অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেতাব নিয়ে রাফায়েল নাদাল। ছবি: টুইটার
গত অগস্টে একটি ভিডিয়ো বার্তায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ২০২১ সালে তিনি আর টেনিস কোর্টে নামতে পারবেন না। রাফায়েল নাদালের সমস্যাটা ছিল সেই একই, পায়ের চোট। ২০০৫ সাল, যখন তাঁর মাত্র ১৮ বছর বয়স এবং সবে একটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলেছেন, তখন থেকে এই পায়ের চোট নাদালের সঙ্গী।
১৭ বছর পরে এখনও নাদালের মূল সমস্যা সেটিই। আর ১৭ বছর পরেও এখনও সেই সমস্যা নিয়েই গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে চলেছেন তিনি। গত রবিবার রেকর্ড ২১টি খেতাব জিতে টপকে গিয়েছেন রজার ফেডেরার ও নোভাক জোকোভিচকে।
২০০৫ সালে নাদালের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় রোলঁ গারোজে। তার আগে থেকে শারীরিক নানা সমস্যা ভুগিয়েছে নাদালকে। কখনও কনুই, কখনও গোড়ালি, পা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। হাঁটু, কব্জি, হ্যামস্ট্রিং, কোমর, অ্যাবডোমেন, অ্যাপনডিক্সের ছোট-খাটো সমস্যা তো ছিলই।
যত বারই চোট ফিরে এসেছে, নাদালের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি কিছু বলার আগেই সবাই জানতে চেয়েছেন, আর কত দিন? কেউ কেউ কিছু জানতে না চেয়েই বলে দিয়েছেন, নাদাল শেষ। প্রত্যেক বারই নাদাল ফিরে এসেছেন। সেরা সব খেলাগুলি বেরিয়ে এসেছে গ্র্যান্ড স্ল্যামে পাঁচ সেটের ম্যাচগুলিতে।
অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার পরে নাদাল। ফাইল চিত্র
শেষ যে প্রত্যাবর্তনটি রবিবার ঘটালেন, সেটি সম্ভবত তাঁর জীবনের সেরা। প্রথম কারণ, বয়স। ৩৫ বছরের নাদালকে আরও এক বার বাঁ পায়ের অসহ্য যন্ত্রণা কাটিয়ে ফিরতে হয়েছে। ১৭ বছরের চোটগ্রস্ত টেনিসজীবনে নাদালকে টানা পাঁচ মাস কোর্টের বাইরে আর এক বারই থাকতে হয়েছে। সেটি ছিল ২০১২ সালে। সে বার উইম্বলডনের পরেই নাদাল জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বছর তাঁর পক্ষে আর খেলা সম্ভব নয়।
এ বার নাদালের ফেরা বেশি কঠিন হওয়ার দ্বিতীয় কারণ, ডিসেম্বরে কোভিড সংক্রমণ। জানুয়ারিতে সুস্থ হওয়ার পরে নাদাল নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘‘সব সময় প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল। জ্বর ছিল। এতটাই দুর্বল ছিলাম, টানা দু’দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি।’’ শেষ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে উঠে মেলবোর্নে এটিপি ২৫০ খেতাব এবং তার পরে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন। হার্ডকোর্টে ১০টি ম্যাচ খেলে তিনি অপরাজিত।
এটিই যে তাঁর সেরা প্রত্যাবর্তন, নাদাল নিজেও অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার পরে জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘চোট, কোভিড-সহ সব পরিস্থিতি বিচার করলে বলতে পারি, এটাই সম্ভবত আমার টেনিসজীবনের সব থেকে বড় প্রত্যাবর্তন।’’
কাছাকাছি থাকবে ২০১৩ সালের প্রত্যাবর্তন। ২০১২ সালের জুনে শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে খেলার পর সে বার হাঁটুর মারাত্মক চোট সারিয়ে ফিরেছিলেন। ২০১৩ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে অসুস্থতার জন্য খেলতে পারেননি। চিলির এটিপি ২৫০ প্রতিযোগিতার ফাইনালে হেরে যান। তারপর ফরাসি ওপেন জিতে নিয়েছিলেন। যতই চোট থাকুক, নাদালের ফরাসি ওপেন জেতাটা আর কোনও ঘটনা নয়। এ বারও দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামটা রোলঁ গারোজে খেলতে নামবেন ফেবারিটের তকমা নিয়েই। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনটি ছিল অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের দ্রুত গতির হার্ড কোর্টে। যে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে নাদাল সব থেকে কম সাফল্য (এর আগে মাত্র এক বারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন) পেয়েছেন।
২০০৫ সালে নাদাল যখন প্রথম ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন, তখনও অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এবং স্বয়ং রাফার চিকিৎসক বলে দিয়েছিলেন, ক্লে কোর্টে সফল হলেও ঘাস বা হার্ড কোর্টে এই ছেলের পক্ষে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, যে ভাবে বেস লাইনে গিয়ে কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কভার করে এক একটা ফোর হ্যান্ড বা ব্যাক হ্যান্ড মারেন, সেটা মন্থর গতির কোর্টে সম্ভব হলেও অন্য জায়গায় এই ধরনের টেনিস ধোপে টিকবে না। কিন্তু সবার মুখ বন্ধ করে নাদাল তার পরে আরও ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন। এর মধ্যে দু’বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ছাড়াও দু’টি উইম্বলডন এবং চারটি ইউএস ওপেন খেতাব রয়েছে।
এই প্রত্যাবর্তনের অনেকটাই সম্ভব হয়েছে নাদালের এক সময়ের সতীর্থ এবং প্রাক্তন এক নম্বর কার্লোস মোয়া কোচ হিসেবে আসায়। মোয়া আসার আগে নাদালের কোচ ছিলেন কাকা টনি। কিন্তু মোয়া এসে সবার আগে নাদালের উপর থেকে ‘ওয়ার্ক লোড’ কমিয়ে দেন। সারা দিন জিম এবং অনুশীলনে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ইতি টানেন মোয়া। নাদালের প্রতিযোগিতায় খেলার পরিমাণও কমিয়ে দেন তিনি।
চোটর জন্য বার বার সমস্যায় পড়তে হয়েছে নাদালকে। ফাইল চিত্র
২০১৮ সালে নাদাল ফরাসি ওপেন জেতার পরে মোয়া বলেছিলেন, ‘‘প্রয়োজন অনুযায়ী বদল করাটা খুব দরকার। ও কেরিয়ারের যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে দিনে বাড়তি এক ঘণ্টা অনুশীলন করলে আলাদা কোনও লাভ হবে না। বরং ক্ষতি হবে।’’
ক্ষতি হতে দেননি মোয়া। নাদালও এই পরিবর্তন মনের আনন্দে মেনে নিয়েছেন। হাত কাটা জামা পরে বাইসেপ দেখানো নাদাল এখন সত্যিই বদলে গিয়েছেন। জেতার লক্ষ্য নিয়ে আর গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতে নামেন না। লক্ষ্য থাকে একটাই, টেনিসটা উপভোগ করা। নিজে বলেওছেন সে কথা, ‘‘জীবনের শেষ দিকে এসে খেলাটা উপভোগ করতে হয়। কারণ জেতার সম্ভাবনাটা স্বাভাবিক ভাবেই কমে যায়।’’
বদলে যাওয়া নাদাল টেনিস উপভোগ করতে করতে জেতার সম্ভাবনা এবং প্রত্যাশা বোধ হয় নিজের অজান্তেই কমানোর বদলে বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটিও তো পরিবর্তন!