হঠাৎ করে একটা ছয় কী ভাবে যেন সব হিসেব ওলটপালট করে দিল!
তার আগে, মানে ১৯৮১ থেকে ’৮৫ অবধি, পাকিস্তানকে খেলার আগে কোনও রকম চাপই অনুভব করতাম না। পঁচাশিতে তো অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস ফাইনালে পাকিস্তানকে অনায়াসেই হারিয়েছিলাম আমরা।
কিন্তু ছিয়াশিতে শারজায় চেতনকে মারা জাভেদের ওই ছয়, তার পর ম্যাচ জিতে পাকিস্তানিদের বাঁধনভাঙা উল্লাস সব মিলিয়ে আমরা যেন কী রকম ঘোরে চলে গেলাম। সাইকোলজিক্যাল অ্যাডভান্টেজ তখন পুরোটা পাকিস্তানের।
এবং আমি আজও কোনও মতেই বিশ্বাস করি না আমাদের সেই টিম ওদের টিমের থেকে খারাপ ছিল। টিমে কপিল ছিল, সানি ছিল, ছিল মোহিন্দর অমরনাথ, ছিল রবি, শ্রীকান্তের মতো প্লেয়ার।
কিন্তু জাভেদের ছয় ছাড়াও আর একটা বিরাট কারণ ছিল—পাকিস্তানের সেই সময়ের দাদাগিরি।
ইমরান খানের অধিনায়কত্ব।
পুরো পাকিস্তান টিমের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বদলে দিয়েছিল ইমরান। সবচেয়ে জুনিয়র প্লেয়ারকেও দেখতাম চোখে চোখ রেখে আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। এমনিতেই আমাদের ভাষা এক, জাভেদ ছাড়া কেউ খুব একটা স্লেজিং-ও করত না। হ্যাঁ, মাঠের ভেতর হাসিঠাট্টাও চলত। কিন্তু ইয়ার্কির মধ্যেও দেখতাম পাকিস্তানি প্লেয়ারদের শরীরী ভাষা থাকত সাঙ্ঘাতিক অ্যাগ্রেসিভ। এটার পুরো কৃতিত্ব ইমরানের।
অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, বিরানব্বইয়ের পর কী এমন হল পাকিস্তানের যে আমরা ওদের ওয়ার্ল্ড কাপে ক্রমাগত হারাতে থাকলাম। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সাইকোলজিক্যাল অ্যাডভান্টেজ?
তার দু’টো কারণ আছে।
প্রথমটা অবশ্যই ইমরান খানের রিটায়ারমেন্ট। ইমরান অবসর নেওয়ার পর পাকিস্তান টিম যেন খেই হারিয়ে ফেলল। সেই ঝাঁঝটা আর আগের মতো রইল না।
ইমরান যদি হয় সিঙ্গল বিগেস্ট ফ্যাক্টর, তা হলে দ্বিতীয় ফ্যাক্টর রিভার্স সুইংয়ের রহস্য চলে যাওয়া।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই কিন্তু পাকিস্তান রিভার্স সুইংটা রপ্ত করে ফেলেছিল।
সেই সময় আমাদের যে রিভার্স সুইং খেলতে অসুবিধে হত, তা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা আজকের মতো জলভাত ছিল না। তখন ম্যাচও অনেক কম হত, রিভার্স সুইংও আমরা একমাত্র ‘ফেস’ করতাম পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ থাকলেই।
বিরানব্বইয়ের পর যখন বাকি টিমগুলো রিভার্স সুইং রপ্ত করে ফেলল, পাকিস্তান বোলিংয়ের ধার কিছুটা হলেও কমে গেল। আক্রম, ইউনিস থাকা সত্ত্বেও সেই আগের ‘খেলতেই পারছি না’ ব্যাপারটা চলে গেল।
