স্বর্ণযুগে: রূপকথার সেই কলকাতা ফুটবল। চুনী ও সুকুমার। ফাইল চিত্র
ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। অর্থাৎ সকালটা দেখলেই বোঝা যায় সারা দিন কেমন যাবে। চুনীদার (গোস্বামী) ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মিলে গিয়েছিল।
ধূমকেতুর মতোই উত্থান চুনীদার। আন্ডারহাইট টুর্নামেন্ট থেকে খেলোয়াড়জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একই রকম উজ্জ্বল ছিলেন।
১৯৫১ বা ’৫২ সাল। চুনীদার বয়স তখন ১৩ বা ১৪। আমার চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন-চার বছরের বড় ছিলেন। পাড়ার বন্ধুদের কাছে এক দিন শুনলাম, বালিগঞ্জ ইনস্টিটিউটের হয়ে চুনী গোস্বামী নামে একটি ছেলে অসাধারণ খেলছে বিভিন্ন আন্ডারহাইট টুর্নামেন্টে। সে দিন বিকেলেই ভবানীপুরের ইলিসিয়াম মাঠে খেলা দেখতে গেলাম। বাঁ-দিক থেকে ডান পায়ে নেওয়া চুনীদার ফ্রি-কিক পোস্টের কোণ ঘেষে গোলে ঢুকে গিয়েছিল। সে দিন থেকেই আমি চুনীদার ভক্ত। ওঁর খেলা দেখার জন্যই মানুষ মাঠে ভিড় করতেন। তাই কলকাতা ময়দানে পা রাখার আগেই চুনীদা তারকা হয়ে গিয়েছিলেন। ক্রিকেটও অসাধারণ খেলতেন।
চুনীদার জন্যই হাজতবাস করেছিলাম! ১৯৫৭ সাল। আশুতোষ কলেজ থেকে পাস করে চুনীদা ভর্তি হয়েছেন ল-কলেজে। আমি তখন কলকাতা ময়দানে তৃতীয় ডিভিশনে খেলি। সবে স্কুল ফাইনাল পাস করে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়েছি। ইলিয়ট শিল্ডের সেমিফাইনালে ল-কলেজের প্রতিপক্ষ ছিল আর জি কর। আশুতোষ কলেজ আগেই ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল। এক বন্ধুর সাইকেলের রডে বসে ময়দানে চুনীদার খেলা দেখতে যাচ্ছিলাম। ফোর্ট উইলিয়াম মোড়ের কাছে এক জন সার্জেন্ট আমাদের আটক করে হেস্টিংস থানায় পাঠিয়ে দিলেন। সেই থানার দারোগা ছিলেন না। সেকেন্ড অফিসার আমাদের হাজতে পুরে দেন। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে ফাস্ট অফিসার এসে বাঁচালেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের জামিন দেওয়ার মতো কেউ আছেন কি না। আমার বন্ধু ফোন করে ওর কাকাকে সব বলল। তিনি এসে আমাদের জামিন দিয়ে বাড়ি নিয়ে গিলেন। এর কয়েক দিন পরে চুনীদাদের হারিয়েই ইলিয়ট শিল্ডে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
আরও পড়ুন: সুইং করাতে বলের ওজন বাড়ানোর প্রস্তাব ওয়ার্নের
চুনীদার সঙ্গে নিয়মিত খেলার সুযোগ হল ১৯৬০ সালে। এরিয়ান থেকে মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পরে। আমার মতো জুনিয়রকেও আপন করে নিয়েছিলেন চুনীদা। আমাকে ভালবেসে ‘সমাজ’ বলে ডাকতেন। আমাদের মধ্যে দুর্দান্ত বোঝাপড়া ছিল। চুনীদা ছিলেন শিল্পী। বিপক্ষের দু’-তিন জন ফুটবলারও আটকাতে পারতেন না। এমনিতে চুনীদা হেড করতেন না। কিন্তু কলকাতা লিগে বিএনআর-এর বিরুদ্ধে আমার পাস থেকে হেডেই গোল করেছিলেন।
১৯৬১ সালে আমি ইস্টবেঙ্গলে সই করায় খুব হতাশ হয়েছিলেন চুনীদা। মোহনবাগান কর্তারা যাতে আমাকে ধরতে না পারেন, তার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরের দিন সকালে আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে হাজির চুনীদা। সরাসরি তিনতলায় উঠে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সমাজ কোথায়? আমি নেই শুনে খুব হতাশ হয়েছিলেন। মান্নাদার মতো (শৈলেন মান্না) চুনীদাও চাননি আমি মোহনবাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে খেলি।
আরও পড়ুন: ২০০১-এর সেই সিরিজে ডুবেই আছেন হরভজন
চুনীদার সঙ্গে সব সময়েই আমার যোগাযোগ ছিল। মৃত্যুর দিন পাঁচ-ছয় আগেও ফোন করেছিলাম। চুনীদার স্ত্রী বাসন্তী বৌদির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। আমি ফোন করেছিলাম শুনে চুনীদা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন। আর বলেছিলেন, সমাজটা খুব ভাল খেলত। কিন্তু বৌদি অনেক চেষ্টা করেও আমার ফোন পাননি। চুনীদার সঙ্গে শেষ বারের মতো কথা বলতে না পারার আক্ষেপটা থেকেই যাবে।