দশ দিনে পৃথিবী বদলে ধোনির সংসারে এখন ‘মওজা হি মওজা’

মাঝরাত গড়িয়ে একটা বাজব-বাজব করছে। অথচ টিম হোটেলে এত গান, বাজনা, চিৎকার-চেঁচামেচি কীসের? এক বার মনে হল ভারতের কোনও উদার এবং উদ্দীপ্ত সমর্থক অস্ট্রেলিয়া-বিজয়ে পার্টি-ফার্টি দেয়নি তো? দ্রুতই আবিষ্কার করা গেল, বিষয়টা অন্য। গান ভেসে আসছে দোতলার বার থেকে। স্টেজের ওপর বাংলাদেশী বার ডান্সাররা। আর তারস্বরে ‘জব উই মেট’-এর গান বাজছে— মওজা হি মওজা।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

ঢাকা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৬
Share:

মাঝরাত গড়িয়ে একটা বাজব-বাজব করছে। অথচ টিম হোটেলে এত গান, বাজনা, চিৎকার-চেঁচামেচি কীসের? এক বার মনে হল ভারতের কোনও উদার এবং উদ্দীপ্ত সমর্থক অস্ট্রেলিয়া-বিজয়ে পার্টি-ফার্টি দেয়নি তো?

Advertisement

দ্রুতই আবিষ্কার করা গেল, বিষয়টা অন্য। গান ভেসে আসছে দোতলার বার থেকে। স্টেজের ওপর বাংলাদেশী বার ডান্সাররা। আর তারস্বরে ‘জব উই মেট’-এর গান বাজছে— মওজা হি মওজা।

প্লেয়াররা নেই। এমনিতেও একটু আগে ধোনির টিম ফিরেছে মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে। ভারত সমর্থক অনেককে অবশ্য দেখা গেল নাচছেন, গাইছেন। সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য ভারতের হয়তো এই ম্যাচ জেতাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার নাক রগড়ে দিয়ে তাদের ৮৬ অল আউট করে দেওয়া কি রোজ রোজ হয় নাকি? স্টার স্পোর্টসের লোকজনও তুফানি মজার সেই মেহফিলে। তাদেরই মধ্যে একটা বার স্টুলের ওপর বসে রয়েছেন রবি শাস্ত্রী।

Advertisement

ওই আওয়াজের মধ্যে কারও কথা শোনার সুযোগ নেই। গানটা থামতেই শাস্ত্রী বললেন, “এ বার ফ্লেচারকে নিয়ে কী করবেন? আচ্ছা এখন কী ভাবছেন বলুন, ও ভাল কোচ না খারাপ?” বলতে বলতেই পরের আইটেম নম্বরটা শুরু হয়ে গেল।

আনন্দবাজারের খেলার পাতার পাঠকেরা জানেন, ফ্লেচার হঠাও অভিযানে শাস্ত্রীর কখনও সায় ছিল না। তাঁর মত বরাবরই হল যে, বদল যদি করতে হয়— বিশ্বকাপের পরে! আইটেম নম্বরের ওই খুশিয়াল মেহফিলেই তাঁর কাটা-কাটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল— “যারা বদল চাইছে তাদের ওর পদটা নিতে বলুন। হ্যাঁ, গাওস্কর ব্যাটিং কোচ হোক। কপিল হোক বোলিং কোচ। আর সৌরভ টিম ম্যানেজার। তখন ফ্লেচারকে আমি কমেন্ট্রি বক্সে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলব, এদের এ বার নম্বর দাও। দশে কাকে কত দেবে বলো?”

সোমবার সকালে ভারতীয় কোচের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। কথা হওয়ার প্রশ্ন নেই। তিনি বিশ্বের প্রথম কোচ যিনি কালেভদ্রে টিমের হয়ে প্রেস কনফারেন্সে আসেন। আর তার বাইরে যে দেশকে কোচ করছেন, তার মিডিয়ার সঙ্গে হাই-হ্যালো করতেও অসম্মত। তা ফ্লেচারের শরীরী ভাষা কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর সময় যেমন কুঁকড়ে থাকা ছিল, তার চেয়ে অনেক উজ্জীবিত দেখাচ্ছে। টিম ইন্ডিয়ার টানা ব্যর্থতা তাঁকে একটা গারদে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেখান থেকে একটা মুক্তির জানালা খুলে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যেমন হয়েছিল!

ভারতীয় ক্রিকেটের চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী প্রশাসনিক গৃহযুদ্ধের সময় টিমের দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স যেন মূর্তিমান কন্ট্র্যাডিকশন। ধোনির টিমের একটা বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছিল যুবরাজ সিংহের অফ ফর্ম। রোববার-উত্তর সেটাও দূরবর্তী পদ্মার জলে।

শুনছিলাম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাকিস্তানের প্রথম সেঞ্চুরিকারী ব্যাটসম্যান আহমেদ শেহজাদ ম্যাচের আগে যুবিকে উদ্দীপ্ত করেন। শেহজাদ তার আগে সদ্য বাংলাদেশ ম্যাচে ৬২ বলে ১১১ রানের ওই ইনিংসটা খেলে উঠেছেন। তিনি নাকি যুবিকে গিয়ে বলেন, “আপনি আমার মতো অনেকের কাছে আইডল। এত ঠুকে-ঠুকে খেলছেন কেন? বোলাররা আপনাকে ভয় পায়। চালিয়ে খেলুন। আমি আপনার খেলা দেখার জন্য মাঠে ওয়েট করে যাব।” এ দিন রাতে শেহজাদ টুইটও করেন যুবির উদ্দেশ্যে। আর আনন্দবাজারের কাছে স্বীকার করেন যুবরাজকে উদ্দীপ্ত করার কথা। পাক-ভারত ক্রিকেট সম্প্রীতির একটা বড় নমুনা হিসেবে দৃষ্টান্তটা থেকে গেল। অতশত মনে হয় না তাঁর মাথায় ছিল বলে। বললেন, “যুবিকে আমি খুব সম্মান করি।”


