শনিবার সকাল-সকাল বান্দ্রার অফিসে বসে তাঁর গায়ের লোম কেমন খাড়া হয়ে গিয়েছে, নিজেই ডান হাতটা তুলে দেখালেন। কারণ এখনই তিনি চির-আরাধ্য ভারতীয় ফুটবল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ফোনে কথা বলে উঠলেন। যাঁর নাম— পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেড টিমকে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে কী ভাবে চালানো উচিত, তা নিয়ে পিকের পরামর্শগুলো ফোনে শোনামাত্র যুগ্ম টিম মালিকের সঙ্গে সেটা শেয়ার করলেন। দুপুরেই নতুন ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য আবু ধাবির প্লেন ধরার তাড়া। তার আগে জন আব্রাহাম আনন্দবাজারকে রোমাঞ্চিত ভাবে বলে গেলেন নিজের বিবিধ ফুটবল-স্বপ্নের কথা...
প্রশ্ন: পিকে কী বললেন ফোনে?
জন: বললেন মানে... আমার তো ঘোর কাটছে না। আমি সত্যিই গ্রেট পিকে ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলে উঠলাম? উনি ঝটঝট এমন কতগুলো কথা বললেন যে, তোমার গোলকিপারের হাইট যেন ছয় ফুট হয়। তোমার টিমে পাহাড়ি ছেলেদের হাইট কত? আইকিউ কেমন? ডিফেন্স নিয়ে কী ভেবেছ? আচ্ছা উনি কলকাতায় কোথায় থাকেন?
প্র: সল্টলেক।
জন: আমি তো আইএসএল ওপেনিংয়ের জন্য কলকাতা যাচ্ছি ১২ তারিখ। ওঁর সঙ্গে ফার্স্ট থিং গিয়ে দেখা করব।
প্র: আপনি ফুটবল সম্পর্কে খুব উৎসাহী জানতাম। কিন্তু পুরনো ইন্ডিয়ান ফুটবলেরও খবর রাখেন নাকি?
জন: বলছেন কী! আমার ফুটবল হলেই হল! এই বিশ্বকাপের ছেষট্টিটা ম্যাচের প্রতিটা দেখেছি। মাইন্ড ইউ, প্রতিটা। জিদানের সেই কাপ ফাইনালে ঢুঁ মারার দিন তো আমি মাঠেই ছিলাম। ইন্ডিয়ান ফুটবলের আমি অনেক দিন ধরে খোঁজখবর রাখি। প্রশান্ত ব্যানার্জি, ভাইচুং এদের খেলা-টেলা আমি প্রচুর দেখেছি।
প্র: তা হলে তো কলকাতা গিয়ে আপনার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল টেন্ট দুটোয় সবার আগে যাওয়া উচিত।
জন: মাস্ট! আমার তো নিজেরও উৎসাহ আছে। প্লাস পেশাগত কারণও রয়েছে।
প্র: শুনেছি ১৯১১-র শিল্ডজয়ের ওপর আপনার বন্ধু সুজিত সরকার ছবি বানাচ্ছেন। আপনি কি তাতে যুক্ত?
জন: যুক্ত মানে বলছেনটা কী? (হাসি) আমি তো শিবদাস ভাদুড়ির রোলটা করছি।
প্র: তাই নাকি?
জন: শিবদাস-বিজয়দাস ঠিক হয়ে গেছে। আমরা এখন অভিলাষ ঘোষের রোলে কাউকে খুঁজছি। সে দিন আমরা সবাই একসঙ্গে বসে স্ক্রিপ্টটা শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শেষ হতে সবাই মিলে হাততালি দিই। কোনও দিন এমন হয়নি যে, স্ক্রিপ্ট রিডিংয়ের পর সবাই মিলে হাততালি দিচ্ছি। দেখুন একটা কথা বলছি। সুজিতকে ওর জোনে আমি মনে করি দেশের এক নম্বর ডিরেক্টর। আমরা যেমন ভিকি ডোনর বা মাদ্রাজ কাফে বানিয়েছি, তেমনই ১৯১১ বানাব। আমার তো মনে হয় কাহিনির যা পোটেনশিয়াল, জাতীয় পুরস্কার-টুরস্কার নয়, এই ছবির অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে যাওয়া উচিত!
প্র: শুনেছি আপনি নাকি পূর্বাভাস করেছিলেন, জার্মানি-আর্জেন্তিনা ফাইনাল হবে?
জন: ইয়েস (গর্বের সঙ্গে)।
প্র: এ বার প্রেডিক্ট করুন তো আইএসএলে কী হবে?
জন: এই রে! আইএসএল-আইএসএল....
প্র: মানে আপনার টিম নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেড কেমন করবে?
জন: আমাদের টিম খুব ইয়ং। জোহান কাপদেভিয়াকে বাদ দিলে টিমটার গড় বয়স একুশ। কাপদেভিয়াকে নিয়ে পঁচিশ। আমার মনে হয় টুর্নামেন্টের থার্ড ইয়ারে পড়ে আমরাই ট্রফিটা ঘিরে থাকব (হাসি)।
প্র: অন্য টিমগুলো যেমন শহরের নামে। এখানে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নামে কেন?
