টানটান: রবিবার স্পেন-রাশিয়া প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে। রয়টার্স
ফুটবল ইজ় আ সিম্পল গেম, টোয়েন্টি টু মেন চেজ় আ বল ফর নাইন্টি মিনিটস অ্যান্ড অ্যাট দি এন্ড দি জার্মানস অলওয়েজ় উইন। ঠাট্টা করে কথাটা বলেছিলেন ব্রিটিশ ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক গ্যারি লিনেকার। এ বারের বিশ্বকাপে প্রাথমিক পর্বে ম্যাচগুলো যে ভাবে গড়িয়েছে, তাতে জার্মানি প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গেলেও, নক আউট পর্বে লিনেকারের ওই মন্তব্য অমোঘ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাশিয়ায় বিশ্বকাপের সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী? টানটান উত্তেজনা। নাহ্, ভুল হল। বিশ্বকাপের ম্যাচে উত্তেজনা তো থাকবেই। বৈশিষ্ট্য উত্তেজনার উৎসে। অনেক ম্যাচেই ফলাফল ঠিক হচ্ছে একেবারে অন্তিম লগ্নে। মানে, টিমগুলো তুল্যমূল্য। লড়াই হচ্ছে প্রায় সমানে সমানে।
প্রাথমিক পর্বে না হয় ড্র স্বাগত, কিন্তু নক আউটে? তখন তো নিষ্পত্তি চাই। অতএব টাইব্রেকার। আর, ওই পথে হেস্তনেস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় লিনেকারের মন্তব্য। কেন? টাইব্রেকার শুরুর আগের টস! যে দল জেতে, সচরাচর তারা প্রথম পেনাল্টি মারে। এবং গোল দেয়।
রবিবার স্পেন এবং ডেনমার্ক প্রথম পেনাল্টি মেরে হেরে গেলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক চাপে পড়ে টসে-হারা দল। এই চাপ অব্যাহত থাকে প্রত্যেক রাউন্ডে দ্বিতীয় পেনাল্টি মারার সময়ে। অসুবিধেয় পড়ে টসে-হারা দল। অভিজ্ঞতায় লিনেকার দেখেছেন, জার্মানি কিংবা জার্মান ক্লাবগুলো টসে প্রায়ই জেতে, এবং কখনও পরে পেনাল্টি মারার সিদ্ধান্ত নেয় না। এর সুফলও পায় ওরা। তাই ওঁর ওই মন্তব্য।
টাইব্রেকারের চালু নিয়মে অবিচারের বীজ বোনা। এ দাবি দুই গবেষকের। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন ব্রামস এবং তাঁর সহকর্মী মহম্মদ ইসমাইল। দাবি জানাতে ওঁরা তুলে ধরেছেন স্পেনের বার্সেলোনায় পম্পিউ ফাব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে হোসে আপেস্তেগুইয়া এবং লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে ইগনাসিয়ো পালাসিয়ো-হুয়েরতার সংগৃহীত পরিসংখ্যান। ওই দুই গবেষক ১৯৭০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বকাপ, ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, আমেরিকান কাপ, আফ্রিকান নেশনস কাপ এবং গোল্ড কাপের যে সব ম্যাচে টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হয়েছে, তাদের সব তথ্য ঘেঁটেছেন। ওঁদের সিদ্ধান্ত— টসে জিতে প্রথম পেনাল্টি মারলে শতকরা ৬০ ভাগ ম্যাচে জয় নিশ্চিত।
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? ব্রামস এবং ইসমাইলের ব্যাখ্যা, ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে জেতা মানে জেতার সম্ভাবনা পাঁচ ভাগে তিন ভাগ। সুতরাং, যে দল প্রথম পেনাল্টি মারছে, সে দল প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে জেতার ব্যাপারে ৫০ শতাংশ এগিয়ে থাকে। ইসমাইল বলেছেন, এই বাড়তি সুবিধের কথা ফুটবল দলের কোচ থেকে খেলোয়াড়, সবাই জানেন। সমীক্ষা করতে তিনি এবং ব্রামস প্রচুর কোচ এবং খেলোয়াড়কে প্রশ্ন করেছেন, টসে জিতলে আগে না পরে, কখন পেনাল্টি মারতে চান? নব্বই শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে উত্তর: অবশ্যই আগে।
ব্রামস কিংবা ইসমাইল কেউই ফুটবল-পাগল নন। অধ্যাপনা এবং গবেষণার সূত্রে ওঁরা পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট। সেই সুবাদে ওঁদের আগ্রহ এক বিশেষ বিষয়ে। কী? বিষয়টার পোশাকি নাম ‘কেক কাটা’। পাঠক হাসবেন না, বিষয়টা গণিতে এক মস্ত ধাঁধা। দু’জনের মধ্যে ভাগ হবে কেক। দু’জনেরই ধারণা, সে ঠকবে আর অন্য জন জিতবে। সে ধারণা নির্মূল করে সুবিচারের উপায়? তা আছে। এক জন কেক কাটবে, অন্য জন তার পছন্দসই খণ্ড নিজের ভাগে নেবে। সুষম বণ্টন। কিন্তু যদি কেকের প্রত্যাশী হয় তিন বা তার চেয়েও বেশি জন? তখন ঈর্ষাহীন বণ্টন রীতিমতো জটিল। সুবিচার আর অবিচারের ওই প্রশ্নেই ব্রামস এবং ইসমাইল টাইব্রেকারে আগ্রহী।
টাইব্রেকারের চালু নিয়মে অবিচার মুছে সুবিচার আনতে দুই গবেষক দু’-দু’টো বদলের পরামর্শ দিচ্ছেন। কী রকম? ধরা যাক, দু’টো টিম ‘এ’ আর ‘বি’। যদি টাইব্রেকারের আগে ‘এ’ টিম টসে জেতে, তা হলে চালু নিয়মে প্রায়ই দেখা যায়, পেনাল্টি মারার রাউন্ডগুলো হয়— এবি, এবি, এবি, এবি, এবি (যদি না তাতেও টাই হয় এবং তার পরেও পেনাল্টি পর্ব চলে)। এই প্রথা পাল্টে ব্রামস এবং ইসমাইলের পরামর্শ: রাউন্ডগুলো হোক— এবি, বিএ, এবি, বিএ, এবি। আর পাঁচটার বদলে মোট ছ’টা রাউন্ড চান দুই গবেষক। তাতে দু’দলই সমান সংখ্যায় প্রথম পেনাল্টি মারার সুযোগ পাবে।
সুবিচার আরও বাড়াতে ব্রামস এবং ইসমাইল আরও এক পরামর্শ দিচ্ছেন। এবি-এবি-র বদলে এবি-বিএ শুধু নয়। ওঁরা বলছেন, দ্বিতীয় থেকে এক এক রাউন্ডে প্রথমে পেনাল্টি মারুক সে দল, যে দল আগের বার অকৃতকার্য হয়েছে। আর যদি আগের বার দু’দলই গোল দেয়, বা দু’দলই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়? তা হলে আগের বার যে দল পরে পেনাল্টি মেরেছে, সে দল এ বার মারুক আগে।
ব্রামস এবং ইসমাইল তাঁদের পরামর্শ পাঠিয়েছেন ফিফা-র কাছে। এই গ্রহে ফুটবলের উচ্চতম নিয়ামক সংস্থা কান দেবে কি?