(বাঁদিকে) শোয়েব মালিক এবং সানিয়া মির্জা। —ফাইল চিত্র।
টেনিস একা খেলা যায়। ক্রিকেট নয়।
বিচ্ছেদ জল্পনা শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় নিকাহ করে ফেললেন শোয়েব মালিক। সানিয়া মির্জ়া ‘একা’ হয়ে গেলেন ছেলেকে নিয়ে। পাকিস্তানের অলরাউন্ডারকে শরিয়ত আইন অনুযায়ী ‘খুলা’ দিয়েছেন।
সানিয়া-শোয়েবের বিচ্ছেদ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে। যদিও দুই ক্রীড়াবিদের কেউই প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি কখনও। সম্পর্কের জটিলতাকে জনসমক্ষে পেশ করেননি। সামাজিক সৌজন্য বজায় রেখেছেন। মশলাদার উপাদানে পরিণত করেননি মানসিক দূরত্বের কাহিনি। তবু সানিয়া-শোয়েবের রাখঢাক অবস্থানের আবডাল ভেঙে মাঝেমাঝে উঁকি দিয়েছে ভাঙনের ছবি। মানসিক পরিস্থিতি, অবসাদ, পারস্পরিক অনীহা ফুটে উঠেছে সমাজমাধ্যমে।
সানিয়ার মনের অবস্থার আভাস মাঝেমধ্যে পেয়েছে ভক্তকুল। শোয়েবের রক্ষণ ছিল তুলনায় মজবুত। সানিয়ার ইয়র্কার সামলে খেলেছেন শোয়েব। পাক ক্রিকেটারের বাউন্সারে সানিয়ার পাল্টা ‘খুলা’ উইনার।
দ্বন্দ্ব, দূরত্ব শুরু বছর দেড়েক আগে। ২০২২ সালের নভেম্বরের শুরুতে সানিয়া সমাজমাধ্যমে ছেলে ইজ়হানকে আদরের ছবি দিয়ে লিখেছিলেন, “ভাঙা হৃদয় কোথায় যায়? ঈশ্বর খুঁজতে।” “যে মুহূর্তগুলো কঠিন সময় পার করে দেয়।” বিচ্ছেদ জল্পনার সেই শুরু। কয়েক দিন পরেই শোয়েব ছেলের জন্মদিনে সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘‘বাবা তোমার পাশে সারা ক্ষণ থাকবে না। রোজ দেখাও হবে না। কিন্তু তোমার কথা আর মুখের হাসি প্রতি মুহূর্তে মনে করবে।’’ তখনই শোনা গিয়েছিল, নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছেন শোয়েব। তার আগেই নাকি দুবাইয়ে নতুন বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন ক্রীড়া দম্পতি। বিলাসবহুল সেই বাড়িতে যাওয়া থেকে অশান্তি শুরু হয়েছিল। নভেম্বরেই তাঁদের বিচ্ছেদ ঘিরে গুঞ্জন আরও তীব্র হয়েছিল। কারণ, তাঁদের কাছের এক পারিবারিক বন্ধু জানিয়েছিলেন, বিচ্ছেদ শুধু সরকারি ভাবে কার্যকর হওয়া বাকি।
এর কয়েক দিন পর ১১ নভেম্বর ২০২২, সমাজমাধ্যমে শুধু নিজের একটি ছবি দিয়েছিলেন সানিয়া। সঙ্গে কিছু লেখেননি। কয়েক দিন পরেই প্রকাশ্যে এসেছিল দু’জনের একসঙ্গে একটি পোস্টার। স্বামী শোয়েবের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সানিয়া। ‘উর্দুফ্লিক্স’ নামে একটি ওটিটি মাধ্যমে সানিয়া এবং শোয়েবের একসঙ্গে শো-য়ের ঘোষণা করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘দ্য মির্জ়া মালিক শো’। সে বছর ১৫ নভেম্বর সানিয়ার জন্মদিনে শোয়েব লিখেছিলেন, ‘‘সানিয়া, শুভ জন্মদিন। তোমার জীবন সুখে ভরে উঠুক। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হও, এই কামনা করি। আজকের দিনটা দারুণ ভাবে উপভোগ করো।’’ যদিও দুবাইয়ের বাড়িতে সানিয়ার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শোয়েবের ছবি দেখা যায়নি। জল্পনা এগিয়েছে নিজের গতিতে। এর মধ্যেই সবাইকে চমকে দিয়ে যুগলে এক সঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছিলেন নভেম্বরের শেষে। ‘দ্য মির্জ়া মালিক শো’-র শুটিংয়ে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল তাঁদের।
সুখের দিনে শোয়েব এবং সানিয়া। — ফাইল চিত্র।