এই ফ্যাক্টরগুলো নিষ্ক্রিয় হওয়ার পর থেকেই শুরু হল ভারতের উত্থান। এবং ধীরে ধীরে ওয়ার্ল্ড কাপ হলেই পাকিস্তান হারবে এই প্রেশারটা ওদের ওপর গিয়ে পড়ল।
এবং অ্যাডিলেডে রবিবারের ম্যাচেও আমি কিন্তু ভারতকেই এগিয়ে রাখছি। ইন্ডিয়া ফেভারিট।
আসলে এত দিন ভারত-পাকিস্তান খেলা দেখে এবং নিজে খেলে এটা বুঝেছি এই ম্যাচটা শুধু নামেই ক্রিকেট। আসলে এটা মানসিক যুদ্ধ। যে দল সাত ঘণ্টা নার্ভ স্ট্রং রাখতে পারবে, সে এই যুদ্ধটা জিতবে।
আমাদের সময় দেখেছি, কপিল কী সানি এই ম্যাচের আগে নর্মাল কথাবার্তা বলত। আমরা নিজেরাও নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতাম। খেলা নিয়ে কী প্রতিপক্ষ নিয়ে কোনও কথা বলতাম না। উদ্দেশ্যটা ছিল ম্যাচ নিয়ে যত কম কথা বলব, তত নিজের ওপর কম চাপ থাকবে।
এটা করাটা জরুরি ছিল কারণ, বাকি পৃথিবী থেকে তো আপনি আলাদা হতে পারবেন না। হোটেল-বয় থেকে আত্মীয়স্বজনের ‘পাকিস্তানকে হারাতেই হবে’ এই আর্তি ম্যাচের অনেক আগে থেকেই প্লেয়াররা শোনা শুরু করবে। তাই যতটা নর্মাল থাকা যায়, ততই ভাল।
আর একটা ব্যাপার আমি অনেক ভারত-পাক ম্যাচে দেখেছি। উপমহাদেশে এর চেয়ে বড় ম্যাচ আর হয় না। একটা ইনিংসই আপনাকে সারা জীবনের জন্য ‘অমর’ করে দিতে পারে, একটা ভাল স্পেলের কথা দেখবেন তিরিশ বছর পরেও মানুষ আলোচনা করছে।
কিন্তু এই হিরো হওয়ার লোভে পা দিয়ে অনেক প্লেয়ারকে দেখেছি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ধ্যাড়াতে।
আমি একটাই উপদেশ দেব আমাদের প্লেয়ারদের। ম্যাচ জেতার জন্য খেলো, দয়া করে হিরো হওয়ার চিন্তাধারা নিয়ে মাঠে নেমো না।
এবং এই টিমে দু’জন আছে যারা আমার ধারণা প্লেয়ারদের ক্রমাগত এই ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে চলেছে। তারা এমএস ধোনি আর রবি শাস্ত্রী।
দু’জনেরই পাকিস্তান ম্যাচ খেলার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। দু’জনেই জানে কোথায় কোথায় আমরা ভুল করতে পারি।
ওরা দু’জন যত কথা বলবে, তত কম প্রেশারে পড়বে টিমের জুনিয়ররা। এই ম্যাচে কিন্তু পেপ-টকের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমি অন্তত অবাক হব না যদি টিম হোটেলে ২০১১-র মোহালি বা ২০০৩-এর সেঞ্চুরিয়ন বা ছিয়ানব্বইয়ের বেঙ্গালুরুর ভিডিও বারবার করে চালানো হয়। এগুলো মানসিক ভাবে এক জন প্লেয়ারকে উদ্দীপ্ত করে যা খুব দরকার এ রকম হাইপ্রেশার লড়াইয়ে।
তবে একটা কথা এত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেই এই লেখাটা শেষ করছি।
আপনি-আমি হয়তো আজ রাতে ভাল ঘুমবো। কিন্তু ভারত আর পাকিস্তানের ২২ জন প্লেয়ার কোনও মতেই রাতে ঘুমোতে পারবে না।
ম্যাচের আগের দিন ঘুম ভাল হলে কি আর ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ হয় নাকি!