নোভাক জোকোভিচ। ছবি: রয়টার্স।
রজার ফেডেরারকে স্পর্শ করেছেন, টপকে গিয়েছেন। রাফায়েল নাদালকে ছুঁয়েছেন, রবিবার তাঁকেও ছাপিয়ে গেলেন। অথচ প্রথম দু’জনের থেকে কিছুটা দেরিতে গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিকার শুরু করেছিলেন নোভাক জোকোভিচ।
ভক্তরা আদর করে তাঁকে ডাকেন জোকার বলে। সার্ব টেনিস তারকা বোধ হয় জোকারই। টেনিসপ্রেমীদের আনন্দ দেন। সেই আনন্দ দেওয়ার পিছনে রয়েছে কঠিন পরিশ্রমের দিনলিপি।
জোকোভিচের নামের পাশে ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। ওপেন যুগের সব থেকে সফল তিন টেনিস খেলোয়াড়ের মধ্যে তিনি সফলতম। ৩৬ বছরেও অক্লান্ত। বয়সে যাঁরা ১৪-১৫ বছরের ছোট, তাঁরাও কোর্টের লড়াইয়ে জোকোভিচের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না। জোকার এঁটে উঠতে দিচ্ছেন না। শুধুই কি অভিজ্ঞতা? না। নিজের টেনিস দক্ষতাকে এমন পর্যায় নিয়ে গিয়েছেন, যেখান থেকে হারাই কঠিন। জোকার কি হারেননি? হেরেছেন বহু ম্যাচ। পরিসংখ্যান বলছে, ৬ ফুট ২ ইঞ্চির জিতেছেন ১০৫৮টি সিঙ্গলস ম্যাচ। হেরেছেন ২১০টি খেলায়। ধারাবাহিকতা নিরবচ্ছিন্ন। টেনিসজীবনে চোট-আঘাত লেগেছে। আবার কোর্টে ফিরে এসেছেন। খেতাব জিতেছেন। জিতেই চলেছেন।
তা হলে কি ফেডেরার, নাদালের থেকেও বড় মাপের খেলোয়াড় জোকোভিচ? তিন তারকার গ্র্যান্ড স্ল্যামের লড়াই যেমন টান টান, তেমনই ভক্তের সংখ্যাও। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে। পছন্দের ক্রমও থাকতে পারে। কিন্তু জোকোভিচকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। রবিবার ফরাসি ওপেন জেতার পর জোকোভিচ জানিয়েছেন, তিনি সেরা নন। বলেছেন, ‘‘কে সেরা, এই আলোচনাতে ঢুকতেই চাই না। আমি শুধু ইতিহাস লিখছি।’’
টেনিস ইতিহাসে জোকোভিচকে নিয়ে একটা অধ্যায় রাখতেই হবে টেনিস লিখিয়েদের। না রাখলে অসম্পূর্ণ থাকবে ইতিহাস। একই কথা প্রযোজ্য ফেডেরার এবং নাদালের ক্ষেত্রেও। ইউরোপের ছোট দেশ সার্বিয়া থেকে উঠে এসেছেন টেনিসগ্রহে। উল্কার গতিতে উঠে আসা জোকার এখন টেনিস গ্রহের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আধুনিক টেনিসের স্বর্ণ যুগে খেলেছেন। খেলছেন। গোটা টেনিসজীবনে তাঁর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছেন ফেডেরার এবং নাদাল। তাঁদের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা জোকোভিচের লক্ষ্য পথে কুয়াশা তৈরি করতে পারেনি। গ্র্যান্ড স্ল্যাম অভিযান বিঘ্নিত করতে পারেননি দুই প্রবল প্রতিপক্ষ।
সার্বিয়া, স্পেন এবং সুইৎজারল্যান্ড— ইউরোপের এই তিন দেশ দু’দশক ধরে শাসন করে চলেছেন পুরুষদের টেনিস। পরস্পরের সাম্রাজ্যে অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু কেউ কারও আসন টলাতে পারেননি। ফেডেরারের ২১টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মাত্র একটি সুরকির কোর্টে। নাদালের ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মাত্র দু’টি ঘাসের কোর্টে। জোকোভিচের ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের তিনটি ফরাসি ওপেন।
