নায়ক: জোড়া গোল করে ম্যাচের সেরা চেরিশেভ। ছবি: গেটি ইমেজেস
বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই সৌদি আরবকে পাঁচ গোল দিয়ে চমকে দিল রাশিয়া।
খেলার শুরু বারো মিনিটের মধ্যেই ইউরি গাঝিনস্কির গোলের সময় স্টেডিয়ামে যে শব্দব্রহ্ম তৈরি হল, তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল ভরা যুবভারতীতে বড় ম্যাচে গোল করার মধুর স্মৃতি। রাশিয়ার হয়ে জোড়া গোল করলেন দিনিস চেরিশেভও। বাকি গোলদাতা আর্তেম জিউবা ও আলেকজান্দার গোলোভিনও। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন জয়ের নায়ক চেরিশেভ। জায়ান্ট স্ক্রিনে যাঁর ছবি ভেসে উঠতেই দেখলাম, হাততালি দিচ্ছেন স্টেডিয়ামে হাজির দিয়েগো আমার্ন্দো মারাদোনাও। স্ক্রিনে ফুটবলের রাজপুত্র দেখে সে কী উল্লাস লুঝনিকির দর্শকদের!
রাশিয়ার জয়ের দিনে চমক কিন্তু রুশ সমর্থকরাই। গত তিন দিন মস্কোর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু রাশিয়ার জার্সি গায়ে জনা পঞ্চাশেক সমর্থক ছাড়া আর সে ভাবে চোখে পড়েনি রুশ সমর্থক। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম দিনেই স্টেডিয়াম ভরিয়ে দিলেন তাঁরা। তুলনায় সৌদি আরবের সমর্থকেরা সংখ্যায় ছিলেন অনেক কম।
গত চার বছরে রাশিয়াকে কম বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়নি। কখনও মাথাচাড়া দিয়েছে ইউক্রেন, ক্রিমিয়াকে নিয়ে সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, সিরিয়ায় বাশার-আল আসাদের সরকারকে সামরিক সাহায্য দেওয়া নিয়ে বিতর্ক, বিশ্বকাপের সময় জঙ্গি-হামলার চোখরাঙানি— এ দিন মস্কোয় বিশ্বকাপের জাঁকজমক উদ্বোধন করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন বললেন, ‘‘বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় সবাইকে স্বাগত’’, তখন তৃপ্তির হাসি তাঁর মুখে। যা ধরা পড়ল জায়ান্ট স্ক্রিনে। আর রুশদের জাত্যাভিমান এতটাই প্রবল, যে দলে দলে স্টেডিয়ামে এসে তাঁরাও দেখিয়ে দিলেন সফল ভাবে বিশ্বকাপ সংগঠনে কতটা আবেগ তাঁদের মধ্যে।
লুঝনিকি স্টেডিয়ামের কাছেই মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই ‘ফ্যান জোন’ তৈরি করেছে ফিফা। সেখানেও তিল ধারণের জায়গা ছিল না। আমার হোটেলে থেকে মস্কো শহর ৩০ কিমি দূরে। তিন দিন আগেই রুশ প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বকাপের সময় ব্যক্তিগত যানবাহন রাস্তায় না নামানোর জন্য। কারণ তাতে ট্র্যাফিক জ্যাম বাড়তে পারে।
বর্ণময়: শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপ। লুঝনিকি স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আগুনপাখিতে সওয়ার আইদা গারিফুলিনা। বৃহস্পতিবার। ছবি: এএফপি
বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ শুরু হওয়ার সময় ছিল স্থানীয় সময় সন্ধে ৬টায়। হোটেল থেকে বেলা ১১টায় বেরিয়ে দুপুর তিনটের মধ্যেই ঢুকে পড়েছিলাম স্টেডিয়ামে। ম্যাচ শুরুর প্রায় তিন ঘণ্টা আগে।
উদ্বোধন উপলক্ষে যেন চাঁদের হাট বসেছিল লুঝনিকিতে। ‘লেট মি এন্টারটেন ইউ...’ গেয়ে রবি উইলিয়ামস যখন স্টেডিয়ামে মাতাচ্ছেন, তখনই মাঠে এলেন ১৬ বছর আগে বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিলের রোনাল্ডো। রুশ সুন্দরীরাও এ দিন সেজে এসেছিলেন তাঁদের চিরাচরিত সাজে। রোনাল্ডোর সঙ্গেই মাঠে ঢুকল এক বিশাল ‘আগুন-পাখি’। তাঁর পিঠে চেপেই এলেন রুশ গায়িকা আইদা গারিফুলিনা। তার পরে শুরু হল রবি ও আইদার গান। যে গানে মেতে যায় বর্ণময় গ্যালারি। সেখানে যেন এ দিন লাল-নীল-সবুজ-হলুদের মেলা বসেছিল। এর পরেই বিশ্বকাপ-সহ মাঠে হাজির স্পেনের প্রাক্তন গোলকিপার ইকের ক্যাসিয়াস। যিনি বিশ্বকাপ হাতে তুলেছিলেন আট বছর আগে।
আমার পিছনেই বসেছিলেন ইরানের নাগরিক আলি আশকান। ভারতীয় শুনে বিরতিতে আলাপ করে গেলেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ক্রিকেটের মতো ফুটবলের বিশ্বকাপেও ভারতীয়রা নেই কেন? বিশ্বকাপের এই মিলনমেলায় যোগদানের মজাই তো আলাদা।’’
রাশিয়ায় ফুটবল-মাস শুরুর দিনে আশকানের এই কথাটিই আনন্দের মাঝে বেদনা।