ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল পাঁচটার আশেপাশে। সবে সোহেল খানের ক্যাচটা উমেশ যাদব তালুবন্দি করেছেন, নয়াদিল্লির হরেক মহল্লা, রাস্তাঘাটের মতো স্টুডিও পাড়ায় বেশ ক’জন সেলিব্রিটিও মহানন্দে মুখর।
এঁরা সবাই প্রাক্তন ক্রিকেটার। কেউ ওয়াঘার এ-পারের, তো কেউ ওয়াঘার ও-পারের। মজার ব্যাপার, ডনের শহরে ভারত বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়েছে তো কী, এখানে রাজধানীতে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর প্রাক্তনরা যেন একটাই টিম! যার নাম এক্সপার্ট প্যানেল। আর সেখানে বিষেণ সিংহ বেদী থেকে ইমরান খান, সচিন তেন্ডুলকর থেকে ওয়াসিম আক্রম, কপিল দেব থেকে শোয়েব আখতার, কীর্তি আজাদ থেকে সিকন্দর বখত, মনোজ প্রভাকর-আজহারউদ্দিন-হরভজন, ইনজামাম-আমির সোহেল-মদনলাল সব্বাই যেন সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে রেখে একযোগে একটা টিমকেই কুর্নিশ করলেন। একজন ক্যাপ্টেনেরই গুনগান গাইলেন।
যে টিমের নাম ভারত। যে ক্যাপ্টেনের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
উপমহাদেশের ক্রিকেটপাগল দুই প্রতিবেশী দেশের কোনও কোনও প্রাক্তন প্লেয়ার আজ যদি স্বয়ং দিল্লির কোনও নিউজ স্টুডিওতে বসা তো, কেউ কেউ আবার অন্য শহর এমনকী সীমান্তের ও-পার থেকেও ক্রমাগত ফোন-ইনে টিম ইন্ডিয়ার লাগাতার প্রশস্তি করে গেলেন।
অত সাতসকালেও এবিপি নিউজ-এর স্টুডিওয় ঢুকে আবিষ্কার করলাম বেদী আর প্রভাকরকে। তখনই দু’জন বলে দিয়েছিলেন, কোনও সন্দেহ নেই আজ ভারত-ই ফেভারিট। বেদী আবার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে যোগ করেছিলেন, “এত সকালে স্টুডিওয় ঢুকতে হবে বলে রাতে প্রায় জেগেই ছিলাম এই বুড়ো বয়সেও। তবে সবার আগে আমাদের ধোনিকে টসটা জিততে হবে।”
এবং ঠিক সেটাই হল। আর বিকেলের দিকে বিশ্বকাপে ভারতের হাফ ডজন পাক-বধ সাঙ্গ হতেই একঝাঁক এক্সপার্টের মধ্যে সবার আগে কপিলের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন টিম ধোনিকে। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এ দেশের দ্বিতীয় বার কাপজয়ী ক্যাপ্টেনের ভূয়সী প্রশংসা করলেন আজও। “অভিনন্দন ধোনি। তুমি আমাদের সকলকে আরও একবার চমকে দিলে টেনশনের ম্যাচে পাকিস্তানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে। ইদানীং তুমি যখন হারছিলে আমজনতার সঙ্গে আমরা মানে এক্সপার্টরাও তোমাকে এক রকম ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে উদ্যোগী হয়ে বিরাট কোহলির জয়-গান শুরু করে দিয়েছিলাম। তুমি সবার মুখ মাটিতে ঘষে দিয়ে প্রমাণ করে দিলে তুমিই আমাদের বিশ্বসেরা অধিনায়ক। তাই আর একবার তোমাকে কুর্নিশ জানাই।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কপিলের ‘কিউ’ নিয়ে বেদী বলে দিলেন,“দারুণ বলেছ কপিল। সত্যিই তো, আমরা কেউ ভাবিনি অস্ট্রেলিয়ায় হারতে হারতে হতমান ধোনির দল হঠাত্ই এ রকম ভেলকি দেখাবে। লাগাতার ছয় বার ভারতের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর কৃতিত্ব গড়ল ধোনির টিম। তাই ধোনি আর ম্যান অব দ্য ম্যাচ কোহলিকে আমার সেলাম।”
ততক্ষণে সচিনের ফোন-ইন এসে গিয়েছে স্টুডিওতে। “কনগ্র্যাচুলেশনস্ টু ধোনি অ্যান্ড হিজ অল ফোরটিন ফাইটার।” কীর্তি আজাদ তখন দিল্লিতে বসে বলছিলেন, “পাকিস্তানের এক্সপার্টদের জানিয়ে দিতে চাই, তেন্ডুলকরের জায়গায় আমরা নতুন তেন্ডুলকর কিন্তু পেয়ে গিয়েছি। আজকের বিরাট কোহলিকে দেখার পর নিশ্চয়ই সেটা সবাই স্বীকার করবেন।”
তিরাশির কাপজয়ী ভারতীয় অলরাউন্ডার আজাদের খোঁচাটা যাঁদের উদ্দেশে সেই আমির সোহেল, সিকন্দর বখত, শোয়েব আখতাররা অবশ্য সটান স্বীকার করে গেলেন সেটা। তিন প্রাক্তন পাক ক্রিকেটারের সম্মিলিত মন্তব্য “ধোনি সত্যিই বিশ্বের সবচেয়ে তেজিয়ান ক্রিকেট অধিনায়ক। যে তেজটাই ওকে বারবার বড় ম্যাচে জেতায়। ওর প্রতিপক্ষ দেশের ক্রিকেটার হয়েও আমরা ওর ভক্ত হয়ে গিয়েছি। ওর সঙ্গে এর পর দেখা হলে ওকে সামনাসামনি কথাটা বলব। কোন অর্বাচীন বলে ধোনি-ভেলকি শেষ হয়ে গিয়েছে? ধোনিই বিশ্বের সেরা ক্যাপ্টেন। আমাদের ক্যাপ্টেন মিসবা আজ ৭৬ রান করেছে বটে, কিন্তু কাপ্তানিটা যেন ধোনির থেকে শিখে নেয় ও!” আক্রম তো সরাসরি ধোনির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন। বলছিলেন, “আমি নিজেই ধোনির কাছে ক্ষমা চাইছি। বুঝে উঠতে পারিনি আজকেও ও বাঘ হয়ে উঠবে। ধোনির ক্যাপ্টেন্সি আর বিরাটের ব্যাটিংয়ের জন্য ওদের টুপি খুলে সেলাম জানাচ্ছি।”
অ্যাডিলেডে যতই ক্রিকেটের ইতিহাসে দুই সর্ববৃহত্ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর উপস্থিতি থাক আজ, দিল্লিতে তাদের প্রাক্তনরা কিন্তু ধোনি-কোহলিকে সেলাম জানাতে যেন একটাই টিম!
ছবি: পিটিআই, টুইটার