‘ডেথ টু আর্জেন্টিনা’।
না, আর্জেন্তিনার সঙ্গে কোনও যুদ্ধ লাগেনি। পারস্য সৈন্যদের উত্তেজিত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। তা হলে এত দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড বা ইজরায়েলের জন্য যে যুদ্ধং দেহি স্লোগানটা পারস্য প্রদেশের তেহরান শহরকেন্দ্রে শোনা যাচ্ছে কেন?
উত্তরটা ভাষায় দেওয়া উচিত নয়। শব্দ তো সব সময় আবেগের সঠিক প্রকাশ ঘটায় না। কখনও কখনও কিছু দৃশ্য বোধহয় বেশি উপযোগী ব্যাখ্যা তুলে আনে।
তিরিশ বছরের তেহরান দোকানদার হোসেনকেই ধরা যাক। হাউহাউ করে কাঁদার পর কখনও এক সময় কান্না থেমেছে। চোখের জল শুকিয়েছে। তার পর বলে ফেলেছেন, “আমরা জিতিনি। কিন্তু বিশ্বের সেরা ফুটবলারকে নামতে হল আমাদের হারাতে! আজ বুঝতে পারলাম আমি সত্যিই ইরানি।”
সার্বিয়ান রেফারি মিলোরাদ মাজিককে বোধহয় হাতের সামনে পেলে কোতলই করে দিতেন আতিয়া। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, কী করে পেনাল্টিটা না দিতে পারেন ওই সার্বিয়ান রেফারি। “ডাকাতি, স্রেফ ডাকাতি হল আমাদের সঙ্গে!” পাশ থেকে দেশের পতাকায় রাঙিয়ে নেওয়া মুখের মালিক এহসান বলে ফেলেন, “আমরা অসাধারণ খেলেছি। আর্জেন্তিনা নয়, হেরেছি মেসির কাছে।”
তেহরানে গত রাতে মাঝরাত পর্যন্ত নাকি যানজট ছাড়েনি। পাগলের মতো রাস্তায় নেমে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে চলেছে পারস্য সমাজ। বাজি-পটকা ফেটেছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে। হাতের কাছে কিছু ফাটানোর না পেলে বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে গাড়িরই হর্ন! আসলে দেশটা তো আর পাঁচটা দেশের মতো নয়। উৎসবের এখানে বড় একটা কারণও ঘটে না। বরং থাকে নিয়মের এমন কিছু কাঁটাতার, যেখানে রক্তাক্ত হয় আবেগ। শোনা গেল, ইরানের বহু মহিলা জাতীয় গর্বের দিনটা চাক্ষুষ করতে পারেননি। পুরুষদের ফুটবল দেখার ছাড়পত্র ছিল না যে!
দেশের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানির ফতোয়া বলে, মেয়েরা পাবলিক প্লেসে বিশ্বকাপ দেখতে পারবে না। তাদের জন্য আলাদা প্রেক্ষাগৃহ থাকবে, সেখানে তারা যাবে এবং যাবে অবশ্যই বোরখা পরে! কাফে বা রেস্তোরাঁয়ও নাকি টিভিতে বিশ্বকাপ দেখানো যাচ্ছে না। অন্য কোনও চ্যানেল দিয়ে রাখতে হচ্ছে। পাছে মহিলারা দাঁড়িয়ে দেখতে শুরু করেন। ফতোয়ার বাড়াবাড়ির চরমতম নিদর্শন আবারও পাওয়া গেল ইরানে চলা ভলিবল টুর্নামেন্টে। ইতালির সঙ্গে ইরানের ভলিবল ম্যাচ ছিল। স্টেডিয়ামে হাজির সমস্ত ইরানিয়ান মহিলাদের বার করে দেওয়া হল! শুধু তাই নয়, মহিলা সাংবাদিকদেরও। তাতেও তো জাতীয় আবেগকে শাসনের চাবুকে আটকে রাখা গেল না। ইরানি মহিলাদের কেউ কেউ মুখে দেশের পতাকা আঁকলেন, প্রশাসনের নজর বাঁচিয়ে রাতভোর উৎসব করলেন, কেউ চলে গেলেন ভানাক স্কোয়ারে।
দেশজ সীমান্তও তো মুছে গেল এক ধাক্কায়। সেই কবে ইরান থেকে কলকাতায় চলে এসেছেন জামশিদ নাসিরি। আর ফেরেননি। আটাত্তরে যে বার আর্জেন্তিনায় প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিল ইরান, ঠিক তার দু’বছর পরেই আশি সালে বন্ধু মজিদ, খাবাজির সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এসেছিলেন জামশিদ। তার পর থেকে এই শহরেই রয়ে গিয়েছেন। শনিবারের ম্যাচ নিয়ে বলছিলেন, “আর্জেন্তিনার সঙ্গে ইরানের লড়াই দেখে আমি একটুও অবাক হইনি। ইরানের এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে টিমের ফুটবলারদের বিদেশে খেলার অভিজ্ঞতা। এই টিমের পাঁচ জন বিদেশি লিগে খেলে। তা ইপিএলই হোক বা বুন্দেশলিগা। ওরা মেসি-আগেরোদের দেখে কেঁপে যায়নি।”
তবে শুধু বুন্দেশলিগা, ইপিএলের প্লেয়ারদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি একমাত্র কারণ নয়। তেহরানের মতো জামশিদও মনে করেন, সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর কার্লোস কুইরোজ। টিমটার মডেল পোড়খাওয়া এই পর্তুগিজ ভদ্রলোকই পাল্টে দিয়েছেন। যাঁকে বিশ্বকাপের পর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যেই ইরান ফুটবল প্রশাসনের মুণ্ডপাত শুরু হয়ে গিয়েছে দেশজুড়ে। ইরাকের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ফুটবলপ্রেমীদের মত, কুইরোজ চলে যাওয়া মানে টিমটার আবার ‘এশীয়’ স্তরে নেমে আসা।
আর আন্তর্জাতিক স্তরের পরের পর্বে যেতে হলে?
গ্রুপ ‘এফ’-এ দুটো ম্যাচ খেলে ইরানের পয়েন্ট এখন এক। তাদের গ্রুপ থেকে ইতিমধ্যেই শেষ ষোলোয় চলে গিয়েছে আর্জেন্তিনা। গ্রুপের দ্বিতীয় দল হিসেবে এখন নকআউটে যাওয়ার জন্য নাইজিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ইরানের। গ্রুপের শেষ ম্যাচে যদি মেসিরা ১-০ হারান নাইজিরিয়াকে, আর বসনিয়ার বিরুদ্ধে ২-০ জিততে পারে ইরান, তা হলেই আর্জেন্তিনার সঙ্গে শেষ ষোলোর টিকিট রিজার্ভ করে ফেলবে টিম কুইরোজ।
পারবে পারস্য চিতারা?
পারলে সেটা হবে যুদ্ধ-বিগ্রহের ‘মরুভূমিতে’ এক টুকরো জীবনের মরুদ্যান!