আইডলের সঙ্গে। যুবরাজকে নিয়ে শেহজাদ (ডান দিকে)। ছবি টুইটার

শেহজাদের পাকিস্তান এখনও সেমিফাইনালেই যায়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে তাদের মঙ্গলবারের ম্যাচ কার্যত কোয়ার্টার ফাইনাল। কিন্তু মিরপুরে বল যেমন ঘুরছে, তার বিচারে অনেকেই টি-টোয়েন্টিতে কাগজেকলমে প্রচণ্ড শক্তিশালী আর কারেন্ট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গেইলদের বিদায়-আশঙ্কা দেখছেন। সৌরভ যেমন উপমহাদেশীয় দলকে এই সারফেসে এগিয়ে রাখছেন। সেমিফাইনালে ডেল স্টেইনের দক্ষিণ আফ্রিকা বিরুদ্ধে পড়াতেও মনে করেন ভারতের অসুবিধে হবে না।

“বল যেমন ঘুরছে— আমাদের স্পিনারদের আটকাতে পারবে না,” সোমবার ঢাকায় কলকাতার চিকিৎসক ডক্টর মনোজ খন্নার স্কিন ক্লিনিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার ফাঁকে গাড়িতে বললেন সৌরভ। আর এই বল ঘোরাকে কেন্দ্র করে যেখানে ফাইনালে ভারত-পাক সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হচ্ছে, সেখানে খোদ আয়োজক দেশ রাগে ফুঁসছে। প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত হতাশ করে বিদায় নেওয়ার পর বাংলাদেশ ক্রিকেটমহলের সেন্টিমেন্ট হল, মিরপুর মাঠে মোটেও আদর্শ টি-টোয়েন্টি উইকেট বানানো হয়নি। টি-টোয়েন্টি পিচ অনেক বেশি ব্যাটসম্যান উপযোগী হবে যেখানে অতীতে বাংলাদেশী স্ট্রোক প্লেয়াররা ভাল খেলে টিমকে টেনেছেন। এ বার সেটা দেওয়া হল কোথায়? ভারত বরঞ্চ প্রতিটা ম্যাচ মিরপুরে খেলে অন্যায় সুবিধা ভোগ করে গেল।

বাংলাদেশ এমন ভয়ঙ্কর গ্রুপ অব ডেথ থেকে সেমিফাইনাল যাবে, সেই আস্থা দেশবাসীর বিশেষ ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী-সহ গোটা দেশ যখন আবেগের উথালপাথাল ঢেউ তুলে তাদের সঙ্গে, তখন এমন নীরব আত্মসমর্পণ করবে সেটাও কেউ ভাবেনি। এখনও ঢাকার রাজপথে শোভা পাচ্ছে বিশাল সব হোর্ডিং যেখানে হাসিনা বলছেন, ‘তোমাদের চোখে স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ।’ তারকা ক্রিকেটাররা ইদানীং কালে বাংলাদেশের জাতীয় বীর। পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। দেশের ফুটবল ক্যাপ্টেন মামুনুল রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ চিনবে না। কিন্তু সাকিব বা তামিম ভাবতেই পারেন না, রমনা পার্কের সামনে দিয়ে হাঁটবেন কী ধানমন্ডিতে দাঁড়িয়ে মিষ্টি কিনতে ঢুকবেন।

মাসখানেক আগে সাকিবের ডেঙ্গি হয়েছিল। তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দেখতে হাসপাতালে চলে যান। এমনই স্টেটাস ক্রিকেটারদের যে, হাসিনার ব্যক্তিগত নম্বরও এঁদের অনেকের কাছে রয়েছে।

সেই অধিষ্ঠান থেকে এমন বিপর্যয় জাতিকে প্রথমে বেদনা, তার পর ক্রোধে ভাসিয়ে দিয়েছে। শোনা গেল বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে স্বয়ং হাসিনাও খুব আশাহত। বাংলাদেশের কয়েকটা কাগজের এ দিনকার বিষাদ ভরা হেডিং পরপর তুলে দিলাম:

আরও দীর্ঘ পরাজয়ের মালা।

বাংলাদেশ লজ্জার শেষ কোথায়।

হারের মিছিলে বাংলাদেশ।

টাইগার্স নো ডিফারেন্ট।

আর একটা দৈনিক প্রথম পাতায় শিরোনাম দিয়েছে, ‘জয় তুমি কী, খুব জানতে ইচ্ছে করে।’ একই টিম হোটেলে একটা টিমের জন্য বাজছে ‘মওজা হি মওজা’। আর একটা টিমের জন্য এই মুহূর্তে কোন গানটা সবচেয়ে উপযুক্ত, ভেবে পাচ্ছি না।

এখানকার বিশিষ্ট ক্রিকেট লিখিয়ে ও বুদ্ধিজীবী জালাল আহমেদ চৌধুরী এক সময় বাংলাদেশ টিমের কোচ ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ অনুরাগী তাঁর একটাই গান মনে পড়ছে— ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো।’ আবার বিশিষ্ট সাহিত্যিক অনিসুল হক নাকি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা...’ অর্থাৎ কারও যখন টিমের ওপর চূড়ান্ত অনাস্থা। কেউ কেউ সেখানেই বিশ্বাস রাখার অঙ্গীকার করছেন।

কে বলবে, ধোনির সংসারে কিছু দিন আগে এই সবই ঘটছিল। মাত্র দশ দিনে পৃথিবী বদলে যেতে পারে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা থেকে মওজা হি মওজায়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement