নিয়মরক্ষার ম্যাচে নামার চব্বিশ ঘণ্টা আগে ফুরফুরে টিম ইন্ডিয়া। অকল্যান্ডে প্র্যাকটিসের ফাঁকে রোহিত-বিরাটের আড্ডা। ছবি: দেবাশিস সেন।
‘ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ’-এর মতো গড়বড়ে দিনে কিনা ধোনির ভারতকে কঠোর প্রস্তুতি সারতে হল বিশ্বকাপে জয়ের ছক্কা হাঁকানোর লক্ষ্যে! তবু ক্রিকেটপণ্ডিতদের অধিকাংশের ধারণা, ইডেন পার্কে জিম্বাবোয়েকে হারানোটা এই মুহূর্তে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, ক্রিকেট খেলাটার তিন বিভাগেই টগবগে থাকা ভারতের কাছে পার্কে বেড়ানোর মতোই সহজ হবে। সে যতই ম্যাচটা শনিবারের বারবেলায় (নিউজিল্যান্ড টাইমে দুপুর দুটোয়) শুরু হোক না কেন!
‘ক্যাপ্টেন কুল’ এমনই এক বাস্তববাদী চরিত্র যে তাঁর টিমও এ সব পাঁজিপুঁথির চেয়ে অনেক বেশি নিজেদের ক্রিকেট-ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। ধরে নেওয়াই যায়, পুল বি-তে পাঁচ ম্যাচে একটিমাত্র জয়ের মুখ দেখা প্রতিপক্ষকে তারা পেড়ে ফেলতে চাইবে। ধোনি কেমন ক্যাপ্টেন, তার ব্যাখ্যা আজই টাটকা দিয়েছেন ভারতীয় দলের বাংলা পেসার। মহম্মদ শামি এ দিন অকল্যান্ডে ভারতীয় শিবিরের পক্ষে প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন। মানে সাধারণত পোস্ট ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলন ছাড়া চলতি বিশ্বকাপে মিডিয়ার প্রায় ছায়াই না মাড়ানো ভারত অধিনায়ক এ দিন শামিকে পাঠিয়েছিলেন সাংবাদিকদের সামনে।
এবং টুর্নামেন্টে ভারতের সফলতম বোলার (এখনও পর্যন্ত ১২ উইকেট) তাঁর সাফল্যের পিছনে ধোনির অবদান সম্পর্কে সাফ বলছেন, “এমএসের জন্য তো আমি বাংলা দলের ড্রেসিংরুমের চেয়েও ভারতীয় দলের ড্রেসিংরুমে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি।” আর বিশ্বকাপে? “ওর (ধোনি) কখনও বিরাট চাহিদা নেই। ও মোটেই সেই ধরনের নয় যে আমার কাছে নির্দিষ্ট কিছু দাবি করে। বরং সব সময় আমার ভুলত্রুটি শুধরে দেয় আর আমাকে শুধু বলে, ভবিষ্যতে আর এই ভুল করো না ভাই,” বলেছেন শামি। সাধারণত কম কথা বলতে অভ্যস্ত শামিও যেন এ দিন তাঁর অধিনায়ক সম্পর্কে বলতে গিয়ে উচ্ছ্বাস সামলাতে পারছিলেন না। এর পরে আরও যোগ করেন, “ধোনি এত শান্ত ভাবে এই সব কথা বলেটলে, যে কোনও পরিস্থিতি এত ঠান্ডা মাথায় সামলায়, একজন বোলারের পাশে যে ভাবে সব সময় দাঁড়ায়, সেটা সত্যিই দেখবার মতো!”
