প্রতিদ্বন্দ্বিতা: ডার্বির সেই পরিচিত দৃশ্য। ইস্টবেঙ্গল আক্রমণ রুখে দেওয়ার জন্য মরিয়া সুব্রত। ফাইল চিত্র
মোহনবাগান জার্সি গায়ে একটানা ১৭ বছর ৫ মাস খেলেছি। অন্য কোনও ক্লাবে যাইনি।
ছোট থেকেই মোহনবাগান সমর্থক হলেও আমি কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সমীহই করে এসেছি সারা জীবন। ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা ফুটবল ক্লাব। ছোটবেলায় রেডিওতে ইস্টবেঙ্গলের খেলার ধারাবিবরণী শুনতাম। ইস্টবেঙ্গল নামটা শুনলেই ভেসে উঠত অরুণ ঘোষ, তুলসীদাস বলরামদের মুখগুলো। কারণ, ওঁরা তখন লাল-হলুদ জার্সি গায়ে ময়দান মাতাচ্ছেন। খবরের কাগজে ওঁদের ছবি দেখে চিনে ফেলেছিলাম।
মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হলেও কিন্তু আমি কলকাতা ময়দান চিনতে শিখেছিলাম ইস্টবেঙ্গলের হাত ধরেই। শ্যামনগরের যুগের প্রতীক ক্লাব থেকে এসে আমি প্রথম খেলি ইস্টবেঙ্গল জুনিয়র দলেই। সেটা ১৯৬৮ সাল। শ্যামনগরে আমার খেলা দেখে সে বার পাওয়ার লিগে খেলার জন্য আমাকে ইস্টবেঙ্গলের জুনিয়র দলে নিয়ে এলেন সে সময়ে লাল-হলুদ শিবিরের এক প্রভাবশালী কর্তা। ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে তখন সব বড় ফুটবলারদের ভিড়। জুনিয়র ফুটবলার হওয়ায় আমরা তাঁবুর ভিতরে ড্রেসিংরুমে ঢুকতে পারতাম না। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতাম পরিমল দে, পিটার থঙ্গরাজ, সীতেশ দাসদের।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে আর একজন রাশভারী মানুষকে দেখতাম। দেখলেই শ্রদ্ধা জাগবে। সতীর্থ ও জুনিয়র দলের কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে জেনেছিলাম তিনি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সে সময়ের শীর্ষ কর্তা। নাম জ্যোতিষ গুহ। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তাঁর।
আটষট্টির পাওয়ার লিগে আমি বেশ ভালই খেলেছিলাম ইস্টবেঙ্গল জুনিয়র দলের হয়ে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। যত দূর মনে পড়ছে, সে বার আমরা মোহনবাগানকে হারিয়েও দিয়েছিলাম। গোলমালটা হল পরের বছর। সে বার আমি সিনিয়রদের সঙ্গে কলকাতা লিগ খেলব বলে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে না জানিয়ে বালি প্রতিভায় সই করে দিই। গ্রাম থেকে এসেছি। ময়দানে ফুটবল খেলে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। সই-সাবুদ, ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’-এর গুরুত্ব জানতাম না । পাঁচটা ম্যাচ খেলেও ফেলেছিলাম। এর পরেই আমার নাম ইস্টবেঙ্গলে নথিবদ্ধ বলে প্রতিবাদপত্র জমা হল আইএফএ-তে।
শেষমেশ ব্যাপারটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আমাকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ (এনওসি) না দিলে মাঠে নামতে পারব না। সাসপেন্ড হয়ে যাব। তখন দুরুদুরু বুকে হাজির হলাম জ্যোতিষবাবুর কাছে। তিনি সব শুনলেন। তার পরে আমার সামনেই এক সহ-কর্তাকে বললেন, ‘‘আমাদের জুনিয়র দল থেকে বালি প্রতিভার প্রথম একাদশে ডাক পেলে তো ভাল। এখানে তো বেচারা সিনিয়র দলে জায়গা পাবে না। তা হলে ওর খেলার জীবন নষ্ট করব কেন?’’ তার পরে আমার দিকে তাকিয়ে স্নেহসুলভ ভাবে বকাঝকা করে বললেন, ‘‘আর যেন এই ভুল না হয়। তোমার ফুটবলার জীবন নষ্ট হবে না। আমরা আইএফএ-কে প্রয়োজনীয় চিঠি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’’
সে দিন জ্যোতিষবাবুকে প্রণাম করে চলে এসেছিলাম। কিন্তু আজও তাঁর অনুগ্রহ ভুলিনি। ফুটবল অন্ত প্রাণ ওই ভদ্র মানুষটি আমাকে ফুটবলার হিসেবে বেড়ে ওঠার রাস্তায় হাঁটতে দিয়েছিলেন ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে না দিয়ে। না হলে তিন বছর সাসপেন্ড হয়ে যেতে পারতাম।
চুয়াত্তর সালে এসে দাঁড়ালাম জীবনের আরও বড় একটা পরীক্ষার সামনে। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল—দু’দলই আমাকে সই করাতে চায়। বুঝতে পারছি না কোথায় খেলব। একদিন ময়দান থেকে ইস্টবেঙ্গলের প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ক্লাবকর্তা পল্টুদা (পল্টু দাস) ও জীবনদা (জীবন চক্রবর্তী) আমাকে একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন মনোহরপুকুর রোডের একটা বাড়িতে। আমাকে বলে দিলেন, ‘‘তুই কালকে সই করবি।’’ সে দিন ছিল শুক্রবার। আমি বললাম, ‘‘কাল শনিবার। সে দিন সই করতে চাই না। বাড়ি গিয়ে মাকে প্রণাম করে বাবার অনুমতি নিয়ে সোমবার চলে আসব সই করতে।’’
রবিবার রাতে আমাদের শ্যামনগরের বাড়িতে এলেন মোহনবাগানের প্রাণপুরুষ শৈলেন মান্না। তাঁকে দেখেই বাবা বললেন, ‘‘মান্নাবাবু আমার বাড়িতে এসেছেন। ওঁকে অসম্মান করা যাবে না। মান্নাবাবু যেখানে খেলতে বলছেন, সেখানেই সই কর।’’ মান্নাদা আমাকে নিয়ে এসে মোহনবাগানে সই করান চুয়াত্তরে।
ইস্টবেঙ্গলকে শুরুতে কথা দিয়েও, তার পরে মোহনবাগানে সই করায় পল্টুদা-জীবনদার জন্য একটু খারাপই লেগেছিল সে বার। চুয়াত্তর থেকে একানব্বইয়ের মার্চ পর্যন্ত মোহনবাগানের হয়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে বহু স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছি। তার মধ্যে পঁচাত্তরের পাঁচ গোল খাওয়ার ম্যাচও যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সাতাশি সালে ডুরান্ডে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ হারানোর ম্যাচও। আবার অনেক ডার্বিতে আমি রক্ষণ থেকে উঠে গিয়ে গোলও করে এসেছি। মজিদ, জামশিদ, এমেকা, চিমা-সহ অনেকের সঙ্গেই খেলেছি। কিন্তু এর মধ্যে চিমার সঙ্গে আমার লড়াইটা দারুণ জমত। আর সব চেয়ে বুদ্ধিমান ছিল মজিদ। মোহনবাগানে খেললেও কোনও দিন ইস্টবেঙ্গলের কোনও খেলোয়াড়, কর্তা বা সমর্থক আমাকে কটূ কথা বলেননি। বরং ওদের স্নেহ-ভালবাসাই পেয়ে এসেছি। খেলোয়াড় জীবনেই ‘ইস্টবেঙ্গলের ছেলে’ বলে একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। অলোক ভৌমিকের পরিচালনায় সেই ছবির শুটিংয়ে ইস্টবেঙ্গল নিয়ে অনেক মজার স্মৃতি রয়েছে।
খেলা ছাড়ার পরে কোচিংয়ে চলে এসেছিলাম। তত দিনে মোহনবাগানকে জাতীয় লিগ দিয়ে সাফল্য পেয়েছি। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি শুনলাম ইস্টবেঙ্গলে নতুন কোচ আসছে। কে তা জানতাম না। একদিন বিকেলে ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকারের ফোন পেলাম অপ্রত্যাশিত ভাবেই। ফোন পেয়ে তো আমি অবাক। উল্টো দিক থেকে ইস্টবেঙ্গলের শীর্ষ কর্তা জানতে চাইছে ‘‘বাবলুদা তুমি কি ইস্টবেঙ্গলের কোচ হতে ইচ্ছুক। আমরা তোমাকে চাইছি।’’ ইস্টবেঙ্গলের এই প্রস্তাব শুনে আমি প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরের মুহূর্তে ভাবলাম, যে স্কুলে পড়াশোনা করেছি, সেই স্কুলেই যে শিক্ষক হতে হবে এ কথা কে বলেছে? তাই প্রস্তাব পছন্দ হওয়ায় ইস্টবেঙ্গল কোচ হিসেবেই লাল-হলুদ ড্রেসিংরুমে প্রথম ঢুকেছিলাম। জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলাম ইস্টবেঙ্গলে।
ইস্টবেঙ্গল কোচ হিসেবে ১৪ বছর পরে ফেডারেশন ক্লাব এনেছিলাম তাঁবুতে। কাপ জিতে বিমানবন্দর থেকে ফেরার সময়ে লাল-হলুদ সমর্থকদের যে জনস্রোত দেখেছিলাম, তা আজও ভুলতে পারি না। দু’টি ডার্বি ম্যাচ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইস্টবেঙ্গল কোচ হিসেবে। কলকাতা লিগে ০-৩ পিছিয়ে থেকে ৩-৪ হার। ম্যাচটায় অ্যালভিটো ডি’কুনহা নামার পরে এক সময়ে ৩-৩ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়টা, ফেডারেশন কাপে লুধিয়ানায় মোহনবাগানকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপ জেতা।
ইস্টবেঙ্গল কোচ হিসেবে প্রথম দিন থেকেই একটা চিন্তা ছিল। তা হল, লাল-হলুদ শিবিরের সমর্থকেরা কি আমাকে মেনে নেবেন? কিন্তু কোনও দিন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আমাকে অসম্মান করেননি। মনে পড়ছে, কলকাতা লিগে একটা ম্যাচে ড্র করেছিলাম। ভেবেছিলাম, সমর্থকদের রোষের মুখে পড়ব। কিন্তু কোথায় কী? ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা বরং পাশে দাঁড়িয়ে সে দিন উৎসাহ দিয়েছিলেন। আর ইস্টবেঙ্গল কর্তারা কখনও কোচের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা আমি সর্বদা পেয়েছি। যা আমার জীবনে একটা বড় প্রাপ্তি। এ রকম আবেগপ্রবণ, ফুটবল পাগল সমর্থকরাই তো ভারতীয় ফুটবলের অন্তরাত্মা।