হয় মারো নয়তো মরো

সঙ্গা-বিদায়ী ম্যাচ কিন্তু কোহলির টিমের কাছে দ্বীপভূমিতে জীবনের যুদ্ধ

বিলবোর্ডগুলো এ বার ওভালে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে! যার কোনওটায় লেখা— এই খেলাটার সীমান্ত ছাড়িয়েও ভদ্রলোক। কোনওটায়— অনন্যসাধারণ মর্যাদাসম্পন্ন। কোনওটায়— অনেকে জীবন্ত কিংবদন্তির কথা লেখে, আপনি নিজেই স্বয়ং। কোনওটায়— শ্রীলঙ্কা জাতির অহঙ্কার। কোনওটা মাঠের পশ্চিম কোণে লাগানো হলেও দূর থেকে পড়া যাচ্ছে— তুমি ইতিহাস তৈরি করেছ। এ বার আমরা নতুন সংস্করণের অপেক্ষায়। কোনওটায় আবার শুধুই পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ— হে অসাধারণ যোদ্ধা, বিদায়!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলম্বো শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৯
Share:

শেষ ড্রেস রিহার্সালের মেজাজ বিলবোর্ডে নায়ক। তৈরি হচ্ছেন নেটে নামার জন্য। স্পিন সামলানোর মহড়া। চলছে থ্রো ডাউনও।

বিলবোর্ডগুলো এ বার ওভালে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে! যার কোনওটায় লেখা— এই খেলাটার সীমান্ত ছাড়িয়েও ভদ্রলোক। কোনওটায়— অনন্যসাধারণ মর্যাদাসম্পন্ন। কোনওটায়— অনেকে জীবন্ত কিংবদন্তির কথা লেখে, আপনি নিজেই স্বয়ং। কোনওটায়— শ্রীলঙ্কা জাতির অহঙ্কার। কোনওটা মাঠের পশ্চিম কোণে লাগানো হলেও দূর থেকে পড়া যাচ্ছে— তুমি ইতিহাস তৈরি করেছ। এ বার আমরা নতুন সংস্করণের অপেক্ষায়। কোনওটায় আবার শুধুই পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ— হে অসাধারণ যোদ্ধা, বিদায়!

Advertisement

পি সারা ওভাল যে তাঁকে ঘিরে ক্রমশ ছোটখাটো বিয়েবাড়ির চেহারা নিচ্ছে সকালে প্র্যাকটিসে এসে দেখতেই পেলেন। কুমার সঙ্গকারা তবুও যথাসম্ভব অবিচলিত আর নির্বিকার থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজের বিদায়ী ম্যাচে উইকেটের কাছে গিয়ে কোনও রকমে চোখের জল সামলেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। তার পর ড্রেসিংরুমে ঢুকে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতে সঙ্গা জনসমক্ষে চোখের জল ফেলার পাত্রই নন। শ্রীলঙ্কান দর্শকের নিশ্চয়ই চোখের পাশটা ভিজে আসবে। কিন্তু তিনি শক্ত থাকবেন। আবেগ একান্তই নিজের জন্য। পরিবারের জন্য।

Advertisement

আসলে সঙ্গকারা অনেক বেশি দ্রাবিড়! সচিন নন! ওয়াংখেড়েতে সচিনের বিদায়ী টেস্ট কভার করতে গিয়ে দেখেছি, এই যে তাঁকে ঘিরে একটা অদৃশ্য ৭০ এমএম মঞ্চ তৈরি আর সর্বক্ষণ খুটখাট চলছে তার ওপর, এতে যৎপরনাস্তি তৃপ্ত ছিলেন সচিন। ষোলো বছর বয়স থেকেই তো রূপকথার মঞ্চ তাঁর জন্য তৈরি থেকেছে। বিদায়বেলায় সেই অভ্যেস যাবে কোথায়!

কিন্তু সঙ্গা সুপারস্টার হয়েও আগে দলীয় কর্মী। আদত লক্ষ্য শ্রীলঙ্কার সিরিজ জেতা। তার পর তাঁর অবসর নিয়ে চর্চা। এ দিন সঙ্গাকে ফ্যানদের অনুরোধে বারবার ছবি তুলতে হল ঠিকই। কিন্তু বাড়তি কোনও উচ্ছ্বাস দেখলাম না। একজন পরিচিত রিপোর্টারের সঙ্গেও আলাদা করে কথা বললেন না। ঘনিষ্ঠ ফটোগ্রাফার এসে বলল, আপনার ছবিওয়ালা বিলবোর্ডের পাশে একটু দাঁড়ান না। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন। শুধু একটি নয় বছরের বাচ্চা, যে বাঁ হাতে ব্যাট করে এবং যাকে প্রয়াত টনি গ্রেগ নাম দিয়েছিলেন জুনিয়র সঙ্গা, তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন।

সুতরাং দ্বিতীয় টেস্টের প্লে-ব্যাক খুব পরিষ্কার। আর সেটা বাজা শুরুও হয়ে গিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সঙ্গা-বিরহের রাগ গাইবে না। গাইতে দেবেন না চিরপেশাদার সঙ্গা নিজেই।

কোহলির সমস্যা এতে বিন্দুমাত্র লাঘব হল না। ভারতীয় দলে কেউ কেউ আশায় আশায় ছিলেন যে, শ্রীলঙ্কা ড্রেসিংরুমে আবেগের বিস্ফোরণটা তাদের ম্যাচ-মনযোগকে আক্রমণ করবে। মনে হচ্ছে সেই গুড়ে বালি।

বরঞ্চ হোম টিম ধন্ধে রেখে দিল ওভাল পিচকে তারা কোন চেহারায় এনে পেশ করবে? ঐতিহাসিক ভাবে এটা পেসারের পিচ। ব্র্যাডম্যান এশিয়ায় তাঁর একমাত্র ইনিংসে এখানে মিডিয়াম পেসারকেই উইকেট দিয়েছিলেন মাত্র ২০ রানে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা গলে টের পেয়েছে কোহলির ট্যাটুওয়ালা তরুণরা বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে স্পিনারের মারপ্যাঁচে। কাজেই তৃণমূলীয় পিচ না দিয়ে রাঙামাটির আলিমুদ্দিনসদৃশ উপহার দিতে পারে। যেখানে বল পড়ে ঘুরবে।

চোখের সামনে অবশ্য শ্রীলঙ্কার দ্রুততম দুষ্মন্ত চামিরাকে তারা ওয়ার্ম আপ করাল। চামিরা বল করেন ১৪০-১৪৫ কিমি গতিতে। তাঁকে নিয়ে উদ্যম অবশ্যই ভারতকে বিভ্রান্ত করার জন্য যে, তোরা ভাবতে থাক কোন অস্ত্রটা আমাদের টেস্টে আসল হতে যাচ্ছে— চামিরা, না হেরাথ?

ভারত এমন চাপে যে, দু’দিন ধরে তাজ সমুদ্রের ব্রেকফাস্ট টেবলেও দেখছি ক্রিকেটচর্চাই অনবরত চলছে। সে সাপোর্ট স্টাফ হোক। কী টিম ডিরেক্টর। কী তারকা প্লেয়ার। সকালে কোহলিকে দেখলাম সহ-অধিনায়ক রাহানেকে নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করতে। একটু পর অনুশীলনে ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী হাজির জিঙ্ক অক্সাইড আর শর্টস পরে। গোটা অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মতো চড়া রোদ্দুরের মধ্যেও শাস্ত্রীর মুখে জিঙ্ক অক্সাইড দেখিনি। বলতেন, আমি কোচ নই। ডিরেক্টর। কলম্বোয় বোঝাই যাচ্ছে তিনিও টিমের মতোই ভয়ঙ্কর চাপে।

