ভারতীয় ক্রিকেট অলিন্দের ফিসফাস বিশ্বাস করলে তিন সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির আইডিয়াটা স্বয়ং বোর্ড প্রেসিডেন্টের!
শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ মেনেই হোক। বা নিজের ভাবনায় হোক, ডালমিয়ার নাকি অ্যান্ড্রু স্ট্রস যে ভাবে ইসিবি চালাচ্ছেন সেই মডেলটা মনে ধরেছিল। প্রাক্তন ইংল্যান্ড অধিনায়ক এখন ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের এমনই সর্বেসর্বা যে, টিম কোন মডেলে খেলবে থেকে শুরু করে পিটারসেনকে আদৌ ফেরানো হবে কি নার মতো স্পর্শকাতর ব্যাপারেও তিনিই প্রথম ও শেষ সিদ্ধান্ত।
তা ভারতীয় ক্রিকেটে ডালমিয়া যখন তিনজন স্ট্রসের কথা ভাবতে থাকেন, কারও কারও মনে হয়েছিল তাঁর আগেকার দাপট থাকলে ‘স্ট্রস’ একজনই হতেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
যাই হোক, প্রথম যখন উপদেষ্টা কমিটির কথা ভাবা হয়, এটাও ভাবনায় ছিল যে এঁদের কাজের জন্য সন্তোষজনক পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা থাকবে। ষাট-সত্তর দশকের অনেক গৌরবজনক ক্রিকেটার আজও প্লেন টিকিট, পাঁচ তারা হোটেল আর দিনান্তে ব্ল্যাক লেবেল থাকলে সানন্দে এই জাতীয় কমিটিতে ঢুকে পড়বেন।
কিন্তু সচিন-সৌরভরা হলেন আধুনিক সুপারস্টার। তাঁরা খেলা ছাড়ার পর আরও বেশি ব্যস্ত। দেশে ক্রিকেট-নীতি ঠিক করার দায়িত্ব কেন নিতে যাবেন অন্য বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ ছেড়ে? যদি না স্ট্রসের মতোই যথেষ্ট ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকে! এঁরা আভাস দিলেনও যে, অন্য কাজ ছেড়ে কমিটিতে এলে তাঁদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কেমন হতে পারে। অর্থাৎ টাকা দিলে তবে কমিটিতে ঢুকব।
অথচ তার পর সবাইকে আশ্চর্য করে দ্রুতই জানা গেল যে এটা বোর্ডের আর পাঁচটা কমিটির মতোই। এককালে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলে থাকার জন্য ক্রিকেটারদের টেকনিক্যাল পরামর্শের জন্য কোটি টাকা দেওয়া হত। কিন্তু এই কমিটির জন্য তেমন কিছু বরাদ্দ নেই। ফিন্যান্স কমিটি থেকে এঁদের পেমেন্টের জন্য অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।
স্ট্রস-পর্ব তখনই এক রকম শেষ! এর পর বোর্ড আকারে-ইঙ্গিতে বলল, টাকা না দেওয়া হলেও যাবতীয় ক্রিকেট-নীতি এঁরাই ঠিক করবেন। এমনকী ভারতীয় দলের উপর নজরদারিও নাকি করবে কমিটি। আর কোচও ঠিক করবে।
এক মাস হয়ে গেল তাদের প্রথম বৈঠকের। কোচ ঠিক হওয়া তো দূরস্থান— কোচ নিয়োগ নিয়ে কোনও বৈঠকও হয়নি। সার্কিটের আর পাঁচ জন সাংবাদিকের মতোই তাঁরা শুনছেন কাউকে নাকি রাজি করানো যাচ্ছে না ভারতীয় কোচ হতে। আইপিএলের সফলতম রিকি পন্টিং অনেক বেশি টাকা মাত্র দু’মাসে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স থেকে পান। তাঁর রাজি হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু স্টিভন ফ্লেমিংও নাকি উৎসাহী নন। এমনকী ড্যানিয়েল ভেত্তোরিও না বলে দিয়েছেন। বিদেশিদের মধ্যে বাকি পড়ে থাকছেন একমাত্র টম মুডি।
মুডিকে কি ডাকা হবে তাঁর প্রেজেন্টেশন পেশ করতে? না কি এখন কাউকে কোচ করাই হবে না? কেউ জানে না। টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীর মন্তব্য কাগজে-টিভিতে দেখে অবশ্য সকলেরই ধারণা জন্মাচ্ছে, তিনিই রিয়েল বস্। কোচ-টোচ নিয়ে যতক্ষণ তিনি না ভাবছেন, কমিটি কে?
ডালমিয়া যদিও এ দিন সিএবি-তে বলেছেন, কোচ পরের মাসে উপদেষ্টা কমিটি বসে ঠিক করবে। সৌরভদের কমিটি।
সত্যিই তাই? কেউ জানে না। তবে সচিন-সৌরভদের নিয়েও এমন হাই প্রোফাইল একটা জমায়েত যে এত দ্রুত একটা গড়পড়তা চা-বিস্কুট সঙ্ঘের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, তা কল্পনাতীত। বাংলাদেশে সর্বকালীন লজ্জার সিরিজ হেরে টিম ফিরেছে হপ্তাখানেক হল। এখনও তা নিয়ে কোনও আলোচনা হল না। অথচ স্পনসররা অনেকে আতঙ্কিত, পারফর্ম্যান্স এই পর্যায়ে নামলে লোকে টিভি-তে ভারতীয় দলের খেলাই দেখবে না।
আগেকার ডালমিয়া হলে হারের পরের দিনই অবধারিত একটা মোবাইল বৈঠক বসিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে প্রাথমিক তদন্ত সেরে নিতেন। এখনকার ইনি অতীতের অপভ্রংশ। সিএবি-তে গত ন’মাসে একটা ওয়ার্কিং কমিটি মিটিংই ডাকতে পারেননি তো বোর্ডের উপদেষ্টা কমিটির সভা!
এঁদের মধ্যে আবার সচিন বিদেশে। সৌরভ লন্ডন চলে যাচ্ছেন ১১ জুলাই। লক্ষ্মণ হায়দরাবাদে। পর্যালোচনাটা তা হলে করবে কে? হবেই বা কোথায়? কেউ জানে না। ধরা যাক হল। কিন্তু কমিটি কী ঠিক করবে? রবি শাস্ত্রীকে কোচ বাছবে? সে তো বোর্ড ঠারেঠোরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত বেছেই দিয়েছে।
তার চেয়েও বড় কথা, কমিটির কি আদৌ পারফরম্যান্স নিয়ে পর্যালোচনার কোনও এক্তিয়ার আছে? না কি তাঁরা গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল! শাস্ত্রী বাংলাদেশে ভারতীয় পারফরম্যান্সের ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই দেবেন। কিন্তু টিমের উপর কোনও উঁকিঝুঁকি, কোনও রকম খবরদারি তাঁর একেবারেই পছন্দ না। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, টিমটা প্রথমে ক্যাপ্টেন। তার পর তাঁর এলাকা। তৃতীয় ব্যক্তির ছায়া অনভিপ্রেত নয়। তার চেয়েও বেশি। বরদাস্তই করবেন না।
জুনিয়র টিমের কোচ তিনি রাহুল দ্রাবিড়ও বকলমে এক ধাঁচের। দ্রাবিড় জুনিয়রদের নিয়ে প্ল্যানিংটা নিজে করবেন এবং তাঁর মাপের ব্যক্তিত্বের কাছে সেটাই প্রত্যাশিত। সমস্যা হল তা হলে ভিভিএস লক্ষ্মণ কী করবেন? কথা ছিল যে এনসিএ এবং জুনিয়র ক্রিকেটের দায়িত্বভার তাঁকে অর্পণ করা হবে। দ্রাবিড় আর শাস্ত্রী যদি নিজের নিজের এলাকাটা দক্ষ ভাবে দেখে দেন, তা হলে বাকি তিনজন নিয়ে ভিড় বাড়াল কেন বোর্ড?
কমিটির কথা তো মনেও হয় না কোনও গুরুত্ব পাচ্ছে বলে। তাদের প্রথম সুপারিশই এখন অবধি মানা হয়নি। যা কলকাতার বৈঠকে পেশ করা হয়েছিল।
কমিটি বলেছিল ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারকে সরাও। ব্যাটিংটা শাস্ত্রী সামলে দিতে পারবে। বরং সাপোর্ট স্টাফে স্পিন কোচ আনো। সৌরভের সম্ভবত এটা সুপারিশ ছিল যে নরেন্দ্র হিরওয়ানিকে ভাবা হোক এই জায়গায়। স্পিন কোচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্পিনই ভারতকে বেশির ভাগ ম্যাচ জেতায়।
জিম্বাবোয়ে সফরের সাপোর্ট স্টাফ নির্বাচন দেখে বোঝা গেল না প্রস্তাবটা কবে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে গিয়েছে। সে দিনই? না কিছু দিন পরে?
না কি বোর্ড বলতে চায় হরভজন সিংহকে ফেরানোটা স্পিন বোলিং কোচ হিসেবে?