বিশ্বকাপে পাকিস্তান-বধের ছক্কা হাঁকিয়ে এ বারের টুর্নামেন্ট শুরু করা টিম ইন্ডিয়া-র সামনে কাল গ্রুপে ছয়ে ছয় করার সুযোগ। আর এই ছক্কাটা হাঁকাতে পারলে ধোনির দল ক্নিনশিট নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে নামবে। যে কৃতিত্ব চোদ্দো দলের বিশ্বকাপে অন্যতম উদ্যোক্তা দেশ নিউজিল্যান্ড ছাড়া আর কারও নেই। জিম্বাবোয়েকে হারালে গ্রুপে পুরো ১২ পয়েন্ট নিয়ে নক আউট যুদ্ধে নামবে ভারত। যে নজির অন্য গ্রুপে নিউজিল্যান্ড আজই গড়ল বাংলাদেশকে হারিয়ে। যাদের বিরুদ্ধেই বৃহস্পতিবার এমসিজিতে শেষ আটের লড়াই ধোনিদের। এবং সেটা এ দিনই চূড়ান্ত হয়ে গেল।
গঙ্গা-পদ্মার সেই আবেগের লড়াইয়ের আগে শেষ ম্যাচেও কিন্তু মহেন্দ্র সিংহ ধোনি দল নিয়ে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেতে নারাজ। ভারত অধিনায়কের ব্যাখ্যা, জয়ী টিমের কম্বিনেশন ভাঙতে গেলে তিনি নাকি সবার আগে দলের ফিজিওর কাছে পরামর্শ চাইবেন। জানতে চাইবেন, প্রথম এগারোর কোনও ক্রিকেটারের বিশ্রাম দরকার কি না। যেহেতু এই মুহূর্তে উইনিং টিমের কারও কোনও চোট নেই সে জন্য ধোনির দর্শন— এ বারের বিশ্বকাপে এমনিতেই ভারতের দুটো ম্যাচের মাঝে বেশ কয়েকদিন ব্যবধান থাকছে। প্লেয়ারদের এমনিতেই তার মধ্যে বিশ্রাম হয়ে যাচ্ছে। খামোখা আবার কাউকে বাড়তি বিশ্রাম দিতে গিয়ে উইনিং কম্বিনেশন ভেঙে দলের ছন্দ করার সামান্যতম ঝুঁকিও নেব কেন!
যদিও জিম্বাবোয়ে সেই নব্বই দশকের ফ্লাওয়ার-ভাইদের কিংবা হিথ স্ট্রিক, মারে গুডউইন, নিল জনসনদের জিম্বাবোয়ে নেই এখন। এমনকী এ বারের নিয়মিত ক্যাপ্টেন এল্টন চিগুমবুরার চোটে শনিবারের ম্যাচে স্ট্যান্ড-ইন ক্যাপ্টেন ব্রেন্ডন টেলর আজই বলে দিয়েছেন, “ভারতের বিরাট ব্যাটিং লাইন-আপ তো বটেই, ওদের পেস আর সুইং বোলিংও আমাদের বিপদে ফেলতে পারে।” আর টেলরের প্রতিপক্ষ অধিনায়ক? তা হলে শুনুন শামির মুখে— “ধোনির নেতৃত্বে আমি ভারতীয় দলে তিনটে ফর্ম্যাটেই অভিষেক ঘটিয়ে খেলে চলেছি। ওর সাপোটর্টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে আমার জার্নিতে। আমি যখন ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলার হয়ে খেলা শুরু করি, তখন ভাবতাম দলের সিনিয়রদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলাটা উচিত হবে! ভারতীয় দলে সুযোগ পেলেই বা ওখানে সিনিয়রদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলা উচিত। কিন্তু গত দু’বছর ভারতীয় ড্রেসিংরুমে কাটিয়ে আমার মনে হয়েছে, বাংলার চেয়ে আমি বেশি স্বচ্ছন্দ এখানে।”
শামি আরও জানাচ্ছেন, অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের পার্ট ওয়ান-এর খারাপ দিনগুলোকে তাঁরা নিজেদের মন থেকে মুছে ফেলতে পারাতেই পার্ট টু-তে (পড়তে হবে বিশ্বকাপে) এত ভাল পারফরম্যান্স হচ্ছে। “যখনই আমার একটা খারাপ দিন বা খারাপ সময় কাটে, আমি প্রথমে ঘরে বসে নিজের ভুলভ্রান্তি নিয়ে ভাবি। তার পরে সেগুলো নিয়ে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলি। পরামর্শ নিই। সেই মতো পরের দিনের প্র্যাকটিসে শুধরে নিই। ফির ম্যায় মস্ত বন যাতা হু। তার পরই আমি একদম চাঙ্গা হয়ে যাই পরের ম্যাচে ভাল পারফর্ম করার জন্য। এবং বেশির ভাগ সময় করিও।”
তবে স্বপ্নের উত্থানের জন্য শামি শুধু কেকেআরে ওয়াসিম আক্রমের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোকেই কৃতিত্ব দিতে রাজি নন। বলেছেন, “শুধু আক্রম বা হ্যাডলি নন, অনেক প্রাক্তন পেসারের পরামর্শ মতো প্র্যাকটিস করে এই জায়গায় এসেছি। তার জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞ।”
ভারতের এই ‘উইন-উইন’ অবস্থায় কাপ তোলার ব্যাপারেও আশাবাদী শামি। “বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নটাই তো বিরাট মোটিভেশন। আগের বার সচিন পাজির শেষ বিশ্বকাপ— এই আবেগটা টিমের সব প্লেয়ারের মধ্যে আগাগোড়া ছিল। এ বারও সেই ধরনের আবেগ নিয়েই খেলছি। কে জানে পরের বিশ্বকাপে আমাদের এই টিমের কাকে আমরা মিস করব!”