Sport News

বয়স হার মেনেছে ইচ্ছাশক্তির কাছে, রাশিয়া চললেন বাঙালি দম্পতি

সংসারের দায়িত্ব সামলেও শুধুমাত্র ফুটবলের প্রতি আবেগ আর ভালবাসায় চট্টোপাধ্যায় দম্পতি পাড়ি দেন বিশ্বকাপের আসরে, সশরীরে ফুটবলের মহাযুদ্ধ চাক্ষুষ করতে।

Advertisement

আকাশ ভট্টাচার্য্য

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৮ ১৬:০০
Share:

টানা দশটা বিশ্বকাপ মাঠে বসে দেখার নজির গড়ে ফিরতে চান চট্টোপাধ্যায় দম্পতি।— নিজস্ব চিত্র।

বার্ধক্যে পৌঁছেছেন অনেক বছর আগেই। তবু সেই বার্ধক্য ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে বার বার।

Advertisement

আজও না থেমে চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি উঠে যান দু’জনেই। জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করেছেন একে অপরের হাত ধরে। আজও সেই বন্ধন অটুট। খিদিরপুরে রাম কমল স্ট্রিটের বাড়িটা আজ তাঁদের জন্যই পরিচিতি পেয়েছে। নিজেদের গড়া এক ‘অদ্ভুত’ কীর্তির সুবাদে মিলেছে ‘সেলিব্রিটি দম্পতি’র তকমা।

বছর চুরাশির পান্নালাল চট্টোপাধ্যায় এবং ছিয়াত্তর ছুঁই ছুঁই চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের নেশাটা আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি দম্পতির মতো নয়। ফুটবলের শহর কলকাতা যখন টেলিভিশনে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাদ পায়, এই দম্পতি শুরু করেছিলেন একটা ধাপ এগিয়েই। সোজা স্পেন উড়ে গিয়ে মাঠে বসে বিশ্বকাপ দেখে ফিরেছিলেন দু’জনেই। সালটা ১৯৮২। সেই থেকে শুরু। এর পর আর একটিও বিশ্বকাপ মিস করেননি তাঁরা। ১৯৮২ থেকে ২০১৪— মোট ন’টা বিশ্বকাপ মাঠে বসে দেখেছেন দু’জনে। এ বার তাঁদের গন্তব্য রাশিয়া বিশ্বকাপ।

Advertisement

আরও পড়ুন
বিশ্বকাপের শেষ চারে কারা? মোরিনহো বলছেন...

একটানা ১০টি বিশ্বকাপ দেখার নজির গড়তে চলেছেন তাঁরা। কেমন ছিল শেষ ন’টি বিশ্বকাপ দেখার অভিজ্ঞতা?

প্রথম বিশ্বকাপ দেখার স্মৃতির কথা তুলতেই পান্নালালবাবু বলে উঠলেন, ‘‘৩৬ বছর আগের স্মৃতি আর মনে পড়ে না।’’ কাদের ম্যাচ ছিল সেটাও মনে করতে পারলেন না তিনি। আর ১৯৮৬... কথা শেষ না হতেই বৃদ্ধ বললেন, ‘‘মোস্ট মেমোরেবল টুর্নামেন্ট আই হ্যাভ এভার সিন। ওই বিশ্বকাপ ভোলার নয়। সাত-আট জনের মার্কিং ভেদ করে একের পর এক ডজ করে চল্লিশ মিটারের দূরপাল্লা শট থেকে মারাদোনার সেই গোল দেখা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।’’

আরও পড়ুন
‘পায়ে পায়ে রাশিয়ায় আজ রাজসূয়’

পান্নালালবাবুর কথা থামতেই শুরু করলেন চৈতালী দেবী। ‘হ্যান্ড অব গড’-এর প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বললেন, ‘‘সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পুরো স্টেডিয়াম লাফাচ্ছিল। মাঠে বসে সত্যিই বোঝার উপায় ছিল না যে, বলটা হাতে লেগে গোলে ঢুকে যাচ্ছে। তবে মারাদোনার সেই ডিফেন্স চেরা দৌড় সত্যিই টিভিতে দেখে মন ভরে না। তবে আমরা দু’জনেই কিন্তু ব্রাজিলের সমর্থক।’’

পান্নালালবাবু তখন কিছুটা চুপচাপ, একটু ক্লান্তও বটে। হঠাৎই সেলিব্রিটি হয়ে ওঠায় নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন তিনিও। মাঝেমধ্যেই বলে উঠছেন, ‘‘ভাইটি শেষ কর। শরীর দিচ্ছে না, তোরা বাপু যে কেন আগে আসিস না বুঝি না।’’ থামিয়ে দিলেন চৈতালী দেবী, বললেন, ‘‘আমাকে জিজ্ঞাসা করো আর কী কী জানতে চাও।’’

এই নিয়ে ন’টা দেশ ঘুরলেন। ন’টা আলাদা ভাষা, পরিবেশ.... প্রশ্নটা শেষ করতে হল না। চৈতালী দেবী বললেন, ‘‘ নাহ্। কোনও অসুবিধা হয় না। ফুটবলটাকে ভালবাসি তো। হয়তো সেই জন্যই সব ঠিক হয়ে যায়। আর বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবকরা তো অনেক ভাষাই জানেন, প্রতিটা মাঠে বয়স্কদের জন্য সেই মতন ব্যবস্থা থাকে— জল, হুইল চেয়ার, টয়লেট সবই সহজলভ্য। আর ওয়েদারও ভগবানের ইচ্ছায় মানিয়ে যায়, অসুবিধা হয় না।’’

চৈতালী দেবীর কথা শেষ হতেই ফের শুরু করলেন পান্নালালবাবু, ‘‘বছরে দুই-তিন বার সিকিম যাই। ওরা এই চ্যাটার্জীদাকে ছাড়ে না। ওঁরা আমাকে আর আমার ফুটবল দেখার নেশাকে ভালবাসে। আমি শুধু মাঠ চিনি, শুধু মাঠ।’’ আর তাঁর সর্ব ক্ষণের সঙ্গী স্ত্রী চৈতালী দেবী। মাঠপাগল পান্নালালবাবুর যাবতীয় দায়িত্ব, থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত সব সামলান তাঁর স্ত্রী।

ওরা বলতে এআইএফএফ-এর কথা বলছিলেন পান্নালালবাবু। নিজেও ফুটবল খেলতেন। কলকাতা পোর্টে চাকরিও করতেন। শৈলেন মান্না, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সকলের সঙ্গেই সদ্ভাব তাঁর। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য পান্নালালবাবু এখনও সিকিম ফুটবল, সিকিম গোল্ড কাপ— অনেক টুর্নামেন্টের পুরোভাগে আছেন।

বিয়ের পর বেশির ভাগ মেয়েকেই শ্বশুরবাড়ি এক অন্য পরিবেশে, অচেনা মানুষদের সঙ্গে সংসার করতে হয়। সেখানে চৈতালী দেবী অনেকটাই আলাদা। সংসারের দায়িত্ব সামলেও শুধুমাত্র ফুটবলের প্রতি আবেগ আর ভালবাসায় পাড়ি দেন বিশ্বকাপের আসরে, সশরীরে ফুটবলের মহাযুদ্ধ চাক্ষুষ করতে। আদ্যন্ত ব্রাজিল সমর্থক এই দম্পতি ফুটবল বিশ্বকাপ দর্শনেই তীর্থযাত্রার আনন্দ খুঁজে পান। এখানেই তাঁরা অনন্য। তবে নেমারের চোট নিয়ে বেশ আশঙ্কার সুর শোনা গেল চৈতালী দেবীর গলায়।

পান্নালালবাবু ছোট থেকেই একটু জেদি স্বভাবের, একরোখাও। তবে এই অনন্য কীর্তিতে তাঁর মায়ের অবদান জানাতে ভোলেননি তিনি। বলছিলেন, ‘‘১৯৮২-র বিশ্বকাপে একটি ম্যাচ দেখে ভেবেছিলাম যে এত বাঙালি বিশ্বকাপ দেখতে যায়, আমিও তো যেতে পারি। আমার এই উদ্যোগে প্রথমেই উৎসাহ দিয়েছিলেন আমার মা। মা বললেন, অবশ্যই যাবি, আরও পরিশ্রম কর। আর আমার গুরু বিশ্বনাথ দত্ত আমাকে সব সময়েই সাহস জুগিয়ে গেছেন।’’ সেই থেকেই পথ চলা শুরু।

মেক্সিকোর হোটেলে পেলে-র সঙ্গে সাক্ষাৎ। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

কথা শেষ করেই ফের বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন পান্নালালবাবু। একটু অনুরোধ করতেই বললেন, ‘‘ফিফা থেকে আমাদের দু’জনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শেষ অনূর্দ্ধ-১৭ বিশ্বকাপে কলকাতায় সব ম্যাচেই আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন কর্মকর্তারা। তবে রাশিয়া বিশ্বকাপে এখনও ফিফার তরফে কোনও রকম সাড়া পাইনি।’’ মাসে ১১ হাজার টাকা পেনশন পান বৃদ্ধ। তার থেকেই ২-৩ হাজার টাকা জমিয়ে রাখেন শুধুমাত্র চার বছর অন্তর তাঁদের বিশ্বকাপ ফান্ডে যাতে কম না পড়ে। তবুও এ বছর ফিফার এ হেন অসহযোগিতার কথা বেশ আক্ষেপের সুরেই বলছিলেন এই বৃদ্ধ দম্পতি।

