মধ্যমণি: বরুসিয়ার আক্রমণের মূল কারিগর স্যাঞ্চো। ফাইল চিত্র
রাইন নদীর পাড় গত শুক্রবার দুপুর থেকেই হলুদ হয়ে গিয়েছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলেরই শরীরে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হলুদ-কালো জার্সি। হাতে স্কার্ফ। কেউ পাড়ের পাঁচিলে বসে, কেউ আবার ঘাসে শরীর এলিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন সামনের পাচতাঁরা হোটেলের দিকে।
এফসি কোলনের বিরুদ্ধে বুন্দেশলিগায় বরুসিয়ার ম্যাচ ছিল স্থানীয় সময় রাত সাড়ে সাতটায়। যে মাঠে খেলা হবে, সেই রাইন স্টেডিয়াম নদীর অন্য পাড়ে। তা হলে কী করছিলেন বরুসিয়ার সমর্থকেরা?
আসলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে সেই হোটেলে ছিলেন জর্ডান স্যাঞ্চো, মার্কো রয়েসরা। তাঁরা স্টেডিয়ামের উদ্দেশে রওনা দেওয়া পর্যন্ত কোথাও নড়েন না বরুসিয়ার সমর্থকেরা। এই কারণে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বের ডর্টমুন্ড শহর থেকে শ’খানেক সমর্থক দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন কোলনে। অবশ্য কোলন বলে নয়। ইউরোপের যেখানেই বরুশিয়া খেলতে যায়, সমর্থকরা পৌঁছে যান। হোটেল থেকে টিমবাস বেরোনোর সময় রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে উৎসাহিত করেন ফুটবলারদের। ম্যাচে ক্লান্তিহীন ভাবে গান গেয়ে যান।
ডর্টমুন্ড শহরেও এক ছবি। যাঁরা অ্যাওয়ে ম্যাচ দেখার সুযোগ পাননি, তাঁরা বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের নিজস্ব স্টেডিয়াম সিগন্যাল ইদুনা পার্কে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখেছেন। ডর্টমুন্ড শহরের প্রাণকেন্দ্রে জার্মান ফুটবলের মিউজিয়াম। ১৯৫৪ সালে প্রথম বার বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া জার্মানির জাতীয় দলের তারকাদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম থেকে ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে গোল করে দেশকে চতুর্থ বার বিশ্বসেরা করা মারিয়ো গোৎজ়ের সেই বুট। যাতে এখনও লেগে রিয়ো দে জেনেইরোর মারাকানা স্টেডিয়ামের মাটি ও ঘাস। পুরো মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে সারা দিন কেটে যাবে। রয়েছে স্মারক বিক্রির দোকান। অদ্ভুত ভাবে অধিকাংশ বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের। জার্মানির জাতীয় দল বা বায়ার্ন মিউনিখের স্মারকের সংখ্যা খুব কম। জার্মানির ফুটবল ইতিহাস বলতে বলতে মিউজিয়ামের গাইড হেলমার বলছিলেন, ‘‘ডর্টমুন্ডেরই ক্লাব বরুসিয়া। নিজেদের শহরের ক্লাবের স্মারকের সংখ্যা বেশি তো থাকবেই।’’
সমর্থকদের এই আবেগকে বরুসিয়া কর্তারাও দারুণ গুরুত্ব দেন। চিফ ম্যানেজিং অফিসার (সিএমও) কার্স্টেন ক্রেমার খোলাখুলি বললেন, ‘‘আমাদের কাছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্ক। এই কারণে আমরা ফুটবল ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবি না। বায়ার্ন মিউনিখের বাস্কেটবল দল রয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে ফুটবলই সব। এই কারণেই কোনও প্রতিযোগিতার ফাইনালে হারলেও আমরা ভেঙে পড়ি না। স্টেডিয়ামে টিকিটের দাম আমরা সব সময় কম রাখি ওঁদের কথা ভেবেই।’’ যোগ করলেন, ‘‘অর্থ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের কাছে আর্থিক মুনাফা বড় কথা নয়। সমর্থকদের আবেগকে আমরা সম্মান দিই। তাই ভারতের বেশ কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ব্যাপারে কথাবার্তা অনেক দূর এগোলেও চূড়ান্ত কিছু হয়নি।’’ কেন? ক্রেমারের ব্যাখ্যা, ‘‘ভারতের ক্লাবে লগ্নি করে বা আর্থিক লাভ করা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা চাই ভারতীয় ফুটবলের উন্নতিতে সাহায্য করতে। উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে যাতে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারেরা উঠে আসতে পারে। ভারতের সর্বত্র ফুটবলকে ছড়িয়ে দিতে চাই। সেই প্রতিশ্রুতি যতক্ষণ না কোনও ক্লাব দেবে, এগোব না।’’
ফুটবলারদের সঙ্গে সমর্থকদের সম্পর্কও চমকে দেওয়ার মতো। শুক্রবার রাইন স্টেডিয়ামে কোলনের বিরুদ্ধে পিছিয়ে থেকেও দুর্দান্ত জয় পেয়েছিল বরুসিয়া। নেপথ্যে রয়েস-স্যাঞ্চো যুগলবন্দি। কলকাতায় ইংল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে খেলে যাওয়া স্যাঞ্চোই ৭০ মিনিটে সমতা ফেরান। ৮৬ মিনিটে লুকাস পিসচেক এগিয়ে দেন বরুসিয়াকে। সংযুক্ত সময়ে স্যাঞ্চোর পাস থেকেই দলের হয়ে তৃতীয় গোল করেছিলেন পাকো আলকাসার।
তবে ৭০ মিনিট পর্যন্ত দল পিছিয়ে থাকলেও সমর্থকদের ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি। জার্মানির ফুটবল স্টেডিয়ামগুলোর অন্যতম বিশেষত্ব, দাঁড়িয়ে খেলা দেখার জন্য আলাদা গ্যালারি রয়েছে। ভক্তেরা সেখানে ড্রাম বাজিয়ে গান গাইছিলেন। ম্যাচ শেষে সেই গ্যালারির সামনে গিয়ে ড্রামের তালে নাচলেন রয়েসরা। বরুসিয়া সিএমও বলছিলেন, ‘‘এই ক্লাব পরিবারের মতো। যারা একবার এখানে খেলেছে বা কোচিং করিয়েছে, তারা কখনও ভুলতে পারে না। মারিয়ো গোৎজ়ে, মাটস হুমেলস বায়ার্ন মিউনিখে চলে গিয়েছিল। ভুল বুঝে ফিরেছে।’’ তা হলে কি য়ুর্গেন ক্লপকেও ফের দেখা যাবে? সতর্ক ক্লাবকর্তা বললেন, ‘‘লিভারপুলের সঙ্গে আরও তিন বছর চুক্তি রয়েছে ক্লপের। তার পরে কী হবে, কেউ জানেন না।’’