স্মৃতি: পিকে-র সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ে নিখিল নন্দী ।
এই বছরটা ময়দানে প্রদীপদা (পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়), চুনীদার (চুনী গোস্বামী), মতো আমার অগ্রজদের কেড়ে নিয়েছে। মঙ্গলবার নিখিলদাও (নন্দী) চলে গেলেন। তাই মনটা বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে।
নিখিলদার কথা ভাবলেই মনে পড়ে যায় যৌবনের অসংখ্য মধুর স্মৃতি। কলকাতা প্রথম ডিভিশন ফুটবল লিগে এরিয়ানের জার্সি গায়ে আমার প্রথম ম্যাচটা খেলেছিলাম ১৯৫৯ সালে। বিপক্ষে ছিল নিখিলদা, প্রদীপদাদের ইস্টার্ন রেল। মহমেডান মাঠে তখন ছিল এরিয়ানের তাঁবু। তার আগের বছরে ইস্টার্ন রেল কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ন। তাই মহমেডান মাঠে ম্যাচটা দেখতে বেশ ভিড় হয়েছিল। খেলা অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয়। ১৯৫৬-তে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে খেলে আসার সুবাদে নিখিলদা তখন তারকা। কিন্তু তারকাসুলভ কোনও হাবভাবই ছিল না তাঁর। এতটাই বিনয়ী ও ভদ্র মানুষ। এখনও মনে আছে, সে দিন খেলা শেষ হওয়ার পরে নিখিলদা আমাকে ও মঙ্গল পুরকায়স্থকে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। আজও ওটা আমার কাছে একটা পুরস্কার।
নিখিলদা আমার কাছে শুধু এক জন অগ্রজ ফুটবলার নন। শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, ব্যর্থ হলে কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তার প্রেরণা।
১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সে অন্যায় ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছিল নিখিলদাকে। তাতে মানসিক ভাবে খুব আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা স্থায়ী ছিল মাত্র একটা দিন। নিখিলদার পরিবারের সদস্যদের থেকেই শুনেছি, পরের দিন সকালে বাড়ির সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘‘এ বার হল না। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিক্স দলে আমাকে নিতেই হবে। সে ভাবেই আজ থেকে পরিশ্রম করব।’’
এ রকম যাঁর মনের জোর, নিষ্ঠা, সংকল্প তাঁকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৫৫ সালেই ঢাকায় চর্তুদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় ভারতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল নিখিলদাকে। তার পরে অলিম্পিক্স দেশের হয়ে অস্ট্রেলিয়া খেলতে যাওয়া।
নিখিলদার বাবা গোপালচন্দ্র নন্দী ছিলেন তাঁর সময়ের নামী দেহসৌষ্ঠব শিল্পী (বডি বিল্ডার)। তাঁর পাঁচ ছেলের মধ্যে চার জনই ময়দানে ফুটবল খেলেছেন। বড়দা অজিত নন্দী ফুটবল খেলতেন। মেজদা অনিল নন্দী ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সে ভারতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলতে গিয়েছিলেন। তার পরে নিখিলদা। আর ছোটভাই সুনীল আমাদের সঙ্গেই খেলত। একদম ক্রীড়া-পরিবার। এক পরিবার থেকে দু’জন অলিম্পিয়ান। এ রকম বিরল কৃতিত্ব থাকার পরেও নিখিলদা বা তাঁর পরিবারকে কোনওদিন অহঙ্কার করতে দেখিনি। ওঁদের পরিবারও ছিল খুব অতিথিপরায়ণ। তাই নিখিলদার মধ্যেও বন্ধু ও ভ্রাতৃবৎসল ব্যাপারটা ছিল। অনেকেই জানেন না, প্রথমবার ইস্টার্ন রেলে খেলতে আসার পরে প্রদীপদার থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। সেই সময় নিখিলদা ওঁকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখেন।
নিখিলদা কখনও চেঁচিয়ে কথা বলতেন না। আর ফুটবল মাঠে ও রকম অক্লান্ত পরিশ্রম আমি কাউকে করতে দেখিনি। লেফ্ট হাফের ফুটবলার ছিলেন। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডেও খেলতেন। সারা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। অফুরন্ত দম, নিখুঁত পাস, গতি, স্পট জাম্পের সঙ্গে ছিল প্রখর ফুটবল মস্তিষ্ক।
খেলা ছাড়ার পরে তাই কোচ হিসেবেও নিখিলদা ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হতে পেরেছিলেন, তাঁর হার-না-মানা মনোভাব এবং ফুটবল-বুদ্ধির জন্যই। চন্দ্র মেমোরিয়াল (পরবর্তীকালে রেলওয়ে এফসি), হাওড়া ইউনিয়ন, ইস্টার্ন রেলকে কোচিং করিয়েছেন, জাতীয় স্তরেও রেল দলের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নিখিলদা অসম্ভব ভালবাসতেন ছোটদের খেলা শেখাতে।
লকডাউনের আগেও রোজ দমদম সেন্ট্রাল জেলের মাঠে বাচ্চাদের খেলা শেখাতে ছুটে যেতেন। মাঝে করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন। কিন্তু মারণ ভাইরাসকে হারালেও সেই ধকল আর নিতে পারলেন না শেষ পর্যন্ত।
নিখিলদা পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেও, ফুটবলের প্রতি ভালবাসার জন্য চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। এখনও কানে বাজছে, বছর খানেক আগে ভেটারেন্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলা, ‘‘সমাজপতি, যা-ই হোক, প্রাথমিক স্তর থেকে বাচ্চা ফুটবলারদের না তুলে আনলে এ দেশের ফুটবলের উৎকর্ষ বাড়বে না।’’ নিখিলদার এই দর্শনকে বাস্তবায়িত করাই হবে ওঁর প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা।