গলে টিম ইন্ডিয়া হেরেছে কে বলল, সুনামিবিধ্বস্ত হয়েছে

হেরো অধিনায়কের সামনেই কাল সাংবাদিক সম্মেলনে টিমের মিডিয়া ম্যানেজার জানালেন দু’দিন কোনও প্র্যাকটিস নেই। রোববার নেই টিম গল থেকে কলম্বোয় আসবে বলে। আর সোমবার নেই শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচন রয়েছে বলে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলম্বো শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৫ ০২:২৮
Share:

হেরো অধিনায়কের সামনেই কাল সাংবাদিক সম্মেলনে টিমের মিডিয়া ম্যানেজার জানালেন দু’দিন কোনও প্র্যাকটিস নেই। রোববার নেই টিম গল থেকে কলম্বোয় আসবে বলে। আর সোমবার নেই শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচন রয়েছে বলে।

Advertisement

এ দিন সন্ধের মধ্যেই আবার ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড থেকে পরপর দু’টো তাৎপর্যপূর্ণ মেল। এক, সোমবার দ্বিতীয় টেস্টের অনুষ্ঠানকেন্দ্র পি সারা ওভালে টিম প্র্যাকটিস করবে। দুই, স্টুয়ার্ট বিনি দলের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। তিনি এসে যাবেন খুব শিগগিরই।

প্র্যাকটিস তো বোঝা গেল সমালোচনা-সমালোচনায় আক্রান্ত হয়ে ডাকা হয়েছে। সারা দেশে কাগজ বন্ধ ছিল তো কী? এখনকার দিনে নেটই তো সবচেয়ে বড় কাগজ। আর তাতে তো টিমকে তুলোধোনা হচ্ছে। বিকেলে প্র্যাকটিস মানে হারের নাম বাবাজি! বোঝা গেল। কিন্তু বিনি?

Advertisement

খোঁজ-খোঁজ-খোঁজ। কার তা হলে চোট লাগল? কে ফিরে যাচ্ছে? টিম ম্যানেজমেন্ট প্রথমে নীরব। পরে একটু সময় নিয়ে জানানো হল কেউ ফিরছেন না। বিনি যোগ দিচ্ছেন ষোলো নম্বর ক্রিকেটার হিসেবে।

এ বারে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজের এই শ্রীলঙ্কা মাহেলা জয়বর্ধনের চলে যাওয়ায় এমনিতেই আক্রান্ত। কুমার সঙ্গকারার আসন্ন বিদায়ে পর্যাপ্ত বিষাদগ্রস্ত। পাকিস্তানের কাছে সদ্য সিরিজ হারে বিবর্ণ। টিমের টেস্ট ম্যাচ খেলার গড় অভিজ্ঞতা এমনিতেই আঠারো থেকে কুড়ি। তার ওপর ওজনে এত হালকা যে মনে করা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বকালের দুর্বলতম টিম! এ সব টিমের সঙ্গে খেলা পড়লে ময়দান দু’টো অভিব্যক্তি ব্যবহার করে থাকে। একটা লেখা যাবে না। একটা যাবে— মুরগি টিম!

তাদের বিরুদ্ধে কোহলির ভারত যে একপেশে বিক্রম দেখিয়ে টেস্ট ম্যাচ হাতে তুলে নেবে তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই। অস্বাভাবিক হল হাতে ম্যাচ নিয়ে ভারত যে ভাবে সেটা ফেলে দিল! সেই কবে ১৯৬২-তে পটৌডির নেতৃত্বে ভারতের পোর্ট অব স্পেনে হার নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। কি, না ভারত শেষ দিন লাঞ্চ অবধি ছিল দু’উইকেটে ১৪৯। তার পর হঠাৎই ভেঙে পড়ে।

আঠারো বছর আগের বার্বেডোজ বিপর্যয় তো আরওই আলোচিত। লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে যে দিন ১২০ রানও তুলতে পারেনি সচিন-রাহুল-লক্ষ্মণ-আজহার সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপ। এমন তোড় হয়েছিল সেই হারের যে আজও বীভৎসতম হার হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে তা চিত্রিত হয়ে রয়েছে। তখনকার দিনে প্রেস কনফারেন্স হত টিম ড্রেসিংরুমের বাইরে। সে দিন হেরে এত উত্তপ্ত ছিল ড্রেসিংরুম যে কোচ মদনলাল আর ক্যাপ্টেন তেন্ডুলকর সাংবাদিকদের টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমের বাইরের টয়লেটে। টয়লেটে সাংবাদিক সম্মেলন নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ। কিন্তু সেটা হারের ভূকম্পনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ছিল।

যার পাশে এসে দাঁড়াল গলে কোহলির ভারতের ৬৩ রানের বিপর্যয়। এমন হার যা একটা টিম নয়, একটা ক্রিকেট-সভ্যতাকে নড়িয়ে দিতে পারে। অ্যাসেজ হার যেমন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকে়ট-সভ্যতাকে এমনই নড়িয়েছে যে মাত্র চার মাস আগের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে তারা অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অ্যাসেজও এত বিশ্রী ভাবে অস্ট্রেলিয়ানরা হারেনি গলের জেতা ম্যাচ ভারত যে ভাবে সমর্পণ করল। একটা টিম প্রথম ইনিংসে ১৯২ রানে এগিয়ে। বিপক্ষ তৃতীয় ইনিংসে ধুঁকছে। তাদের সঙ্গকারা-ম্যাথেউজ হারিয়ে ৯৭ রানে ৫ উইকেট। এর পর একমাত্র প্রশ্ন থাকে ইনিংস হার হবে কি না? সেই অবস্থা থেকে কেউ ম্যাচ হারে? না হারা সম্ভব? লর্ডসে ৪২ রানে অলআউটের তবু একটা ব্যাখ্যা ছিল। একটা টিম চূড়ান্ত সিম সহায়ক পিচে শুরু থেকে শেষ অবধি ইনিংসের ছন্দ খুঁজে পায়নি।

গলে তো হাতে আসা ম্যাচ অবিশ্বাস্য ভাবে বাইরে চলে যেতে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দিন গোটা দেশ অবাক হয়ে দেখেছে যে অপারেশন ১৫৩-র অভিযানে কেমন কম্পিত থেকেছে তথাকথিত বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপ। রোহিত শর্মাকে আবার কেন আগে পাঠানো হয়েছিল একমাত্র কোহলি/শাস্ত্রী সংঘই বলতে পারবে। তাঁর ব্যর্থতা কাউকে অবাক করেনি। কিন্তু কোহলি যে ফ্লিক মারলেন টার্নারে কেউ সাধারণত এমন স্ট্রোক ইনিংসের শুরুতে খেলে না। ধবন নিশ্চেষ্ট হয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলেন কেন, তিনিই জানেন। হাতে এত শট আছে কিন্তু টাইমলেস টেস্টের মতো ব্যাটিং করছিলেন। গেলেন দারুণ রিটার্ন ক্যাচে। ঋদ্ধিমান সাহার সামনে অ্যাডিলেডের সেই আত্মঘাতী, টেস্টের মোড় ঘোরানো শটের প্রায়শ্চিত্ত করার লটারির টিকিট এসেছিল। যদি এই কঠিন অবস্থা থেকে জেতাতে পারেন, তা হলে অ্যাডিলেড ধুয়েমুছে যাবে। উল্টো দিকে তো রাহানে ছিলেনই। কিন্তু ঋদ্ধি প্রমাণ করলেন যে ছয় নম্বর জায়গাটায় রপ্ত হতে তাঁর আরও সময় লাগবে। তত দিন বরং রবিচন্দ্রন অশ্বিন ছয়ে অনেক ভাল বিকল্প।

কোহলি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রচণ্ড আক্রমণ করলেন ব্যাটিং লাইন আপকে। ‘‘কোথায় সাহসী, নির্ভীক ক্রিকেট খেলার কথা ছিল আমাদের। আমরা বড্ড ভিতু ভিতু হয়ে গেলাম আমাদের ব্যাটিং মনোভাবে,’’ বললেন কোহলি। খেলার পর গল মাঠ থেকে টিম বাস বেরলো প্রায় দু’ঘণ্টা বাদে। শুনলাম ড্রেসিংরুমে তখনও ক্রিকেটাররা। নির্ঘাৎ হারের ময়নাতদন্ত হচ্ছিল। প্রশ্ন হল, ভিসেরা রিপোর্ট এলে কি সেটা বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহার করে সিরিজটা ২-১ জেতা যাবে?

শ্রীলঙ্কা যতই তথাকথিত মুরগি টিম হোক। এই সাফল্যে চেগে গিয়েছে। সঙ্গকারার বিদায়ী ম্যাচকে স্মরণীয় রাখার লক্ষ্যে তারা আরও কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে। সেখানে ভারত বুঝতেই পারছে না তার চূড়ান্ত এগারো কী হবে? কারা তার হয়ে ওপেন করবে? মুরলী বিজয়ের চোট সারবে কি না ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে বোঝা যাবে। শিখর ধবনেরও লেগেছে গলে। এমন হতে পারে পূজারাকে কলম্বোয় ওপেন করতে দেখা গেল। আর বিনি খেললেন ছ’নম্বরে।

হালফিলে শ্রীলঙ্কা সফরে কখনও ষোলো জন নিয়ে যেতে হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। শ্রীলঙ্কা মানে চোদ্দো। বড়জোর পনেরো। সেখানে এখন টিমের যা অবস্থা স্কোয়াডটা কত জন হলে ভাল হয়, গলে সুনামির পর বোঝা যাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কার কাছে ২০১৫ গল হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের ২০০১-এর ইডেন। সব কাগজে প্রথম পাতায় এমন বিস্তারিত বর্ণনা যেন সোমবারের সাধারণ নির্বাচন পিছনে চলে গিয়েছে। এমন অভাবিত পরিস্থিতি থেকে উঠে দাঁড়ানোয় গোটা জাতি উদ্বেল। ভারতের তেমনই এটা মৌনপালনের হার।

বাঁ-হাতি লঙ্কা স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের বয়স এখন সাঁইত্রিশ। তিনি বোর্ডের ভিআরএস স্কিম থেকে পেনশনারের তালিকায় চলে যাচ্ছিলেন। পাকিস্তান টেস্টে বাদ পড়া। তার পর প্রথম ইনিংসে ০-৬৭ একেবারে ভবিতব্য ঠিক করে দিয়েছিল। সেই হেরাথকে আবার পাকা চাকরিতে বহাল করে দিলেন ভারতীয়রা। এত দিন শোনা যেত ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা বিদেশে সুইং বা সিম খেলতে পারে না। এখন নতুন রোগ যোগ হয়েছে— স্পিনার খেলতে না পারা!

কোহলি ক্যাপ্টেন হিসেবে চার টেস্টের যে দুটো হারলেন, দুটোতেই সংহারক স্পিনার। গলে হেরাথ। অ্যাডিলেডে নাথান লিয়ঁ। তার আগে তাঁর বড়দা ধোনির টিমকে ইংল্যান্ড সিরিজ জুড়ে যিনি ধারাবাহিক পিষেছেন। তিনিও এক স্পিনার— মইন আলি। ভারতীয় ক্রিকেট অলিন্দে নতুন জোক বার হয়েছে যে গলের হারে ভারত প্রবলেমে আদৌ পড়েনি। পড়েছে অন্য দেশ। এর পর তো ইন্ডিয়া ট্যুরে এলে তাদের উল্টে সঙ্কট— এদের পেসারের উইকেটে ফেলব না স্পিনারের?

গলের হারের চব্বিশ ঘণ্টা বাদেও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিশ্বাস হচ্ছে না একটা টিম কী করে পুরো খেলা কন্ট্রোল করে শেষ তিন সেশনে ম্যাচ থেকে এমন সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে পারে? অনিশ্চয়তা ক্রিকেটের বৈশিষ্ট্য তো কী— অনিশ্চয়তা মানে তো লটারি নয় যে এত ঘুরে যাবে!

কোহলি-প্রজন্মের টিম ইন্ডিয়া অতীত ইতিহাস বা ক্রীড়াবিদ নিয়ে পড়াশোনাই করে না। করলে রমেশ কৃষ্ণনের ঘটনাটা জানত। অস্ট্রেলিয়ার কোর্টে এক দিন একটা টুর্নামেন্ট খেলছিলেন রমেশ। হঠাৎ দেখেন গ্যালারি থেকে রড লেভার তাঁকে ডাকছেন। কী এমন হল যে তাঁকে রড লেভারের মতো কিংবদন্তি ম্যাচের মধ্যিখানে ডাকছেন? রমেশ কাছে যেতে শুনলেন লেভার বলছেন, ‘‘অপোনেন্টকে নিয়ে খেলছ কেন? শ্যুট হিম।’’ জিতে উঠে লেভারের কাছে গেলেন রমেশ। আমাকে আর একটু বোঝাবেন।

‘‘খুব সহজ তো। ডোন্ট টেক এ প্রিজনার। কিল হিম। মনে রাখবে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টসে কাউকে বন্দি রাখতে নেই। মেরে ফেলতে হয়।’’ রমেশ এমন মুগ্ধ হন যে, রমানাথন কৃষ্ণনকে তখনই ফোন করে জানিয়েছিলেন।

গলে সুনামিক্ষত ভারতীয় টিম রুমে কারও কথাটা বড় বড় করে লাগিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে— ডোন্ট টেক প্রিজনার্স, কিল দেম!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement