বিশ্বকাপের আসল লড়াই এই সবে শুরু হল। কিন্তু কাপটা শেষ পর্যন্ত কাদের হাতে উঠবে, তা নিয়ে জমে উঠেছে জল্পনা। পাল্লা ভারী দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর। আমার নিজেরও ধারণা, কাপ এ বার লাতিন আমেরিকাতেই যাচ্ছে।
শেষ ষোলোয় এশিয়ার কোনও দলই নেই। আফ্রিকা থেকে মাত্র দু’টো টিম। এই অবস্থায় ফুটবল-পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করতে হলে লাতিন আমেরিকানদের থামানোর দায়টা বর্তাবে ইউরোপের টিমগুলোর উপরেই। কাজটা শুনতে সহজ, করে দেখানো ততটাই কঠিন।
ব্রাজিলের মাটিতে আমার নিজের প্রথম নামার অভিজ্ঞতা ১৯৬৯ সালে। বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দেশে ফিরে যায় গর্ডন ব্যাঙ্কস। মনে আছে, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কোনও রকম সুযোগ ছাড়াই ব্যাঙ্কসের বদলি হিসাবে নেমে পড়তে হয়েছিল মাঠে। সেই টের পেয়েছিলাম রং, শব্দ আর পাগল করা গরমের ত্র্যহস্পর্শে লাতিন আমেরিকার ফুটবল ঠিক কোন পর্যায়ের উন্মাদনা! মনে হয়েছিল, এ সম্পূণর্র্ অন্য পরিবেশ, অন্য মাত্রার সমর্থন। যা আমার একেবারে অচেনা।
ফুটবল মাঠের সমর্থক সব সময়েই হল্লাবাজ।কিন্তু ইউরোপে সমর্থকেরা ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী চিৎকার করে। দক্ষিণ আমেরিকায় সে বালাই নেই। এখানে সমর্থনের তীব্রতা শুরু থেকে শেষ, একই থাকে। অবিরাম ড্রাম পিটিয়ে, গান গেয়ে, চিৎকার করে দলকে তাতায় এরা। আর দর্শকদের সবচেয়ে কাছাকাছি গোলে দাঁড়ানোর সুবারে গ্যালারির সেই চাপ সবচেয়ে বেশি টের পায় প্রতিপক্ষের গোলকিপার। মনে আছে, মেক্সিকোর বিরুদ্ধে নিজের প্রথম সেই ম্যাচে গ্যালারির অবিশ্বাস্য শব্দব্রহ্মের মধ্যে মনঃসংযোগ ধরে রাখতে আক্ষরিক অর্থেই দাঁতে দাঁত চেপে চোখ কুঁচকে বলের দিকে তাকাতে হচ্ছিল।
এ তো গেল মানসিক ধকল। ব্রাজিলের আবহাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার শারীরিক ধকলটাও মারাত্মক। এখানকার ভ্যাপসা গরমটা ইউরোপের প্লেয়ারদের সমস্ত শক্তি যেন শুষে নেয়। আসলে দক্ষিণ আমেরিকার বহু ফুটবলার নিয়মিত ইউরোপে ক্লাব ফুটবলটা খেলে। তাই ইউরোপের আবহাওয়ায় ওরা অনেকটাই অভ্যস্ত। কিন্তু উল্টোটা প্রায় হয় না বললেই চলে। যে কারণে ব্রাজিলে টুর্নামেন্ট গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের ফুটবলারদের পক্ষে ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠা ক্রমশ আরও কঠিন হচ্ছে। বিশেষ করে এখন, যখন ফাইনালে পৌঁছতে চাইলে টানা দু’সপ্তাহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেরা পারফরম্যান্স করে যেতে হবে।
এই অবস্থায় গোলকিপারের কাজটা সবচেয়ে কঠিন। আধুনিক কিপিংয়ে টেকনিকের থেকে রিফ্লেক্স, প্রতিক্রিয়া আর ক্ষিপ্রতা ব্যাপারগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিপারকে তাই সর্বদা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে হয়। যা কঠিন কাজ।
আবহাওয়া আর দর্শক-চাপ সামলাতে গিয়ে গোলকিপার ঠিক কতটা সমস্যায় পড়তে পারে, তার সেরা উদাহরণ ইকের কাসিয়াস। যার কাছে টুর্নামেন্টটা সারা জীবনের দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকল। আমি ওকে মহান গোলকিপার বলে মনে করি না। তবে কাসিয়াস নিঃসন্দেহে খুব ভাল। অসম্ভব ধারাবাহিক। কিন্তু জার্মানির বিরুদ্ধে কয়েকটা ভুল করে ফেলে পরিবেশের তাপে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ল।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, ব্রাজিলে টিমগুলোকে এত চাপ নিয়ে খেলতে হচ্ছে আর এত বেশি গোল হচ্ছে যে, কিপারের দিকে আঙুল তোলাটাই সম্ভবত সবচেয়ে সহজ। রক্ষণের দোষ কেউ দেখছে না। কিন্তু ঘটনা হল, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কাজটা যে টিমগুলো সবচেয়ে ভাল ভাবে করছে, তারাই টুর্নামেন্টে আরও এগোবে। গোলকিপার কতটা ভাল সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে বাকি টিমটা মাঠে কতটা দাপট দেখাতে পারল, তার উপর।
আর এখানেই আমার গোড়ার বক্তব্যে ফিরতে চাই। ব্রাজিলের পরিবেশ লাতিন আমেরিকার টিমগুলোর জন্য আদর্শ। ইউরোপের কোনও দেশ বাজি মেরে বেরিয়ে যাবে, এমন আশা না করাই ভাল।
(সোনি সিক্স/গেমপ্ল্যান)