দলকে ফাইনালে তোলার পথে রোমেরো। সাও পাওলোর এরিনা করিন্থিয়ান্সে। ছবি: উৎপল সরকার।
আর্জেন্তিনা ০ (৪)
নেদারল্যান্ডস ০ (২)
কে জানত একশো কুড়ি মিনিটের পর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের চূড়ান্ত নায়ক হয়ে দেখা দেবেন সের্জিও রোমেরো! আর্জেন্তিনা গোলকিপার বিশ্বকাপের ভরা গোলকিপারদের বাজারে কোনও কলকেই পাননি। কিন্তু তাঁর টাইব্রেকারে অব্যর্থ দুটো গোল বাঁচানোই লিওনেল মেসিকে তুলে দিল বিশ্বকাপ স্বপ্নের শেষ সিঁড়িতে।
মেসি থেকে শুরু করে আর্জেন্তিনার চার জন কিকার গোল করলেন। কমলা জার্সির সেখানে দুটো পেনাল্টি চারটেয় নষ্ট। নেদারল্যান্ডস কোচ আগের ম্যাচে শেষ মুহূর্তে টিম ক্রুলকে পেনাল্টির জন্য নামিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। আজব লাগল ম্যাচ পেনাল্টিতে যেতে পারে জেনেও তিনি তিনটে বদলি আগেই কেন করে নিলেন? ব্রাজিলীয় ডিফেন্সের বেলো কেলেঙ্কারির মতোই ফান গলের কোচিং জীবনে এই প্রশ্নটা এ বার সঙ্গে ঘুরবে।
তার ঘণ্টাখানেক আগের ছবি। হেড করতে ওঠা এক আর্জেন্তিনীয় যখন চোট পেয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। মাঠে উদ্বেগের ছায়া নীল-সাদা জার্সির মধ্যে। স্ট্রেচার আনা হয়ে গিয়েছে। তখন মনে হল আর্জেন্তিনার এই এতক্ষণের উদিত সম্ভাবনাটা সাও পাওলোর কংক্রিটওয়ালা বাড়িগুলোর তলায় চাপা পড়ে গেল! তাঁর পদবির আদ্যক্ষর ‘এম’ এবং তিনি ছাড়া আজকের আর্জেন্তিনাকে রক্ষা করবে কে?
এম-এ মেসি! একদম নয়! এম-এ মাসচেরানো! আর্জেন্তিনাকে প্রথম মিনিট থেকেই দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কাল এস্তাদিও মিনেইরোর ব্রাজিলের দেখা ভয়ঙ্কর ভূতের ছবিটা একেবারেই দেখতে চায় না। আর সেই লাতিন আমেরিকান প্রকল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যে সামনের চুল পাতলা হয়ে যাওয়া জাভিয়ের মাসচেরানো।
খেলা শুরুর ঘণ্টা দুই আগে থেকে হঠাৎ বৃষ্টি। নটিংহামে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আজ ব্যাট করার সময় এই পরিবেশ আশা করতে পারতেন। কিন্তু ব্রাজিলে দুম করে ইংলিশ আবহাওয়া, ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর তাপমাত্রা কমে যাওয়া তো আচমকাই হয়! আজও কি তা হলে আচমকা কিছু ঘটতে যাচ্ছে?
আরও বেশি করে কি তা হলে খেলা শুরুর আগেই অ্যাডভান্টেজ কমলা-জার্সি? রবার্তো কার্লোসকে জিজ্ঞেস করায় তিনি দু’হাত নেড়ে এমন ভঙ্গি করলেন যেন আমার দেশ নেই। আমি আর কোনও কিছু নিয়ে ভাবছি না। ঠিক ছাব্বিশ দিন আগে এই এরিনা দি সাও পাওলোয় পৃথিবীতে হলুদের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত দেখেছি। খোলা আর ঢালু গ্যালারির ওপর থেকে নীচ অবধি ব্রাজিলের উদ্বোধনী ম্যাচ দেখতে হলুদ জার্সি। খেলা শুরুর আগে দি’স্তেফানোর জন্য নীরবতা পালন হলে কী হবে, মনে হচ্ছে ১-৭-এর জন্যই মৌনপালন হচ্ছে।
মেসিকে আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা ডাচদের।
সাও পাওলোর এরিনা করিন্থিয়ান্সে। ছবি: উৎপল সরকার।
আর্জেন্তিনা তো কোনও ঝুঁকিই নিতে চাইছে না রক্ষণ নিয়ে। দুই স্টপারের সামনে মাসচেরানোকে রাখাই শুধু নয়, ক্রমাগত তাদের ফরোয়ার্ড নীচে নামছে। এমনকী মেসিও। রবেনরা যে আগুনে গতিতে স্পেনকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই ফাঁকা জায়গাটায় তাঁদের দিচ্ছিল না মেসির টিম! যত পারছে বল নিজেদের মধ্যে রেখে দিচ্ছে। বল নিয়ে বিপক্ষ ঘোরার আগেই কড়া ট্যাকল করছে।
সাবেয়ার এই আর্জেন্তিনাকে প্রথমার্ধে দেখে তখন মনেই হচ্ছে না যে বেলোয় কালকের রাতের পর তারা আরও আন্ডারডগ বনে গিয়েছে। টুর্নামেন্টে তখনও তাদের সেরা ম্যাচটা খেলছে এবং মেসি মোটেও একক হয়ে ফুটছেন না। বরং মনে হচ্ছে তিনি বেশ চাপের মধ্যে। দু’জনকে কাটিয়ে তিন নম্বর লোকের কাছে আটকে যাচ্ছেন। ফ্রিকিক বা কর্নারে মেসিচিত ধার নেই।
রবেন, স্নাইডার আর ফান পার্সিরা চলতি বিশ্বকাপের সবচেয়ে তেজিয়ান ফরোয়ার্ড লাইন। জার্মানদেরও আগে। এতক্ষণ তাঁদের বলই ধরতে দিচ্ছিলেন না মাসচেরানোরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি থেকে ডাচরা প্রতি-আক্রমণে উঠতে শুরু করল। ফান পার্সি দুর্দান্ত একটা ব্যাকভলিও মেরেছিলেন। অল্পের জন্য সেটা বারের ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
মাঠে হাজির তেষট্টি হাজার দর্শক। বাংলা কথা, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে সাত হাজার টিকিটে লোক আসেনি, অথচ ম্যাচ হিসেবে বেলো সেমিফাইনালের চেয়ে অনেক উচ্চাঙ্গের, অনেক ট্যাকটিক্যাল। মডার্ন বিশ্ব ফুটবলে গতি এসে জমির হাহাকার কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তার প্রকৃষ্ট নমুনা বুধবারের এরিয়া সাও পাওলো!
শেষরক্ষার স্বস্তি। ছবি: এএফপি।
আর্জেন্তিনা যখন তুমুল আক্রমণ চালিয়েও গোল পাচ্ছে না এবং তাদের বক্সে ডাচ আগ্রাসন শুরু হয়ে গিয়েছে, গয়কোচিয়ার কথা মনে পড়ছিল। আর্জেন্তিনা গোটা টুর্নামেন্টে কখনও আগে গোল খায়নি। ওরা আগে গোল খেলে কী হবে!
শেষ মিনিটে রবেন ছ’গজে ঢুকে পড়ে অব্যর্থ গোল করতে যাচ্ছেন। স্লাইডিংয়ে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন সেই মাসচেরানো। তাঁকে দেখে তখন মনে হচ্ছে জার্মানির হয়ে পুরনো সোয়াইনস্টাইগার। ওই স্লাইডিং ট্যাকলটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট না অতিরিক্ত সময় অন্য কিছু বলবে, তখন গভীর সাসপেন্সের মধ্যে!
ম্যাচ শেষে মেসিরা যখন ড্রেসিংরুমে ঢুকে গিয়েছেন, রোমেরোকে দেখলাম একা একা মাঠে দাঁড়িয়ে সমর্থকদের অভিনন্দন কুড়োচ্ছেন। আজ আসলে আন্ডারডগদের দিন। মেসি বা রবেনের মতো মহানায়কদের নয়!