সোনা জয়ের পর স্বপ্না। ছবি: পিটিআই।
দৌড় শুরু সেই ক্লাস ফোর থেকে। ১০০ মিটারের সার্কেলটা সম্পূর্ণ করলাম সবে। ৮০০ মিটার এখনও বাকি। মাঝে অনেকটা হার্ডল।
এই মুহূর্তে ঠিক কী অনুভূতি হচ্ছে বলতে পারব না। জানি না কী ভাবে সোনা পেলাম। দৌড় শেষে ট্র্যাকে শুয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম জলপাইগুড়ির সেই গ্রামের রাস্তা পেড়িয়ে এই কলিঙ্গ স্টেডিয়ামের ট্র্যাক আমাকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছি। এর আগের সময়টা তো দীর্ঘ হতাশার। রাগ আর জেদটা তখন থেকেই জমতে শুরু করেছিল।
এমনিতে আমার খুব রাগ। রেগে গেলে কিছুই মাথায় থাকে না। কাউকে ছেড়ে দিই না। রেগেই তো বাড়ি ছেড়েছিলাম। তবে এখন কিন্তু অনেক কমেছে! স্যার (সুভাষ সরকার) বলে বলে কমিয়েছেন। আসলে সবটাই স্যার। গুরু হয়তো এমনই হয়। না হলে কবেই গ্রামের কাদা মাখা গলিতে হারিয়ে যেতাম। দু’বছর ধরে শুনেছি আমি আর খেলতে পারব না। খুব কষ্ট হত। কী করব বুঝতে পারতাম না। আমি নিজেও মেনে নিতে শুরু করেছিলাম আমার আর ট্র্যাকে ফেরা হবে না। তাই এক দিন ‘সাই’ ছেড়ে ফিরে গিয়েছিলাম জলপাইগুড়ির গ্রামে। ভেবেছিলাম জীবন তো চালাতে হবে, তাই একটা চাকরি খুঁজে বাবা-মাকে নিয়ে সংসার চালাব। ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা কতটা কষ্ট করে সংসার চালান। ভ্যান চালিয়ে চার ভাই, বোনের সংসার চালানো কী সহজ ছিল?
আরও খবর: অনিশ্চিত ছিল ট্র্যাকে ফেরা, যন্ত্রণা কাটিয়ে সোনার লাফ স্বপ্নার
এখন তো সেটাও নিয়মিত পারেন না। বাড়ির অনেকটাই দায়িত্ব এখন আমার উপর। আগে থেকেই বুঝতে পারতাম। তাই কখনও খেলার জন্য বাবার উপর চাপ দিইনি। নিজেই নিজের প্রয়োজনগুলো মেটানোর চেষ্টা করতাম। শুধু জল খেয়েও প্র্যাকটিস করেছি। তখন তো সব খেলাই খেলতাম। ফুটবল খেলেছি, কবাডি খেলেছি। তার পর যে কী ভাবে অ্যাথলেটিক্সে চলে এলাম বুঝতেই পারিনি। শুধু মনে আছে ছোটবেলায় স্কুলে কী একটা টুর্নামেন্ট হয়েছিল। সেখান থেকে খেলে জেলা তার পর রাজ্যের হয়ে খেলেছি। ব্যস অন্য কিছু ভাবিনি। সেই ক্লাস ফোর থেকেই তো দৌড় শুরু করেছিলাম। মাঝখানে থমকে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
আমি আগে শুধু হাই জাম্প করতাম। হেপ্টাথেলনে আসি ২০১৩তে। ২০১২য় কলকাতা ‘সাই’-এ এসেছিলাম। স্যারই বলেন, হেপ্টাথেলনে যেতে। ২০১৪তে এশিয়ান গেমসে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম কোনও সিনিয়র পর্যায়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিলাম। পঞ্চম হয়ে মনটাই ভেঙে গিয়েছিল। এর পর ওপেন ন্যাশনাল। তার পর থেকেই সেই ভয়ঙ্কর পিঠের যন্ত্রণা। চোট সারিয়ে উঠতে পারব কখনও ভাবিনি। দু’বছর প্রায় ট্র্যাকে না নেমে বেঁচে থাকাটা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। স্যার না থাকলে হয়তো ফেরাই হত না। আমি জলপাইগুড়ি ফিরে যাওয়ার পর থেকে স্যার টানা ফোন করতেন, বলতেন, ‘‘ফিরে আয় সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
অনেক দিন শুনিনি। পরে আর স্যারের কথা ফেলতে পারিনি। সে দিন স্যারের কথা শুনে না ফিরলে আজকের দিনটি আর দেখা হত না। তার মধ্যেও বার বার মনে পড়েছে বাবা-মায়ের কথা। ওদের কষ্টের কথা। মনে হচ্ছিল কী ভাবে ওদের একটা স্বাভাবিক জীবন দেব। আমি সিনিয়র ন্যাশনালে সোনা জেতার পর ওড়িশা সরকার আমাকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। আমার কাছে এই টাকাটা বিরাট। এত টাকা একসঙ্গে দেখিনি। নিজের খেলার কিটস কিনব। তার আগে অবশ্য বাড়িতে দেব। বাড়িটা ঠিক করতে হবে। টিনের দেওয়ালটাকে যদি পাকা করা যায়।
এর মধ্যেই পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। চারুচন্দ্র কলেজে পড়ি। কিন্তু এ বার মনে হয় আর পাশ করা হল না। ফিজিক্যাল এডুকেশন-এর প্র্যাকটিক্যাল রয়েছে সামনে। মনে হয় দিতে পারব না। কারণ ভুবনেশ্বর থেকেই চলে যাব গুন্টুরে। সেখানে রয়েছে ইন্টারস্টেট। অগস্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ তার মধ্যে পিঠের চোট। সেটাই ভাবাচ্ছে। ভেবেছিলাম ইন্টারস্টেটে প্রতিযোগিতায় যাব না কিন্তু যেতেই হবে। তবে সবগুলো ইভেন্টে নামব না। বিশ্রাম দরকার। আবার চোট হয়ে গেলে বিপদ। এখন সামনে শুধুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। ওটা ছাড়া কিছু ভাবছি না। ওখানে সফল হতে পারলে পরিবারকে আরও একটু স্বস্তি দিতে পারব। নিয়ম করে খাওয়া, একটু ভাল থাকা, ভাল জামা-কাপড় পরা, ওদেরও তো ইচ্ছে করে। সেগুলো ওদের দিতে পারলে যে আমার লড়াইটাই স্বার্থক হবে। পূর্ণ হবে একটা সার্কেল। অনেকটা আমার অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের মতো।
অনুলিখন: সুচরিতা সেন চৌধুরী