সাঁ দেনি পোর্তে দ্য প্যারিস স্টেশনে কোনও ফুটবল-পর্যটক নামলে ছবিটা নিশ্চিত কখনও না কখনও তার চোখে পড়বে।
সোজাসুজি নয়, তাকাতে হবে নীচে, পায়ের কাছে। পর পর অনেক পায়ের ছাপ চলে গিয়েছে সামনে। তাতে একটা ইউরো ট্রফির ছবি, একটা ফুটবল স্টেডিয়াম, আর একদম শেষে একটা তিরচিহ্ন। ওটা ধরে-ধরে এগিয়ে গেলেই হল। বাইরে উঠে এলে যে ফুটবল-অট্টালিকা দেখা যায়, ওটাই এ দেশের ফুটবল-হৃদয়, শ্রেষ্ঠ ফুটবল-পীঠস্থান।
স্তাদ দ্য ফ্রাঁস।
কিন্তু পায়ের ছাপ ধরে উঠে এলে আরও একটা জায়গায় ঢুকে পড়া যায়। ফুটবল স্টেডিয়াম পিছনে রেখে যদি রাস্তা পেরিয়ে পর্যটক হাঁটতে থাকে, সে ঢুকে পড়বে আর একটা ফ্রান্সে। ফ্রান্সের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা আর এক ফ্রান্সে।
যে ফ্রান্স স্বভাবসিদ্ধ চুপচাপ প্রকৃতির নয়। বরং প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ভাবে আড্ডা-গল্প-হইহল্লায় ডুবে।
যে ফ্রান্সে অচেনা কারও সঙ্গে দেখা হলে ‘বঁ জুর’ বলাটা স্বাভাবিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। বরং কথা-টথা শেষ করে একটা হাই-ফাইভ করলেই চলে।
যে ফ্রান্সে শঁজেলিজের অভিজাত শপিং সেন্টার নেই। আভিজাত্যের চোখ ঝলসানো ঝাড়বাতি নেই। বরং অগুনতি ফলের বাজার আছে, আর আছে দশ মিটার ছেড়ে-ছেড়ে একটা করে সেলুন। আর হ্যাঁ, ওই ফলের দোকানের মালিক বা সেলুন কর্মীদের পূর্বপুরুষ কেউ ইংলিশ চ্যানেলের এ পারে জন্মগ্রহণ করেননি।
কেউ এঁরা সেনেগালের, কেউ হাইতির। কেউ আবার দিদিয়ের দ্রোগবার দেশ আইভরি কোস্ট ছেড়ে এসেছেন দীর্ঘ ষোলো বছর হয়ে গেল।
রবিবার শেষ ষোলোর ম্যাচ, আপনারা ফ্রান্সকে সমর্থন করবেন তো? কাকে বেশি পছন্দ? পোগবা না পায়েত?
ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে এঁদের ভুরু কুঁচকে যায়, চোখের নীরব ভাষায় যেন লেগে থাকে অপমানের ছোঁয়া। কালো দাড়ির ফাঁক দিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে তিতকুটে শ্লেষ ভেসে আসে, “তা হলে কাকে করব? ইংল্যান্ডকে? জার্মানিকে? ফ্রান্সে থাকি, আর কাকে সমর্থন করব সেটা জিজ্ঞেস করছ?” রেগেও তো যান কেউ কেউ। এতটাই যে, নাম পর্যন্ত বলতে চান না। কোথাকার সাংবাদিক, কার্ড কোথায়, কীসের ইন্ডিয়া, এ সব বেখাপ্পা প্রশ্ন পাল্টা উড়ে আসে। উষ্মা মিশিয়ে শোনানো হয়, বিদেশি সাংবাদিকদের এই জন্য প্রথমেই ‘ইংরেজি জানি না’ বলে দেওয়া ভাল। যত সব উদ্ভট লোকজন, আর তাদের উদ্ভট যত কথাবার্তা!
ফরাসি ফুটবলের ইতিহাস ঘাঁটলে এ সব কিম্ভুত প্রশ্নের কোনও জায়গাই নেই। ফ্রান্সকে সমর্থন করেন কি না, এ ধরনের প্রশ্ন করাও সত্যি যুক্তিহীন এবং দাঁত খিঁচুনিও প্রাপ্য। ফ্রান্স ফুটবলকে কম সমৃদ্ধ করেননি ভিন্দেশিরা। লোকে যাঁদের বলে ‘মাইগ্র্যান্টস’। মিশেল প্লাতিনির টিম একটা তিগানাকে বাদ দিয়ে ভাবা যেত না। ফ্রান্স নয়, জন্মসূত্রে তিনি সুদানের। পরবর্তী কালে থিয়েরি অঁরিও ফরাসি ফুটবলকে কম কিছু দেননি। যিনি শ্বেতাঙ্গ নন। আজকের পল পোগবা বা দিমিত্রি পায়েত যে ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। পোগবাকে ফরাসি ফুটবলের ভবিষ্যৎ বলা হয়। বলা হয়, পোগবার বয়সে প্লাতিনি ন্যানসিতে খেলে বেড়াতেন। সেখানে পোগবাকে তুলে নিতে এখন জোসে মোরিনহোর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ঝাঁপিয়েছে। অথচ তিনি, পোগবা জন্মসূত্রে ফ্রান্সের নন। গায়ানার। অতশত খোঁজারও দরকার নেই। ফ্রান্স ফুটবলের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার জিনেদিন জিদানই আছেন। যিনি জন্মসূত্রে আলজিরীয়।
তবু তো প্রশ্ন ওঠে। মাঝেমধ্যেই বলা হয়, আফ্রিকার লোকজনই নাকি
এ দেশে যত কালান্তক রোগ নিয়ে এসেছেন! এঁরা আসায় চুরিচামারি বেড়ে গিয়েছে ফ্রান্সে, এমন অভিযোগও বেমক্কা তোলা হয়। বলা হয়, ফ্রান্সে চাকরির বাজারটা নাকি এঁরাই খেয়ে নিচ্ছেন, আর তাই ‘খাঁটি’ ফরাসিরা বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর পরেও বদনামের যদি কিছু বাকি থাকে, সেটা জুড়ে দিয়েছে ২০১৫-র জানুয়ারি আর নভেম্বরে প্যারিসে দু’টো জঙ্গি হানা। ‘তবে কি ওদেরই কেউ...?’ নির্মম সন্দেহ-জাল ঘিরতে শুরু করেছে তার পর থেকেই!
অথচ সাঁ দেনির রাস্তায় দাঁড়িয়ে এ সব তো মনে হয় না! মনে হয়, অলীক কল্পনা সব। দিদিয়ের দেশঁর টিমের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যই এই মানুষগুলোর প্রধান এবং আসল পরিচয়।
গাম্বিয়ার সুলেমান যেমন। প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল প্যারিসে পড়ে। দেশ থেকে স্ত্রী ওয়াহিদাকে আনিয়ে নিয়েছেন। ছেলে ইব্রাহিম কবে থেকে ফ্রান্স সমর্থক হয়ে গিয়েছে, বুঝতেও পারেননি। সাঁ দেনিতে নিজের সেলুন চালান। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “এই দেশটা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। পোগবা, মাতুইদি, পায়েতদের আমি হৃদয়ে রাখি। আমার ছেলে পুরোদস্তুর ফ্রান্স সমর্থক। চেষ্টা করছি দু’টো টিকিট কেটে কাল ম্যাচটা দেখতে যাওয়ার।”
ইন্টারনেট খুঁজে দেখা গেল, আইরিশদের সঙ্গে রবিবারের যুদ্ধের আগে পায়েত নিয়ে মুগ্ধতার আবেশে ডুবে দু’জন ফরাসি কিংবদন্তি। জিদান মনে করেন, পায়েত ইউরোপের যে কোনও টিমে শুধু ঢুকবেন না, সেই টিমকে উন্নতির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি। এতটাই তাঁর শিল্প, এতটাই সৃষ্টি। অঁরির আবার সবচেয়ে ভাল লাগছে পায়েতের মনোভাব। “ও প্রত্যেকটা ম্যাচ যেন নিজের শেষ ম্যাচ ভেবে খেলে,” বলে ফেলেছেন অঁরি।
একই মুগ্ধতা, একই রোম্যান্স হাইতির বছর চব্বিশের ছেলেটার মুখেও। পায়েতের নাম শুনলে তাঁর মনের আকাশে সূর্য ওঠে। হাসতে হাসতে হাইতির পিটার বলে ফেলেন, “পায়েত, পায়েতই আমার হিরো। গোল করছে ও। পোগবা বিখ্যাত। কিন্তু পায়েত ব্রিলিয়ান্ট। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের কোচ দুর্দান্ত সামলাচ্ছে পায়েতকে। দারুণ ভাবে খেলাচ্ছে।”
আর ‘আমাদের’ কোচ? দিদিয়ের দেশঁ? বর্ণবৈষম্যের চরমতম অপবাদ তাঁকে প্রায় রোজই দিয়ে যাচ্ছেন না এরিক কঁতোনা? বলছেন না যে, লোকটা বর্ণবৈষম্যে দুষ্ট বলেই এক বিশেষ সম্প্রদায়ের করিম বেঞ্জিমাকে টিমে নিল না? সেই কোচের জন্যই এখানে, সাঁ দেনির এক টুকরো আফ্রিকায় সম্মানের রেড কার্পেট! অবিশ্বাস আরও বাড়ে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর মালিকের কথা শুনলে। আইভরি কোস্টের যুবককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পোগবা-পায়েত নিয়ে। উত্তরে যিনি বললেন, পায়েত নন। পোগবাও নন। তাঁর পছন্দ আঁতোয়াঁ গ্রিজম্যান। ফুটফুটে ফর্সা ফরাসি স্ট্রাইকার! যাঁর পা থেকে রবিবার তিনি গোল দেখতে চান!
ফরাসি মিডিয়া লিখেছিল, দিদিয়ের দেশঁর এই টিমটাও তাঁর আটানব্বইয়ের টিমের মতো। বিশ্বজয়ী যে টিমের অধিনায়ক ছিলেন দেশঁ। মহাতারকা জিদান ছিলেন যে টিমের পাওয়ার হাউস। সেই টিমে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের সঙ্গে আরব বংশোদ্ভূতরাও মিশে গিয়েছিলেন এক মোহনায়। শনিবার সাঁ দেনি ঘুরে মনে হল, ফরাসি মিডিয়া একটু ভুল লিখেছিল। শুধু তো দেশঁর এগারো নয়, ইউরোর ফ্রান্স এখন পুরোটাই তাই। জিদানদের বিশ্বজয়ী টিমের মতোই ‘সিম্বল অব টলারেন্স’, সর্বধর্ম সম্মেলনের প্রতীক।
ব্ল্যাক-ব্লাঁ-বয়ের!