুযায়ী চলতে বাধ্য।
ব্রাজিল ফুটবলাররা অপমানজনক কত কিছু গত চব্বিশ ঘণ্টায় শুনেই চলেছেন। ব্রাজিল যখন আট মিনিটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন রিওর টিভি স্টুডিও ক্যামেরার সামনে নাকি গান গাইছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। সেই গানটা যা আর্জেন্টাইন সমর্থক পেলের দেশকে বিদ্রুপ করে গায়। সাত গোলের যে ছবি ইউটিউব মারফত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, তা জার্মানির একটা পর্ন সাইট বলেছে, ওটা প্লিজ আমাদের সাইটে আপলোড কোরো না। কারণ ওটা পর্ন নয়, নগ্নতারও নগ্নতা!
কাল রাতে পরপর দুই কোচের সাংবাদিক সম্মেলনে বসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। স্কোলারি বললেন ১-৭ হারের ঝলসানো ভুলে গিয়ে পরের ম্যাচটা খেলতে হবে। আবার জোয়াকিম লো-ও তো তাই বললেন, ৭-১ ছেলেদের ভুলে যেতে হবে। নইলে ফাইনাল খেলবে কী করে?
জার্মানি শতাব্দীর সেরা ফুটবল থাপ্পড় মেরে আবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সেই গৌরবের বাইরে যেতে চাইছে। এটাই তো ব্রাজিল ফুটবল সভ্যতায় সবচেয়ে বড় আক্রমণ!
এই মুহূর্তে অবশ্য কারও ভাবার মতো আছে বলে মনে হচ্ছে না। ব্রাজিলের জাতীয় পতাকা শোকে অর্ধনমিত নয়। মঙ্গলবার সন্ধে থেকে মানুষের মনে আর ওঠেনি।
এই গণ বিষণ্ণতা আর মৌনপালনে বিশ্বকাপেরও যেন প্রতিমা নিরঞ্জন হয়ে গেল। সাও পাওলো এত কর্মব্যস্ত বিশ্বকাপ ঘাঁটি। মাত্র ছাব্বিশ দিন আগে এখানেই তো বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেছিল ব্রাজিল। কোথায় গেল সেই গৌরবর্ণ হলুদ! আর তার তেজ।
কেমন মনে হচ্ছে মেসি থাকুন বা দাভিদ লুইজদের রাস্তায় যান, বাকি বিশ্বকাপ স্রেফ অটোপাইলট মোডে চলবে। প্রতিমাই তো নিরঞ্জন হয়ে গিয়েছে তার। চোখের সামনে যেটা পড়ে আছে সেটা মণ্ডপসজ্জা।
দেহটা আছে, প্রাণটা বেরিয়ে গিয়েছে ব্রাজিলের দুই গোলপোস্টের মধ্যে দিয়ে!