বিশ্বকাপ ফাইনালের মাঠে বল পড়ার আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে, টুর্নামেন্টের সেরা একাদশ কী? যদি বৃহস্পতির সঙ্গে খেলার জন্য একটা টিম বাছতে হয়, তো তার এগারো জন কে কে?
সাধারণত বিশ্বকাপ ফাইনাল এমন একটা জ্বলজ্বলে ব্যাপার যে, সেটাই এক মুহূর্তে নতুন নায়ক তৈরির ক্ষমতা রাখে। এত দিন ভাল খেলতে থাকা টুর্নামেন্টের অন্যতম নায়ককে খলনায়কে রূপান্তরিত করে দেওয়ারও! ফাইনালের আগে সেরা দল বাছা প্রচণ্ড ঝুঁকি সমন্বিত। অথচ ঐতিহাসিক তা-ই হয়ে এসেছে।
ফিফা যেমন গোল্ডেন বলের জন্য দশ নমিনির নাম এ দিনই জানিয়ে দিল। যেখানে তিন জন আর্জেন্তিনার। চার জন জার্মানির। ব্রাজিল ও নেদারল্যান্ডস এক জন করে। গোল্ডেন বলের জন্য তালিকায় এই রকম: মাসচেরানো, দি’মারিয়া, লিওনেল মেসি, টনি ক্রুজ, মাট্স হুমেলস, টমাস মুলার, ফিলিপ লাম, আর্জেন রবেন, নেইমার দ্য সিলভা এবং হামেস রদ্রিগেজ।
এ বারের সেরা দল বাছতে গিয়ে মনে হচ্ছে, সবচেয়ে লড়াই গোলকিপার আর ফরোয়ার্ড নির্বাচনে। জার্মান ডিপ ডিফেন্স বাদ দিলে কোনও বড় টিমের রক্ষণই নাগাড়ে ভাল খেলেনি। ফরোয়ার্ডরা কিন্তু ব্রাজিলে বরাবর খবরের শিরোনাম হয়েছেন। হামেস রদ্রিগেজকে পাদপ্রদীপে আনল তো ২০১৪-র কুপ দে মুন্দোই।
বিশ্বকাপের আলো ও অন্ধকার। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।
এ বারের টুর্নামেন্টের ভিত্তিতে সেরা দল হওয়া উচিত:
ম্যানুয়েল নয়্যার (গোলকিপার): যুগান্তকারী ভূমিকা নয়্যারের এই বিশ্বকাপে। গোলকিপারদের ব্যাকরণই বদলে দিয়েছেন আলজিরিয়া ম্যাচ থেকে। তাঁর নার্ভও দারুণ। মেক্সিকান গোলকিপারের ব্রাজিল ম্যাচে উপর্যুপরি সেভ লোকগাথার পর্যায়ভুক্ত হয়ে গেলেও, গোটা টুর্নামেন্টে প্রভাব বিচারে নয়্যারই এক নম্বর।
পাবলো জাবালেতা (ডিফেন্ডার): শুরুর দিকটা বসনিয়া বা ইরানের প্রতি আক্রমণও টলিয়ে দিলেও যত টুর্নামেন্ট গ্যাছে, তত ম্যাঞ্চেস্টার সিটির ডিফেন্ডার নিজেকে গুছিয়েছেন। তত আঁটোসাঁটো লেগেছে আর্জেন্তিনাকে। নেদারল্যান্ডস ম্যাচে মুখ থেকে রক্ত পড়া অবস্থাতেও মাঠ ছাড়েননি।
জেরোম বোয়াতেং (ডিফেন্ডার): টুর্নামেন্টে এখনও বোধহয় সবচেয়ে নির্ভরশীল ডিফেন্ডার। বায়ার্ন মিউনিখের সে দিন রিয়াল বিধ্বস্ত ডিফেন্সে তিনি এক জন অপরাধী। কিন্তু বিশ্বকাপে তার কোনও ছাপ পড়তে দেননি। রোনাল্ডোকে দুটো ট্যাকল করেছেন যা শুরুতেই পর্তুগালকে বলে দিয়েছে, কাছে ঘেঁষো না। তারা ঘেঁষতেও পারেনি।
মাট্স হুমেলস (ডিফেন্ডার): শুধু জমাট রক্ষণ আর কোবরা ট্যাকলই নয়, হুমেলস অসম্ভব দ্রুত সেটপিস মুভমেন্টের সময় আক্রমণে যোগ দিতে পারেন। তাঁর পেছনে ফেরার গতিটাও দারুণ। মেসি বনাম তিনি— টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বহুকথিত গবেষণা হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
দাভিদ লুইজ (ডিফেন্ডার): লেফটব্যাক এই টুর্নামেন্টে কেউ সে ভাবে উঠে আসেননি। হুমেলস এই টিমে বাঁ দিক দিয়ে খেলতে পারেন। তাঁর দুটো পা-ই সমান চলে। কারণ সাত গোল সত্ত্বেও দাভিদ লুইজ টিমের দ্বিতীয় স্টপার। কারণ চেলসির তারকা বাকি টুর্নামেন্ট তো ঝকমক করেছেন। মিক জ্যাগার ভুল বলেননি যে, ওই দিনটা বাকিদের মতো তুমিও ঘুমোচ্ছিলে দাভিদ। কিন্তু বাকি টুর্নামেন্ট জুড়ে তুমিই ছিলে ব্রাজিলের বেস্ট প্লেয়ার।
পল পোগবা (মিডফিল্ডার): স্বয়ং মোরিনহোও আকৃষ্ট হয়েছেন এই তরুণ ফুটবলারের ফ্রান্সকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাপটে। গোল্ডেন বলের বিচারে না থাকতে পারেন দেশ আগেই থমকে যাওয়ায়। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকে আকৃষ্ট করেছেন প্রবল ভাবে।
জাভিয়ের মাসচেরানো (মিডফিল্ডার): মেসি আটকে যাওয়ার দিনগুলোয় একা টেনেছেন টিমকে। রবেনকে তাঁর ওই শেষ মুহূর্তের ট্যাকলটা না ঘটলে যাবতীয় জাদুগরি সমেত লিও মেসি এতক্ষণে বার্সেলোনার বাড়িতে। বা বুয়েনস আইরেসে।
টনি ক্রুজ (মিডফিল্ডার): একটা ম্যাচে প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার দৌড়নোর ক্ষমতা রাখেন। অবিশ্রান্ত গতিতে এক বার সামনে, এক বার পেছনে।
নেইমার দ্য সিলভা (মিডফিল্ডার): আটান্নর পেলে হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু সেই ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ থেকে নেইমারের পায়ে বল পড়লেই বিদ্যুৎ। খেলতে পারেননি সেমিফাইনাল থেকে তো কী। ব্রাজিল বিশ্বকাপের কাহিনি তাঁর ড্রিবল এবং তাঁর শিরদাঁড়ার চোট বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নয়।
আর্জেন রবেন (ফরোয়ার্ড): মেসিকে মনে রেখেও টুর্নামেন্টের সেরা ফরোয়ার্ড। এ দিন দেখলাম মোরিনহোও তাঁকে বলেছেন সবচেয়ে ধারাবাহিক। স্পেনকে গতিতে তুবড়ে দেওয়া থেকে প্রতিটা ম্যাচে রবেনকে একই রকম আগুনে লেগেছে।
টমাস মুলার (ফরোয়ার্ড): প্রত্যেকটা ম্যাচে তাঁকে মনে হয়েছে এক ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চা যাকে খেলনা না দিলে সে কান্না থামাবেই না। মুলারের ঈপ্সিত খেলনা অবশ্যই গোল। নিজে পাঁচ গোল ছাড়াও আবার দুটো গোল করিয়েছেন। টিম গোল করলেও সেটা তো খেলনাই!
লিওনেল মেসি (ফরোয়ার্ড): মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। শুধু বলা যায়, গোল্ডেন বলের জন্য কিন্তু ফাইনালে গোল বা দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স লাগবে। মারাদোনাকে একটা ব্যাপারেই টপকানো সম্ভব। কাপ ফাইনালে মারাদোনার গোল নেই।
প্রথম স্ট্যান্ডবাই: হামেস রদ্রিগেজ। টুর্নামেন্টে ফরোয়ার্ডদের মান কত উচ্চাঙ্গের চলছে তা কলম্বিয়া মহাতারকার প্রথম এগারোয় নির্বাচন অবিসংবাদী না হওয়া থেকেই পরিষ্কার!
টিমের কোচ অবশ্যই জোয়াকিম লো। তা তাঁর দলের হাত বিশ্বকাপে পড়ুক বা না!
আর একটা দল অবশ্য হতে পারে। টুর্নামেন্টে চরম হতাশায় ডুবিয়ে দেওয়ার একাদশ।
কাসিয়াস, দানি আলভেজ, পেপে, জেরার পিকে, মার্সেলো, স্টিভন জেরার, জাভি, ইনিয়েস্তা, মারিও বালোতেলি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং অবশ্যই ফ্রেড।
ডুবিয়ে দেওয়া একাদশের কোচ? একবাক্যে লুই ফিলিপ স্কোলারি।
সেরা দল খেলবে বৃহস্পতি গ্রহের সঙ্গে। এরা? এদের শাস্তি— দিল্লির অম্বেদকরে ভারতের সঙ্গে খেলবে!!
ফাইনালের দায়িত্বে বিতর্কিত রেফারি
সংবাদ সংস্থা • রিও ডি জেনেইরো
ইতালির নিকোলা রিজোলি।
বিশ্বকাপে এ বার রেফারিরা অনেক ম্যাচে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। তারই যেন পরম্পরা রেখে রবিরার ফাইনাল পরিচালনার দায়িত্বও ফিফা দিল এক বিতর্কিত রেফারির কাঁধে। তিনি— ইতালির নিকোলা রিজোলি-র রেফারিংয়ের তীব্র সমালোচনা কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্তিনার কাছে ০-১ হারের পরেই করেছিলেন বেলজিয়াম কোচ মার্ক উইলমটস। “মেসির সঙ্গে মাঠে যখনই যা হয়েছে, সব সময় ওর পক্ষেই ফ্রিকিক দিয়েছেন রেফারি। আর্জেন্তিনার কোনও ফাউলই চোখে পড়েনি ওঁর।” ফাইনালে সেই মেসির আর্জেন্তিনাই খেলবে জার্মানির সঙ্গে। এ বারের টুর্নামেন্টে ৪২ বছর বয়সি রিজোলি এর আগে যে তিনটে ম্যাচ খেলিয়েছেন প্রতিটার সঙ্গেই ফাইনালিস্টদের কোনও না কোনও দল জড়িয়ে। আর্জেন্তিনা-বেলজিয়াম ছাড়াও রিজোলি গ্রুপে আর্জেন্তিনা-নাইজিরিয়া (মেসিরা ৩-২ জেতেন) এবং নেদারল্যান্ড-স্পেন (রবেনরা জেতেন ৫-১) ম্যাচ খেলান। সে দিক দিয়ে দুই ফাইনালিস্টের কাছেই রিজোলি পয়া রেফারি। যিনি ২০০৭ থেকেই ফিফা রেফারি এবং ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলিয়েছেন ওয়েমব্লিতে। যে ম্যাচে আবার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল দুই জার্মান ক্লাবই—বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। ফিফার রেফারি কমিটির প্রধান জিম বয়েস ফাইনালের রেফারির নাম আজ ঘোষণা করে বলেছেন, “সেরা ম্যাচের জন্য সেরা রেফারিতেই বাছা হল।”