আগামী ১৫ই জুন মস্কোর বিমান ধরবেন ওই দম্পতি। সঙ্গে যাবে আরও পাঁচ জনের একটি দল। ফেরার কথা ২৮ জুন। তবে নক-আউট পর্বের টিকিট পেলে এবং পর্যাপ্ত টাকা থাকলে তবেই আরও দুই-চার দিন থাকার ইচ্ছা চৈতালী দেবীর। না হলে ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা এবং মরক্কোর একটি করে ম্যাচ দেখেই ফিরতে হবে তাঁদের— এমনটাই বলছিলেন দু’জনে। টিকিটের দামও প্রচুর। ম্যাচ প্রতি ৮৫ হাজার।

কথা চলতে চলতেই আলমারি থেকে অনেক ফোটো, ম্যাচ টিকিট বার করে আনলেন অশীতিপর চৈতালী দেবী। বললেন, ‘‘এগুলো সাবধানে দেখো। সব অমূল্য সম্পদ আমাদের কাছে।’’ দু’-চারটে ছবি ওল্টাতেই মিলল সত্যিই এক দূর্মুল্য ছবি। চট্টোপাধ্যায় দম্পতির সঙ্গে পেলে-র ছবি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চৈতালী দেবী বললেন, ‘‘১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ। পাশের হোটেলেই ছিলেন পেলে। আগে এক বার কলকাতায় ইডেনে খেলতে এসে ক্ষণিকের সাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের সঙ্গে। মেক্সিকোর হোটেলের ভিআইপি গেটের সামনে আসতেই পেলে আমাকে দেখে বললেন, ম্যাডাম ইউ হ্যাভ কেম এগেন! বোধ হয় আমার শাড়ি দেখে চিনতে পেরেছিলেন, না হলে অত বড় লেজেন্ডের পক্ষে আমাকে চেনা সম্ভব নয়। যাই হোক, ছবি তোলার অনুরোধ করতেই দাঁড়িয়ে পড়লেন মাঝখানে।’’

বিদেশের মাঠেও তেরঙ্গা উড়িয়েছেন পান্নালালবাবু-চৈতালী দেবী। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

বৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘‘মিশেল প্লাতিনি, ইউসেবিও অনেকের সঙ্গেই সখ্য হয়েছে। দেখা হলে আলাপ হয়। তবে আধুনিক যুগের মেসি, রোনাল্ডোদের সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়নি, ইচ্ছা আছে।’’ তবে খরচ নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন দম্পতি। এ বছর বাজেট প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি। তাতেও আশঙ্কা অর্থ ঘাটতির। সে কথাই বার বার বলছিলেন দু’জনে। বিশ্বের কোথায় না কোথায় ম্যাচ দেখেছেন পান্নালালবাবু-চৈতালী দেবী। ভারতীয় ফুটবলের প্রসঙ্গ তুলতেই পান্নালালবাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘‘একশো বছর পিছিয়ে আছি আমরা। বিদেশে একটা বলের দাম ৩০ হাজার টাকা, সঙ্গে নানা প্রযুক্তি। আমাদের দেশে পাঁচ-সাতশো টাকার বলে এখনও টুর্নামেন্ট হয়। কী ভাবে এগোব আমরা! ফুটবলার চোট পেলেই এখানে ডাক্তার তিন সপ্তাহ বিশ্রামে পাঠিয়ে দেন। আর বিদেশে নো ডাক্তার, নো মেডিসিন, মেশিনে চেক করে বোঝা যায় প্লেয়ার আনফিট কি না। এখানেই পিছিয়ে ভারতীয় ফুটবল।’’

‘ব্যস, আর কিছু বলার নেই,’— এই বলেই উঠে গেলেন পান্নালালবাবু। তত ক্ষণে চৈতালী দেবীও বেশ ক্লান্ত। তবুও নিজে থেকেই অনেক অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন তিনি, প্রত্যেকটা ছবি নিজেই দেখালেন। ১৯৮২-র পাওলো রোসি-র স্কিল থেকে শেষ মারাকানার ফাইনালে মারিও গোৎজে-র গোলে জার্মানির চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়— সবই যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতালী দেবীর।

২০২২ কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে আপাতত আশা ছেড়েছেন দু’জনেই। এখন সুস্থ অবস্থায় রাশিয়া বিশ্বকাপ দেখে টানা দশটা বিশ্বকাপ মাঠে বসে দেখার নজির গড়ে বাড়ি ফিরতে চান ওই দম্পতি। ফুটবলের শহর কলকাতায় বিশ্বকাপ জ্বর শুরু হয়েছে কিছু দিন আগেই। তবে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে বিশ্বকাপ প্ল্যানিং শুরু হয়েছে সেই ২০১৪ থেকেই। ফের একটা বিশ্বকাপ। ফের একটা নজির। আধুনিক বিশ্বের এই ‘বিশ্বকাপ দম্পতি’ আজ সেই বিরল নজিরের সামনে দাঁড়িয়ে। এমন অনন্য উদ্যোগকে শুধু কুর্নিশ জানালে বোধ হয় কম হবে। ফুটবলের জয়োধ্বজা উড়িয়ে এই দম্পতি সত্যিই অনন্য সাধারণ। এ যেন ফুটবলের জয়। এই জয় ইচ্ছাশক্তির।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement