ব্রোঞ্জের সাক্ষী। ছবি: পিটিআই।
অলিম্পিক্স জিমন্যাস্টিকসের ভল্ট ইভেন্টের ফাইনালে দীপা কর্মকারের ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স দেখার পর বাড়ির বেডরুমে ভাংড়া নেচেছি!
আর বুধবার গভীর রাতে মহিলা কুস্তিগির সাক্ষী মালিক যখন দেশকে প্রথম পদকটা এনে দিল তখন চোখ জলে ভরে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল, প্রায় দু’দশকের স্বপ্নটা এত দিনে সত্যি হল! ভারতীয় খেলাধুলায় এত দিনে কুলিন হতে পারল মহিলা কুস্তিগিররা।
ম্যাচ তখন শেষ। টিভিতে একবার ক্লোজ শটে ধরল সাক্ষীর মুখটা। ও তখন আনন্দ করছে পদক পেয়ে গিয়েছে বলে। কিন্তু কিরঘিজস্তানের কুস্তিগির ততক্ষণে রেফারেলের জন্য আবেদন করে দিয়েছে!
নিজে কুস্তিতে এক সময়ের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। দ্বারকার বাড়ির বেডরুমে দু’ হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তের জন্য চমকে গিয়েছিলাম প্রথমে। তার পরেই রিপ্লেতে দেখলাম সাক্ষীর প্রতিপক্ষের গ্রিপটা ঠিক নেই। তার মানে রেফারেলের জন্য ওর পয়েন্ট কাটবে। আর এগিয়ে যাবে সাক্ষী।
শেষ পর্যন্ত সেটাই হল। পিছিয়ে গিয়েও অলিম্পিক্স কুস্তিতে ভারতের মেয়ের পদক জয়! এই প্রথম বার! ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তাও আবার ০-৫ পিছিয়ে থেকে দু’মিনিটের মধ্যে জয় হাসিল। ম্যাচ শেষ হওয়ার আট সেকেন্ড আগে যখন ও ৫-৫ করল তখন সাক্ষী তুমুল অ্যাটাকে চলে গিয়েছে। সামনে হাত চালিয়ে কিরঘিজস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভয় দেখাচ্ছে ইচ্ছে করে। আর ওর প্রতিপক্ষও তা দেখে পিছিয়ে গিয়ে ডিফেন্স করছিল। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, এ বার সাক্ষী ওর প্রতিপক্ষকে ম্যাটের বাইরে ফেলে দেবে। আর ও করলও তাই। জয়টা যখন ঘোষণা হল তখন রিফ্লেক্স অ্যাকশনে লাফিয়ে উঠেছি। ৮-৫ জিতে সাক্ষী যখন আমাদের জাতীয় কোচ কুলদীপের কাঁধে চড়ে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ম্যাট ছাড়ছে তখন চোখে জল চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল রিও থেকে আজকের পদকটা শুধু সাক্ষীর নয়। এই পদকটা আমাদের দেশের সব মহিলা কুস্তিগিরের।
আজ বেঁচে থাকলে আমার বাবা চাঁদগিরাম হতেন এই গ্রহের সবচেয়ে সুখী মানুষ। ছেচল্লিশ বছর আগে সত্তরের ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমস থেকে কুস্তিতে দেশকে সোনা এনে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে যখন জাতীয় কুস্তি ফেডারেশন মহিলাদের কুস্তির অনুমতি দেয়, তখন শুরুতে কোনও মেয়ে আসত না। তার চেয়েও বড় কথা, পরিবার চাইত না। তখন বাবা আমাকে আর বোন সোনিকাকে কুস্তি শেখাতে শুরু করলেন। বাড়ির মেয়েরা কুস্তি লড়ছে বলে কত সমালোচনা! বাবা ও সবে সেদিন কান দেননি। বলতেন, ‘‘যে দিন মেয়েরা অলিম্পিক্স থেকে কুস্তিতে পদক আনবে সে দিন এরাই কাঁধে তুলে নাচবে।’’ আমি বা আমার বোন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নামলেও বাবাকে অলিম্পিক্সের পদক এনে দিতে পারিনি। যেটা আজ করে দেখাল সাক্ষী। মহিলা কুস্তিগিররাই রিও থেকে এ বার প্রথম পদক এনে দিল দেশকে। এর গর্বই আলাদা।
কোনও কোনও টিভি চ্যানেল সকাল থেকে সাক্ষীকে ‘সুলতান’ বানিয়ে দিয়েছে। আমার কাছে সাক্ষী হৃদয়ে থাকবে সাক্ষী হিসেবেই। কারণ কুস্তি পরিবারের মেয়ে হয়ে আমি রিল লাইফে নই, রিয়েল লাইফেই বেঁচে থাকি। কুস্তিতে দেশের প্রথম মহিলা হিসেবে পদক জয়ী রোহতকের এই ছোট মেয়েটা সাক্ষী গোটা দেশের মহিলা কুস্তিগিরদের দীর্ঘ আঠারো বছরের সংগ্রামের। প্রায় দু’দশকের হতাশা, সমালোচনা, তাচ্ছিল্য সব কিছুকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের পদকটাই ও নিয়ে আসছে রিও থেকে। ওর সাহসের তুলনা হবে না।
কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়ার কোবলোভার কাছে যখন সাক্ষী হেরে গেল তখন ওই রুশ কুস্তিগির যাতে ফাইনালে যায় তার জন্য ঈশ্বরকে ডেকেছি। তা হলেই সাক্ষী রেপেশাজে লড়তে পারত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তিনি আমার প্রার্থনা শুনেছিলেন।
গত বছর এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে দেশে ফেরার পর ওকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। কুস্তিতে দেশের প্রথম অলিম্পিক্স পদকজয়ী মেয়ে সে দিন মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘‘দিদি, রিও যেতে পারলে পদক নিয়ে ফিরব।’’ মেয়েটা শেষ পর্যন্ত আমার বাবার সেই অপূর্ণ স্বপ্নটা সফল করেছে রিওতে। তাই এই আনন্দের শেষ নেই।