ভারত যদি এই টেস্ট ম্যাচটাও হেরে যায় তা হলে বেশ কিছু মুণ্ডু যে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত গড়াগড়ি খাবে কোনও সংশয় নেই। কোহলি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন চাপটাকে সামলাতে। এক-এক সময় তাঁকে দেখে মায়াই হচ্ছে। সাতাশ বছরে নেতা। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম চার টেস্টেই চার সেঞ্চুরি। তা-ও প্রথম টেস্ট জিততে পারছেন না।

ঐতিহাসিক ভাবে কলম্বোর ওভাল মোটেও বিলেতের ওভালের মতো ভারতীয়দের প্রিয় মাঠ নয়। তিরিশ বছর আগে এখানেই প্রথম কপিল-গাওস্কর-মোহিন্দর সমৃদ্ধ ভারত শ্রীলঙ্কার কাছে হারে। সেই সিরিজ চলাকালীন খুব মেঘলা ছিল কপিল-গাওস্কর সম্পর্ক। কিন্তু একটা ম্যাচে রয় ডায়াস আর অরবিন্দ ডি’সিলভার আক্রমণে ভারত অধিনায়ক দিশেহারা দেখে স্লিপ থেকে দৌড়ে আসা গাওস্কর তাঁর জন্য ফিল্ড সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সে দিন চণ্ডীমলের শক্তিশেলে যখন বোলিং এবং অধিনায়ক বিধ্বস্ত, কোনও গাওস্করের খোঁজ টিমে পাওয়া যায়নি। তেমন কোনও সহ-খেলোয়াড় নেইও যিনি কোহলিকে গাউড করতে পারেন। অশ্বিন পারতেন। কিন্তু তাঁকে কেন ভাইস ক্যাপ্টেন বাছা হয়নি, রহস্য।

ব্যাটিং লাইন আপেরও কড়া পরীক্ষা নেবে এই টেস্ট। এ দিন টিম হোটেল থেকে ওভাল আসার সময় চোখে পড়ছিল দুর্দান্ত রকম সাজানোগোছানো সব বাড়ি। কলম্বোর সবচেয়ে ঐশ্বর্যবান মানুষেরা এই তল্লাটে থাকেন। কলম্বো ৭ নামেই খ্যাত, আর সেটা ছাড়িয়ে যত এগনো যাবে যেন আলিপুর ছেড়ে মেটিয়াবুরুজের অলিগলি। এটা নিম্নবিত্ত। কলম্বো ৮। ওভাল মাঠটা কলম্বো ৮-এ। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে মনে হচ্ছিল, ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপও যেন কলম্বো ৭ থেকে ৮-এ রূপান্তরিত হয়েছে। ছ’টা স্টার ব্যাটসম্যান দ্রুত চলে গিয়েছে। তার সঙ্গে ধোনি।

কোহলি একটা অদ্ভুত কথা এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন যে, একটা ব্যাটিং অসুস্থতা তাঁরা ধরতে পেরেছেন। সে দিন ব্যাট করার সময় চাপের মুখে ব্যাটসম্যানরা কেউ কারও সঙ্গে বেশি কথা বলেনি। এই টেস্টে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন উন্নত হয়।

শুনে মনে হচ্ছিল স্কুল ক্রিকেটেও এই সব শোনা যায় কি? আসলে একটা নতুন টিম যখন চাপে পড়ে, তখন তাদের নিত্যদিন এমনই রোগ বার হতে থাকে। আবার এই অবস্থায় যে লোহার মন নিয়ে টেনে তুলতে পারে, সে-ই নায়ক বনে যায়। বিপন্ন ভারত এখন দ্বিতীয় টেস্টে তার নতুন নায়ক খুঁজছে। কে হতে পারেন? মুরলী বিজয়? রাহানে? কোহলি নিজে? কে?

কাউকে না কাউকে হতেই হবে। নইলে অনেককে সঙ্গার একই সঙ্গে চিরনিষ্ক্রমণে যেতে হবে। কোহলির ভারত তাই একশো ছাব্বিশ বছরের প্রাচীন মাঠে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে পড়েছে। হয় মারো নয় মরো!

ছবি: দেবাশিস সেন ও এএফপি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement