হতাশার দুই মুখ। শুক্রবার ইডেনে লক্ষ্মীরতন শুক্ল ও অশোক দিন্দা।
ক্রিকেটবিশ্বের সর্বকালের অন্যতম দুঁদে অধিনায়ক রিচি বেনোর নাকি অদ্ভুত একটা স্বভাব ছিল। শোনা যায় তিনি যে টেস্ট সেন্টারে ম্যাচ খেলতে যেতেন, সর্বপ্রথম পিচ কিউরেটরের হাতে পাঁচ ডলার গুঁজে দিতেন! পঞ্চাশের দশকে যার মূল্য খুব কম ছিল না।
বেনোর এমন আশ্চর্য আচরণের কারণ অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তি অধিনায়ক বিশ্বাস করতেন, পিচ বোঝে শুধু কিউরেটর। সে-ই শুধু তিন মাস ধরে উইকেট নিয়ে খাটাখাটনি করে। ক্যাপ্টেন সেখানে শুধু আন্দাজ করতে পারে মাত্র!
লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র সঙ্গে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটার কথোপকথন কী হয়েছিল, সম্পূর্ণ জানার উপায় নেই। শোনা গিয়েছে বঙ্গ ‘মস্তিষ্ক’ থেকে ইডেন কিউরেটরের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ গিয়েছিল— আপনি ঘাসটা উড়িয়ে দিন! তাতে টস নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। ফ্লাডলাইটের ইডেনে যদি ব্যাট করতে নামতে হয়, তা হলে মারণ-মুভমেন্টের খপ্পরে পড়তে হবে না।
কিন্তু লক্ষ্মী বা অশোক— কেউ কি প্রবীরবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঘাস ওড়ানোয় পিচটা কী দাঁড়াবে? বেনোর উদাহরণ ছেড়ে দিন। অতীতে বাংলার হয়ে যুদ্ধে নামার আগে ময়দানের বিখ্যাত বংশী মালিকে গিয়ে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা জিজ্ঞেস করে আসতেন, ‘স্পিন হবে, না সুইং?’ বংশী মালি নির্লিপ্ত মুখে ‘স্প্রিং’ (অপভ্রংশ) বা ‘সুইং’-এর মধ্যে একটা বলে দিতেন। পিচের মন বোঝার যে ক্ষমতা নিশ্চয়ই প্রবীরবাবুরও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বৃহস্পতিবার তাঁকে কি টিম বাংলা থেকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, ঘাস ওড়ানোয় শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে কি না? বা কী কম্বিনেশনে গেলে ভাল হয়?
ঘোরতর সন্দেহ আছে। বঙ্গ অধিনায়ক গত রাত পর্যন্ত নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না, পিচ কী করবে। জানতেন না, কোনটা সেমিফাইনাল যুদ্ধে তাঁর সেরা কম্বিনেশন হওয়া উচিত। জানতেন না, মহম্মদ শামির জায়গায় কাকে খেলাবেন। বাড়তি স্পিনার? পেসার? নাকি ব্যাটসম্যান? শুধু একটা ব্যাপার শুক্রবার ইডেনের পর সর্বজনবিদিত।
বাংলা আর বিজয় হাজারে ট্রফিতে নেই। নেই, পরিবর্তিত ইডেন পিচ বুমেরাং হয়ে ঘরের টিমকেই আঘাত করে বসায়! রবি শাস্ত্রীর মতো ক্রিকেট প্রাজ্ঞ কমেন্ট্রি বক্স থেকে বাংলার স্ট্র্যাটেজির সমালোচনা করছিলেন যে, ঘাস ওড়ানোটা ঠিক হয়নি। বাংলার আসল শক্তি তো পেস বোলাররা।
ঘাস উড়িয়ে দেওয়ায় দুই অর্ধে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করল ইডেন পিচ। প্রথমার্ধে যখন বাংলা ব্যাট করল, তখন ‘ডাবল পেসড’। কোনও কোনও বল আচমকা লাফিয়ে কিপারকে মুখ থেকে ধরতে হল। কোনওটা আবার ঝুঁকে পড়ে গোড়ালি থেকে। কখনও স্লো। বল এল থমকে থমকে। ময়দানি ভাষায় ‘ট্রাস্টি শট’ খেলা সম্ভব হল না। মনোজ তিওয়ারির মতো ব্যাটসম্যান ৬১ রানের ইনিংসে একটার বেশি বাউন্ডারি মারতে পারলেন না! কোন যুক্তিতে অত ঠুকুর-ঠুকুর, সেটাও বোঝা গেল না। কারণ, রানটা পরেও উঠল না। আবার যুদ্ধের দ্বিতীয়ার্ধে যখন রেল ব্যাট করতে নামল, তখন বাইশ গজ সম্পূর্ণ ‘অরিজিনাল ইডেন গার্ডেন্স’ উইকেট। যেখানে মুভমেন্ট বলে কোনও ব্যাপার নেই। অথচ লক্ষ্মীর হাতে অশোক দিন্দা নামের এক আগুনে পেসার পড়ে! কর্ণ শর্মার মতো এক জন স্পিনার থাকলেও কিছু হতে পারত। কিন্তু স্পিনেও তো বাংলার ‘ভাঁড়ে মা ভবানী! উইকেট বদলে দুপুরের চেয়ে ব্যাটিংয়ের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ, এবং কোনও এক অখ্যাত অমিত পৌনিকরের রমরমা বাজার।
বাংলাকে হারিয়ে রেলের উল্লাস।
পরিণাম— বিরক্তি, যন্ত্রণায় বারবার লক্ষ্মীর চোখমুখ কুঁচকে ফেলা। ১৮৫-র টানাটানির সংসারে দরকার প্রতিপক্ষ ব্যাটিংকে শুরুতেই পঙ্গু করে দেওয়া। কিন্তু লক্ষ্মীকে উল্টে দেখতে হল, পরের পর বাউন্ডারি বেরোচ্ছে। থার্টি ইয়ার্ডস সার্কেলে কুৎসিত ফিল্ডিংয়ের প্রতিযোগিতা চলছে তাঁর সতীর্থদের মধ্যে!
পরিণাম— অশোক দিন্দার বিখ্যাত ‘ফায়ারি স্পেল’ আজ হাওয়া! বেঙ্গল এক্সপ্রেস প্রথম উইকেটটা পেলেন রেল একশো পেরিয়ে যাওয়ার পর। শেষের বিজ্ঞাপন আরও হতাশাজনক। টানা নো বল করে যাচ্ছেন বাংলার এক নম্বর পেসার। ক্রমাগত ফ্রি হিট এবং বাউন্ডারি!
পরিণাম— চলতি ক্রিকেট মরসুমে আরও একটা বড় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল এবং বিদায়। রঞ্জির পর বিজয় হাজারে। মহারাষ্ট্রের পর রেল। প্রতিপক্ষর নামই শুধু পাল্টাল, বাংলার টুর্নামেন্ট-ভাগ্য নয়। এ বার যেন নিয়মই হয়ে গিয়েছে যে, সর্বভারতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল পর্যন্ত লক্ষ্মীরা স্বপ্নের ক্রিকেট খেলবেন। এবং সেমিফাইনালে উঠে তাঁরা এমন এক ক্রিকেট-বিজ্ঞাপন আমদানি করবেন যে দেখে মনে হবে, টিমটা সেমিফাইনালে ওঠার যোগ্যই ছিল না! রঞ্জি শেষ। বিজয় হাজারেও গেল। বাকি শুধু জাতীয় টি-টোয়েন্টি। দেখা যাক!
কিন্তু সে সব পরের ব্যাপার। শুক্রবারের ইডেন-বিপর্যয়ের ময়নাতদন্ত করতে বসলে যদি সর্বাগ্রে উঠে আসে পিচ, তা হলে দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই পক্ষাঘাতগ্রস্থ বঙ্গ ব্যাটিং। সন্ধেয় এক সিএবি কর্তা আক্ষেপ করছিলেন, ‘কারা কারা সব ঢুকে পড়ছে টিমে!’ আক্ষেপ যুক্তিযুক্ত। জয়জিৎ বসুদের মতো কেউ কেউ আজ যা ক্রিকেট উপহার দিলেন ইডেনে উপস্থিত হাজার চারেক দর্শককে, তাতে আগামী তিন বছর তাঁদের বেঙ্গল জার্সি পাওয়া উচিত নয়। শর্ট মিড উইকেটের ট্র্যাপে পড়ে জয়জিতের আউট অনভিজ্ঞতার কথা ভেবে ক্ষমা করা যেতে পারে। কিন্তু কী ভাবে ডাইভ মেরে হাতের তলা দিয়ে বল গলিয়ে বাউন্ডারি দিতে পারেন টিমকে জয়জিৎ, বোধগম্য হয় না। মুশকিল হল, তাঁদের বদলে যে বা যাঁরা আসবেন তাঁরাও বা কত ভাল? ক্লাবহাউসে দাঁড়িয়ে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “আরে, টিমে লক্ষ্মী ছাড়া তো কারও খাঁচাই নেই!” যদিও লক্ষ্মীর ব্যাটিংও এ দিন অমার্জনীয়। বাংলা ১০৯-৪ এই অবস্থায় বঙ্গ অধিনায়কের কী দরকার ছিল তুলে মারতে যাওয়ার? টিমটা তো আরও উল্টে চাপে পড়ে গেল। শ্রীবৎস গোস্বামী— বিরাট কোহলির সঙ্গে শুরু করেছিলেন। আজ বিরাট ভারতের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক। আর শ্রীবৎস রঞ্জিতেও এখনও নিয়মিত নন। বিজয় হাজারেতে ওপেন করতে নেমে প্রথমে সেট হন, তার পর নিয়ম করে আউট হয়ে যান। ভাবা যায়, আজ একটা সময় পঁচিশ ওভার কোনও বাউন্ডারি মারতে পারেনি বাংলা! মনোজ-লক্ষ্মীর মতো হার্ডহিটাররাও মাঠের বাইরে ফেলতে গিয়ে, মাঠের ভিতরে ‘জীবন’ দিয়ে গেলেন! আর এত ঢক্কানিনাদে পিচ-পরিবর্তন ঘটিয়ে লাভের লাভ কী?
না আঠারোটা রান বাড়তি!
খুব সহজে, বঙ্গ ব্যাটিং সবুজে যা, পাটাতেও তা, আবার ধুলোতেও তাই। শেষ দিকে রেলের কয়েকটা উইকেট পরপর পড়ল ঠিকই, কিন্তু সেগুলো সবই ‘মৃত্যু’র আগে মরণকামড়। রাতে সিএবি কর্তাদের শোকার্ত মুখগুলো দেখলে খারাপ লাগবে। বড় আশা করে তাঁরা ভেবেছিলেন, বাংলা বিজয় হাজারে ফাইনাল খেলবে দোলের দিন। সভ্য-সদস্যদের আনা হবে, মিডিয়াকেও নিয়ে আসা হবে দরকারে বাসে, লক্ষ্মীরা চ্যাম্পিয়ন হলে হবে বাংলার আসল বসন্তোৎসব!
সব শেষ। বরং এখন দেখতে হবে বাংলায় ‘ব্রাত্য’ এক বাঙালি ক্রিকেটার ইডেনে ফাইনাল খেলছেন রেলের হয়ে! এবং এমন অপ্রত্যাশিত হারের পর কর্তাদের স্তব্ধ মুখগুলো দেখলে, কানে বাজবে ‘স্টপার’-এর সেই বিখ্যাত উক্তি। যেখানে কমল গুহ নামক এক অপ্রত্যাশিতের কাছে হারে লিগ জয়ের স্বপ্নচূর্ণের পর বলে ফেলেছিলেন ‘যুগের যাত্রী’র ক্লাব কর্তা।
‘এত মাংস এ বার খাবে কে!’
সরি। এত রং এ বার খেলবে কে!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলা ১৮৫ (মনোজ ৬১, শ্রীবৎস ৩৮, সায়নশেখর ২৮, সাইনি ৩-২৫, কর্ণ ২-৪১),
রেলওয়েজ ১৮৮-৫ (পৌনিকর ৮৩, শিবকান্ত ৫৬ নট আউট, বীরপ্রতাপ ৩-৫৪)।
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।