দাপট: এই ভাবেই বোলারদের উপর রাজ করতেন স্যর এভার্টন উইকস (ছবি ইডেনের ইনিংসের নয়)। ফাইল চিত্র
ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, ক্লাইড ওয়ালকট আগেই চলে গিয়েছিলেন। বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউজ’-এর শেষ প্রতিনিধি স্যর এভার্টন উইকসও এ বার চলে গেলেন। তিন জনে মিলে ১৪৩ টেস্ট খেলে ৩৯ সেঞ্চুরির মালিক। তবে শুধু ক্রিকেট মাঠের সাফল্য দিয়ে মহাত্রয়ীকে বিচার করলে ঠিক হবে না। ‘থ্রি ডব্লিউজ’-এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল বৃহত্তর আকাশে।
ওরেল ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম দীর্ঘমেয়াদি কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। ওয়ালকট ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি-র প্রথন অ-শ্বেতাঙ্গ চেয়ারম্যান। তবে সম্ভবত উইকস ছিলেন ত্রয়ীর মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান। ম্যাচ রেফারিও হয়েছিলেন পরে। ইডেনে মাত্র একটি টেস্ট খেলেছিলেন উইকস। তাতেই ঢুকে রয়েছেন ইতিহাসে। ওই একটি টেস্টেই জোড়া সেঞ্চুরি করে বাঙালি ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। আমি ভাগ্যবান সেই টেস্টে ইডেনে হাজির ছিলাম। ওঁর রাজকীয় ব্যাটিংয়ের সাক্ষী থাকতে পেরেছিলাম। প্রথম ইনিংসে করেন ১৬২ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ১০১। বিশেষ করে চোখে লেগে রয়েছে ১৬২ রানের ইনিংসটা। মাঠের যে প্রান্তে বল পাঠাতে চাইছিলেন, সেখানেই যেন ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন উইকস। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। থাকতাম হাওড়ায়। ভারত সফরে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। তৃতীয় টেস্ট কলকাতায় হবে শোনার পরেই ঠিক করে ফেলি, আমরা ইডেনে যাব খেলা দেখতে। ‘থ্রি ডব্লিউজ’-এর বিখ্যাত তারকাদের চোখের সামনে খেলতে দেখার সুযোগ কোনও অবস্থাতেই হাতছাড়া করা যাবে না। যদিও সে বার ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের খেলা দেখার আশা অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। শুনেছিলাম, পড়াশোনা করবেন বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল থেকে তখন কিছু দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন তিনি।
উইকস তখন দুর্ধর্ষ ফর্মে। টানা তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি করে কলকাতায় খেলতে আসছেন। ফলে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা তুঙ্গে। সেই সময় ভারতীয় দলও দুর্দান্ত ছিল। লালা অমরনাথ, বিজয় হজারে, বিনু মাঁকড়, মুস্তাক আলিদের সঙ্গে ছিলেন বাংলার মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই টেস্টে উইকস আর ওয়ালকটের হাতে শাসিত হওয়া ভারতীয় বোলারদের মধ্যে উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। পাঁচ উইকেট নিলেও অজ্ঞাত কারণে আর কখনও সুযোগ জোটেনি তাঁর কপালে।
কলকাতা ময়দানে আমি ১৯৪৫ সাল থেকে নিয়মিত খেলা দেখি। ইডেন আমার হৃদয় জুড়ে। সর্বকালের সেরা সব কিংবদন্তিদের খেলা দেখেছি ইডেনে বসে। কিন্তু উইকসের মতো ব্যাটসম্যান খুব কমই দেখেছি। যেমন দুর্ধর্ষ হুক-পুল-কাট মারতেন, তেমনই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো ড্রাইভ মারতেন। একই সঙ্গে সামনের ও পিছনের পায়ে এত সাবলীল ব্যাটসম্যান সত্যিই বিরল। বাহাত্তর বছর আগের ইডেন সেই নানা রংমশালেরই সাক্ষী ছিল।