জোকার কি একটু এগিয়ে থাকলেন। তিনি নিজেই তো নিজেকে এগিয়ে রাখতে রাজি নন। দুই প্রধান প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা বা সমীহ হতে পারে। নিজেকে চূড়ান্ত সফল না ভাবা হতে পারে। ব্যক্তিগত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারা হতে পারে। জীবনে ৯৪টি খেতাব জিততে পারেননি এমন টেনিস খেলোয়াড়ের সংখ্যা গুনে শেষ হবে না। নাদালও (৯২টি) পারেননি।
চার বছর বয়সে জোকোভিচ যখন প্রথম টেনিস র্যাকেট হাতে নিয়েছিলেন, কখন তাঁর বাবা-মা বলেছিলেন, ‘‘এটা তোমার জন্য নয়’’। ভাগ্যিস তাঁরা জোকোভিচের হাত থেকে টেনিস র্যাকেট কেড়ে নেননি! উৎসাহে ভাঙচি দেওয়ার লোকও কম ছিল না। জোকোভিচ বলেছেন, ‘‘সার্বিয়ার মতো ছোট একটা দেশ থেকে এসেছি। বাবা-মা তো বটেই অন্য পরিচিতরাও আমাকে অনেক বার সাবধান করেছিলেন। তাঁদের বলতেন, ‘টেনিসের মতো একটা চূড়ান্ত পশ্চিমী খেলায় তোমার সম্ভাবনা নেই। টেনিস বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা তো বটেই। প্রচুর খরচ সাপেক্ষ।’’’
২০১০ সালের মধ্যে ফেডেরার ১৬টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে ফেলেছিলেন। নাদালের জেতা হয়ে গিয়েছিল ন’টি। জোকোভিচের ঝুলিতে ছিল মাত্র একটি। ফেডেরার বছর পাঁচেকের বড় হলেও নাদালের থেকে জোকোভিচ এক বছরের ছোট। ২০১০ সালের শেষে জোকোভিচের মনে হয়েছিল, বড়দের কথাই ঠিক! ভুল ভেবেছিলেন। কিন্তু ভুল করেননি।
জোকোভিচের আগে কোনও সার্ব গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারেননি। যে টেনিসের জন্য বাবা-মার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, তা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি। ফেডেরার, নাদালের সাফল্য দেখে তাক লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হলেও ধৈর্য্য হারাননি। ২০০৭ সালে ইউএস ওপেন ফাইনালে ফেডেরারের কাছে স্ট্রেট সেটে হারার পর ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন জোকার। সেই শুরু। দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল পাক্কা তিন বছর। ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার পর উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেনেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। আর আটকানো যায়নি রক্তের (পড়ুন সাফল্যের) স্বাদ পেয়ে যাওয়া জোকারকে। রবিবার ফরাসি ওপেনে জয়ের পর নাদাল সমাজমাধ্যমে জোকোভিচকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন, ‘‘অসাধারণ প্রাপ্তির জন্য অনেক অভিনন্দন। ২৩ এখন একটা সংখ্যা। কয়েক বছর আগে এটা ভাবাও যেত না। তুমি সেটা করে দেখালে। পরিবার এবং দলের সঙ্গে উপভোগ কর।’’
ফেডেরার, নাদাল এবং জোকোভিচ— পরস্পরকে কোর্টে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েননি। আবার অন্যের সাফল্যের প্রশংসা করতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি। পরস্পরের সাফল্যের সামনে প্রাচীর গড়ে তুলেছেন। কিন্তু বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। রবিবার জোকোভিচ বলেছেন, ‘‘সব সময় নিজেকে সেই দু’জনের সঙ্গে তুলনা করেছি, যারা আমার সব থেকে বড় প্রতিপক্ষ। আগেও বলেছি, ওরাই আমাকে এক জন খেলোয়াড় হিসাবে এখানে নিয়ে এসেছে। আমার সব সাফল্যের পিছনে ওদের অবদান রয়েছে। ওদের হারাতে হলে কী করতে হবে, সে জন্য অসংখ্য ঘণ্টা ভাবতে হয়েছে আমাকে। শুনতে হয়তো ভাল লাগছে নাদালের থেকে আমি একটা বেশি জিতেছি। মনে রাখবেন ওরাও নিজেদের ইতিহাস লিখেছে।’’
(বাঁদিক থেকে) জোকোভিচ, নাদাল এবং ফেডেরার। ছবি: টুইটার।
২৩ হয়ে গিয়েছে। জোকোভিচ কি পারবেন ২৫টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে? ভক্তরা কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিয়েছেন। কার্লোস আলকারাজ, ক্যাসপার রুডের মতো আগামী দিনের তারকারা এখনও হারাতে পারছেন না জোকোভিচকে! তাঁদের পারতে পারতে ২৫ হয়ে যেতেই পারে। আগামী বছর সুস্থ হয়ে কোর্টে ফিরবেন নাদাল। ফেডেরার অবসর ভেঙে ফেরার কথা বলেননি। এ টুকুই স্বস্তি! কিসের স্বস্তি? ফেডেরার, নাদালরা যখন সেরা ছন্দে তখনও তো গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন জোকোভিচ। ঠিক যেমন তাঁরাও জিতেছেন।
চ্যাম্পিয়নদের কাছে কারও থাকা বা না থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁদের কাছে আসল হল নিখুঁত পারফরম্যান্স। ভুল কি কিছুই করেন না সেরা খেলোয়াড়রা? অবশ্যই করেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের লড়াই, কে বেশি ভাল তার নয়। কম ভুল করার প্রতিযোগিতা। যত কম ভুল, তত তাড়াতাড়ি গেম, সেট, ম্যাচ। বছরের প্রথম দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা হয়ে গিয়েছে জোকোভিচের। টেনিসজীবনে প্রথম বার ক্যালেন্ডার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার সুযোগ রয়েছে তাঁর সামনে।
৩৬ বছরের জোকোভিচ ২৩তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার পর বলেছেন, ‘‘আমি জানি আমি কী। জানি কী করতে পারি। নিজের সক্ষমতা জানি। আমি বিশ্বাসী। প্রবল আত্মবিশ্বাসী। আমি যে এখনও ভাল ফল করতে পারি, তার প্রমাণ এই ট্রফিটা। এটাই আমার অনুভূতি।’’
ফেডেরার, নাদালকে পিছন থেকে ধাওয়া করে এগিয়ে গিয়েছেন জোকোভিচ। জেতা হয়ে গিয়েছে ১০ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, তিন বার ফরাসি ওপেন, সাত বার উইম্বলডন, তিন বার ইউএস ওপেন। এখনও জেতা হয়নি অলিম্পিক্স সোনা। জোকোভিচের টেনিসজীবনে এখনও পর্যন্ত খামতি বলতে এটুকুই। অলিম্পিক্স সোনা যে কোনও খেলোয়াড়ের কাছেই স্বপ্ন। ফেডেরারের কাছেও নেই এই পদক। নাদালের আছে। পুরুষদের গত দু’দশকের টেনিসে তিন জনই পরস্পরের পরিপূরক।
জোকোভিচ আরও কিছুটা এগোবেন নিশ্চিত। কোথায় থামবেন? জানেন না জোকারও। জোকোভিচেরা নিজেরাই ঠিক করেন সময়। ভাগ্যিস থামাননি তাঁর বাবা-মা।