বিচ্ছেদ নিয়ে সানিয়া প্রথম ইঙ্গিত দেন ২০২৩ সালের শুরুতে। ৭ জানুয়ারি সমাজমাধ্যমে টেনিস তারকা লেখেন, “আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব রয়েছে সেটা অন্যদের আলোচনার বিষয় নয়। নিজেদের প্রয়োজনেই এই দূরত্ব। এক জনের সঙ্গে শুধুমাত্র একটা দূরত্ব রয়েছে মানেই তাঁর ব্যবহার খারাপ এমন নয়। এটাও হতে পারে যে তাঁর ব্যবহার আমার জন্য সঠিক নয়।” যদিও দু’দিন পরেই সানিয়ার সঙ্গে নিজের ছবি দিয়ে শোয়েব জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন বলিউডের পরিচালক এবং কোরিয়াগ্রাফার ফারাহ খানকে। গত বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ছিল সানিয়ার শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম। তাঁর শেষ ম্যাচের ১০ ঘণ্টা পর সানিয়াকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শোয়েব সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “খেলাধুলোর জগতে সব মহিলাদের কাছেই তুমি আশার প্রতীক ছিলে। গোটা টেনিসজীবনে যা যা অর্জন করেছ, তার জন্য অত্যন্ত গর্বিত। তুমি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। এ ভাবেই শক্তিশালী হয়ে আগামী দিনে এগিয়ে যাও। অবিশ্বাস্য টেনিসজীবনের জন্যে অনেক শুভেচ্ছা।”
এপ্রিলে আবার জল্পনা বৃদ্ধি পায় সানিয়ার একটি পোস্ট ঘিরে। প্রিয়জনদের নিয়ে ইফতার পার্টি করেছিলেন সানিয়া। সমাজমাধ্যমে দিয়েছিলেন প্রিয়জনদের ভিডিয়ো। যাতে অনুপস্থিত ছিলেন শোয়েব। কয়েক দিন পরেই ছিল তাঁদের ১৪তম বিবাহবার্ষিকী। কেউ কাউকে শুভেচ্ছা জানাননি। কেউ কোনও পোস্ট করেননি সমাজমাধ্যমে। তাঁদের দূরত্ব যে তখনই অনেক বেড়ে গিয়েছিল, অনুরাগীদের বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি। বিবাহবার্ষিকী নিয়ে কয়েক দিন পরেই এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন শোয়েব। তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, ‘‘আমরা একসঙ্গে থাকার সময় পাচ্ছি না।’’ সম্পর্কের দূরত্বই আসলে দ্রুত কমিয়ে দিয়েছিল সময়। শোয়েবের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরের অর্থ বুঝতে সময় লাগেনি ক্রীড়াপ্রেমীদের। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায় গত অগস্টে। পাক অলরাউন্ডার ইনস্টাগ্রাম বায়ো থেকে ‘হাসব্যান্ড টু এ সুপারউওম্যান সানিয়া মির্জ়া’ (অসাধারণ মহিলা সানিয়ার মির্জ়ার স্বামী) কথাটি মুছে দেন। বদলে লেখেন, ‘ফাদার টু ওয়ান ট্রু ব্লেসিং’ (সত্যিকারের আশীর্বাদধন্য এক বাবা)। গত অক্টোবরে ছেলের জন্মদিনে দূরত্ব ফুটে উঠেছিল সানিয়ার একটি পোস্টেও। সমাজমাধ্যমে সানিয়া লিখেছিলেন, ‘‘আমার জীবনের সব থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে শুভ জন্মদিন। আমার চারপাশে যতই অন্ধকার হোক না কেন, তোমার হাসি সব কিছুকে আরও সুন্দর করে তোলে। আমি আশীর্বাদ হিসাবে তোমাকে পেয়ে আল্লাহের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তোমার মধ্যে দেখেছি নিঃশর্ত ভালবাসা কাকে বলে। সে জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। আমার ছোট্ট ছেলের জায়গা চিরদিন আমার হৃদয়ে থাকবে। প্রতি বছর আমি তোমাকে আরও বেশি কাছে ধরব। তোমাকে আরও একটু শক্ত করে আলিঙ্গন করব। তোমাকে সফল হতে সাহায্য করব। আল্লাহ তোমায় সব সময় আশীর্বাদ করুন।’’ এই লেখার সঙ্গে দিয়েছিলেন একাধিক ছবি। পরিবারের সকলের সঙ্গে ইজ়হানের ছবি থাকলেও বাদ পড়েছিলেন শোয়েব। ‘আমরা’র বদলে জায়গা পেয়েছিল ‘আমি’। এই ‘আমি’ আমিত্বের প্রকাশ ছিল না। শোয়েবহীন জীবনের একাকিত্বের কথাই হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন সানিয়া। যদিও পরের দিনেই শোয়েব একসঙ্গে তিন জনের ছবি দিয়েছিলেন সমাজমাধ্যমে। যদিও ইজ়হানের হাতে ঢাকা ছিল সানিয়া মুখ। শোয়েব শুধু লিখেছিলেন, “শুভ জন্মদিন বেটা। বাবা তোমাকে ভালবাসে।”
ছেলে ইজ়হানের সঙ্গে সানিয়া। — ফাইল চিত্র।
কয়েক দিন পরেই সানিয়া নিজের ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে লিখেছিলেন, “প্রত্যেক শক্তিশালী এবং স্বাধীন মহিলার পিছনে একটা ছোট্ট মেয়ে থাকে যে অন্যের উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে যায়।” এই পোস্ট দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন, সানিয়া হয়তো বাস্তবেই শোয়েবকে ছাড়া ‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে’ শেখার কথা বলতে চেয়েছেন।
সানিয়া-শোয়েব বিচ্ছেদের জল্পনা নানা খাতে বয়েছে। কখনও তীব্র হয়েছে। আবার কখনও সংশয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ঠিক কোন অবস্থায় রয়েছে তাঁদের দাম্পত্য, তা ঠাওর করা যায়নি। কেউ কাউকে দোষারোপ করেননি। কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি। মানসিক দূরত্ব বৃদ্ধি পেলেও, তা মাপতে পারেননি অনুরাগীরা। আসলে গোটা বিচ্ছেদ পর্বেই রক্ষণ জমাট করে মেপে খেলেছেন দুই ক্রীড়াবিদ। শোয়েব যেমন কোনও আলগা শট খেলেননি, তেমনই সানিয়াও করেননি কোনও আনফোর্সড এরর।
শোয়েবের তৃতীয় বিয়ের খবর বোধহয় কয়েক দিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিল সানিয়ার কানে। কয়েক দিন আগেই সমাজমাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে শোয়েবের সব ছবি মুছে দেন সানিয়া। শুধু ছেলে ইজ়হানের সঙ্গে দু’জনের একটি ছবি ছাড়া। আর গত ১৭ জানুয়ারি তিনি যা লিখেছিলেন, তার অর্থ ছিল, ‘‘বিয়ে কঠিন। বিচ্ছেদও কঠিন। নিজের কঠিনটাকে বেছে নিন। স্থূলতা ভাল নয়। ফিট থাকাও কঠিন। নিজের কঠিনটা বেছে নিন। ঋণের মধ্যে থাকা কঠিন। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন। নিজের কঠিনটা বেছে নিন। যোগাযোগ রাখা কঠিন। যোগাযোগ না রাখাও কঠিন। নিজের কঠিনটাকে বেছে নিন। জীবন কখনও সহজ নয়। এটা সব সময় কঠিন। কিন্তু আপনি আপনার কঠিনটা বেছে নিতে পারেন। বেছে নিন।’’ আর কয়েক দিন আগে শোয়েব ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলেছিলেন, “অনেকেই তো বলছে আমাদের সম্পর্ক নাকি ভাল নেই। আপনাদের কী মনে হয়?”
সানিয়া বার বার আবেগপ্রবণ হলেও শোয়েব কখনও ভাঙেননি। তৃতীয় স্ত্রী সানা জাভেদকে সরাসরি প্রকাশ্যে নিয়ে এসে চমকে দিয়েছেন। পাক অলরাউন্ডারের তিস্রার খোঁজ কি আগেই পেয়েছিলেন সানিয়া? না হলে কেন শোয়বকে মুছে ফেলেছিলেন ক’দিন আগেই। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ধারাভাষ্য দিতে ব্যস্ত ভারতের একমাত্র মহিলা গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী চাইলে একটা ‘এস’ সার্ভিস করতেই পারতেন। করেননি। ফোরহ্যান্ড আগেই মেরে দিয়েছেন তিনি।
সানিয়া-শোয়েবের হাঁড়ি ভাগ হয়ে গেলেও, তাঁদের হাঁড়ির খবরের প্রায় সবই অধরা থেকে গেল।