১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর টেস্ট শুরু হয়েছিল। তখন শীতকালে বিশেষ আকর্ষণ ছিল কলকাতার নিউ ইয়ার টেস্ট। খুব সকাল-সকাল দাদাদের সঙ্গে হাওড়া থেকে ইডেনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। টস জিতে ব্যাটিং নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুরুতেই বিপর্যয়। খুব অল্প রানে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে গিয়েছিল অতিথিরা। দু’টো উইকেটই নিয়েছিলেন আমাদের মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার ওয়ালকটের সঙ্গে যোগ দিলেন উইকস। ধীরে ধীরে ম্যাচের রং বদলাতে শুরু করল।
উইকসের মতো আগ্রাসী ব্যাটিং সেই সময় তো কাউকে করতে দেখিইনি, পরবর্তী কালে ভিভিয়ান রিচার্ডস ছাড়া কারও খেলাতেও এই আগ্রাসন দেখিনি। উইকস যে টানা পাঁচটি টেস্ট সেঞ্চুরির বিরল কীর্তি গড়েছিলেন, তার চতুর্থ ও পঞ্চমটি ছিল ইডেনে। এত দিন পরেও চোখে লেগে রয়েছে সেই দর্শনীয় ব্যাটিং। প্রত্যেকটা শটের মধ্যেই ছিল শিল্প। কী অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স! ৪৮ টেস্টে ৪৪৫৫ রান করেছেন। গড় ৫৮.৬১ টেস্টের অন্যতম সেরা। ওয়ালকট-উইকস যুগলবন্দিতেই ইডেনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দুই ‘ডব্লিউ’ তৈরি করে দিয়ে গেলেন দলের ইনিংস। পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার ভঙ্গি বদল করতে পারাটা ছিল ওঁর শক্তি। আর হাতে ছিল সব ধরনের স্ট্রোক। আমার মতে, ‘কমপ্লিট ব্যাটসম্যান’।
লড়াই ছিল উইকসের রক্তে। বার্বেডোজে প্রবল দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়েছেন। ১৪ বছর বয়সে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে দেন। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজে শ্বেতাঙ্গ মানুষদের আধিপত্য। ফলে কিশোর উইকসের স্থানীয় ক্লাবে খেলাও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলও দুর্দান্ত খেলতেন উনি। ক্রিকেটের প্রতি এতটাই ভালবাসা ছিল যে, খেলার সুযোগ পাওয়ার জন্য দু’দলেই পরিবর্ত হিসেবে ফিল্ডিং করতেন। কেনসিংটন ওভালে মাঠকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন। এই কাজ করতে গিয়েই বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। যা উইকসের ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে ওঠাই খেলার মাঠে হার-না-মানা মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছিল।
ইডেনের সেই টেস্ট শেষ পর্যন্ত ড্র হয়েছিল। তা নিয়ে অবশ্য আমার মতো অসংখ্য ক্রীড়াপ্রেমীর মনে কোনও দুঃখ ছিল না। ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের খেলা দেখতে না-পারার দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম উইকসের জোড়া সেঞ্চুরিতে। আর একটা ব্যাপার নজর করেছিলাম যে, উইকস একদমই তুলে বল মারতেন না। মাটিতে খেলতেন। ওঁর ইনিংসে ছয় প্রায় থাকতই না, চারই বেশি মারতেন। শুধু বাউন্ডারির উপর ভর করে বোলারদের শাসন করাটাও বিরল।
কলকাতার পরে চেন্নাইয়ে (তখন মাদ্রাজ) ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ চতুর্থ টেস্ট ছিল। সেই সময় রেডিয়োই ছিল ভরসা। উইকস যে রকম ফর্মে ছিলেন, আমরা নিশ্চিত ছিলাম ছ’নম্বর সেঞ্চুরি পাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ৯০ রানে আউট হয়ে যান তিনি। পরে শুনেছিলাম, ভুল আম্পায়ারিংয়ের সিদ্ধান্তে রান আউট দেওয়া হয় ওঁকে। না হলে সেঞ্চুরির ডাবল হ্যাটট্রিক হয়তো আটকাত না।