জন: কারণ আমরা চেয়েছি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট টিম যেমন গোটা দ্বীপপুঞ্জকে এক করে, সে ভাবে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে একত্রিত করবে আমাদের টিম। জাতীয় জীবনে অনেক বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার হয়েছে নর্থ-ইস্ট। আমি চাইব ফুটবল টিমের মাধ্যমে ওরা জাতীয় দরবারে গর্জে উঠবে।
প্র: আন্ডারডগ হারাবে সব সুপার পাওয়ারদের?
জন: ইয়েস।
প্র: এটা কি টিমের ভোকাল টনিক? তোমাদের প্রতি এত বছরের অযত্নের প্রতিবাদ করো!
জন: ছেলেদের আমরা এটা বলেছি। আর এটা তো সত্যি কথা।
প্র: কাপদেভিয়াকে ট্রেনিং ক্যাম্পে কেমন দেখলেন?
জন: দারুণ অ্যাটিটিউড। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিমের প্লেয়ার। এত বড় ফুটবলার! অথচ কোনও দেমাক নেই। সবার সঙ্গে মিশে গেছে। আমার ছবির শু্যটিং দেখতেও ও সে দিন এসেছিল। রোদ্দুরের মধ্যে বসে বসে দেখল। যাওয়ার আগে বলল, দারুণ এনজয় করেছে।
প্র: আপনার মতো সিনে-স্টাররা এসে যাওয়া মানে তো সেই আইপিএলেরই ফুটবল সংস্করণ। কিছু খেলা, কিছু বলিউড।
জন: আজ্ঞে না। এটা আইপিএল নয়। আর হোক, সেটাও চাই না। ফুটবলকে আমরা একদম বিশুদ্ধ রাখতে চাই। আমি ওই আইপিএল মালিকদের মতো মেকআপ নিয়ে কালো চশমা পরে বসে থাকব না। আর লক্ষ্যও রাখব না কখন টিভি ক্যামেরাম্যান আমাকে ফোকাস করছে। আমরা বলিউড নই। কাজেই বলিউডিকরণের প্রশ্ন উঠছে না।
প্র: ক্যামেরা আপনাকে ধরতে পারবে না মানে? কোথায় থাকবেন আপনি?
জন: আমি ড্রেসিংরুমে ভেতর থাকব।
প্র: বলিউডিকরণ নিয়ে এত বলছেন, কিন্তু বলিউড থেকেই তো আপনার খ্যাতি।
জন: আমাদের মালিকানায় আমি আর আমার বন্ধু রনি লাহিড়ী। আমরা একসঙ্গে অন্য ধারার ছবি প্রোডিউস করি। টিমের তৃতীয় মালিক শিলংয়ের লাজং এফসি-র মালিক আমাদের বন্ধু মিং। আমাদের নিজেদের আড্ডায় প্রথম আর বেশির ভাগ সময় একমাত্র আলোচ্য বস্তু হল ফুটবল। আমার নিজের প্রথম তিনটে প্যাশন হল ফুটবল, ফিটনেস আর মোটর-সাইকেল। বলিউড আসে এগুলোর পরে। মনেপ্রাণে আমি এক জন স্পোর্টসম্যান। অ্যাথলেটিক্স কলেজ লেভেলে আমার রেকর্ড বহু বছর এই স্টেটে কেউ ভাঙতে পারেনি। ফুটবলে আমি স্টেট লেভেলে ঢুকে পড়ব, এই অবস্থায় আমার সামনে পড়াশোনার বিকল্পটা ঝুলছিল। আর সব মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে যা হয়, আমাকেও ফুটবল ছেড়ে দিতে হয়। এই সুযোগ সেই মৃত স্বপ্নটাকে কোনও ভাবে নতুন প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করানোর! আমি প্রাণপণ লড়ব।
প্র: ধোনি আপনার এত বন্ধু। ওকে টিমের খেলা দেখতে ডাকবেন না?
জন: অবশ্যই গুয়াহাটিতে ওকে আসতে বলব। মুম্বইয়ে এলে ধোনি তো আমার বাইকগুলো নিয়েই বেরোয়। ওকে দারুণ লাগে আমার। ও নিজেকে ক্রিকেট টিমে মোটেও ক্রিকেটার ভাবে না। ভাবে ইন্ডিয়ান আর্মির এক জন যোদ্ধা। ওর পুরো কনসেপ্টটাই হল, দেশের হয়ে যুদ্ধ করছি। এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। যদিও আমিও একই রকম দেশপ্রেমী।
প্র: আইএসএল কনসেপ্টটা দাঁড়াবে? কী মনে হচ্ছে, সত্যি কথা বলুন। ব্যবসায়ী হয়ে নয়।
জন: সত্যি কথা বলছি। আইএসএল বিপ্লব এনে দিতে পারে ভারতীয় ফুটবলে। আমাদের নতুন ছেলেগুলোকে বিদেশিরা যে ভাবে শেখাচ্ছিল, আমি রোমাঞ্চিত। ভেবে দেখুন, গোয়ার ক্যাম্পে ওদের কাপদেভিয়া বলে দিচ্ছে, ওয়ান, টু, থ্রি বল ছাড়ো, এ বার অ্যাটাকে যাও। এ সব কোনও দিন হয়েছে ইন্ডিয়ান ফুটবলে? আইএসএলেও যদি কাজ না হয়, তা হলে বোধহয় আর কোনও ওষুধেই কাজ হবে না।