একাগ্র: মনঃসংযোগই বড় অস্ত্র বিস্ময়-দাবাড়ু প্রজ্ঞানন্দের। ফাইল চিত্র
মাত্র ষোলো বছর বয়সেই দু’-দু’বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে ঝড় তুলে দিয়েছে দাবা দুনিয়ায়। শুধু এক নম্বর কার্লসেন নন। সম্প্রতি ‘চেসেবেল মাস্টার্স’ প্রতিযোগিতায় প্রথম কুড়ির মধ্যে থাকা প্রতিপক্ষদের হারিয়েও চমক সৃষ্টি করেছে বিশ্বনাথন আনন্দের প্রিয় ছাত্র। ফাইনালে বিশ্বের দু’নম্বর ডিং লিরেনের সঙ্গে চোখে-চোখ রেখে লড়ে হার মানে টাইব্রেকারে। ভারতীয় খেলার নতুন বিস্ময় বালক রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ বুধবার একান্ত সাক্ষাৎকার দিল আনন্দবাজার-কে। কথাবার্তা এতই পরিণত, এমনই দৃপ্ত, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি যে শুনে কে বলবে তার বয়স ১৬!
প্রশ্ন: বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে দু’বার হারানোর জন্য তোমাকে অনেক অভিনন্দন। বিশেষ করে এই দুই জয়ের প্রভাব কী প্রজ্ঞানন্দের জীবনে?
প্রজ্ঞানন্দ: সবার প্রথমে বলি, আমার যে উন্নতি হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছি। দু’বার বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারাতে পেরেছি, ভাবলে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসীও হতে পারছি। নিজের শক্তির উপরে আরও ভরসা রাখতে পারছি। এ বার রেটিংয়ে উন্নতি করার দিকে মন দিতে হবে। আর সন্দেহ নেই, সেই জোরটা দেবে এই জয়গুলো।
প্র: কার্লসেনকে হারানোর আগে প্রস্তুতিটা কেমন ছিল?
প্রজ্ঞানন্দ: আমি প্রতিপক্ষ দেখে নিজের প্রস্তুতি বদল করি না। নিজে যে ভাবে তৈরি হতে পছন্দ করি, যে কোনও ম্যাচ বা প্রতিযোগিতার আগে সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করি। বিশ্বচ্যাম্পিয়নের বিরুদ্ধে খেলতে যাচ্ছি বলেই প্রস্তুতির ধরন পাল্টে ফেলো বা অন্য রকম ভাবে তৈরি হও, এই ভাবনায় আমি বিশ্বাসী নই। আমার মনে হয়, এই ফর্মুলাই আমার জন্য কাজে দিয়েছে। তাই এ ভাবেই চালিয়ে যেতে চাই। যে ভাবে খেলে সফল হচ্ছি, সেটাই ধরে রাখার চেষ্টা করি। কার্লসেনের সঙ্গেও মনোভাব সেটাই ছিল।
প্র: উল্টো দিকে বিশ্বসেরা দাবাড়ু। মানসিক প্রস্তুতির দিকটাও তো থাকে। ১৬ বছরের এক কিশোর কী ভাবে তার মনকে তৈরি করে?
প্রজ্ঞানন্দ: চেষ্টা করি চাপ না নেওয়ার। লক্ষ্য থাকে একটাই— দাবার বোর্ডে সেরাটা দেওয়ার। ফলের কথা সেই মুহূর্তে মাথায় ঢুকতে দিই না। মানসিক ভাবে এই প্রক্রিয়া আমাকে খুব সাহায্য করেছে বড় প্রতিযোগিতায় বা বড় প্রতিপক্ষের সামনে মাথা ঠান্ডা রাখার ব্যাপারে। তাই এ ভাবেই চলতে চাই। আশা রাখি, সামনের রাস্তায় যত দিন যাবে ততই শক্তিশালী দাবাড়ু হয়ে উঠতে পারব। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে পারব।
প্র: বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে দু’বার হারিয়ে সকলের নজরে। ভারতীয় ক্রীড়ার নতুন বিস্ময় বালক। প্রজ্ঞা,,এ বার স্বপ্ন কী?
প্রজ্ঞানন্দ: ছোটবেলা থেকে একটাই স্বপ্ন দেখেছি। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া। এখন সেই স্বপ্ন সফল করার লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছি। বড়-বড়, বিখ্যাত খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলতে আমার ভাল লাগে। তাদের হারিয়ে আনন্দ পাই। তাই সম্প্রতি বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে দু’বার হারানোটা উপভোগ করেছি। আমি আরও বেশি করে বড় খেলোয়াড়দের হারাতে চাই। রেটিং বাড়াতে চাই। আমার লক্ষ্য যে বিশ্বসেরা হওয়া!
প্র: বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারানো কতটা পরিবর্তন আনছে তোমার মধ্যে? খেলোয়াড় হিসেবে, মানুষ হিসেবে?
প্রজ্ঞানন্দ: মানুষ হিসেবে একেবারেই পাল্টাইনি, সেটা প্রথমেই বলে রাখি। খেলোয়াড় হিসেবে এই জয়গুলো আমার মধ্যে বিশ্বাস বাড়িয়েছে যে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমিও সফল হতে পারি। বড় খেলোয়াড়দের হারাতে পারি। এই আত্মবিশ্বাসের প্রভাব অবশ্যই খেলায় পড়বে, পড়ছেও। তাতে বড় ম্যাচগুলোতে অনেক চাপমুক্ত ভাবে, অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, অনেক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলতে পারছি। আমার মনে হয়, এটা একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
প্র: তুমি মানুষ হিসেবে পাল্টাওনি, কিন্তু তোমার চারপাশের পৃথিবী তো দ্রুত বদলাচ্ছে। এই কিশোর বয়সে এমন তারকার পৃথিবী কী ভাবে সামলাচ্ছ?
প্রজ্ঞানন্দ: আমি সত্যিই চেষ্টা করছি, এ সব নিয়ে না ভাবার। দাবা নিয়েই ভাবছি, প্রস্তুতিতে মন দিচ্ছি। অন্য কোনও দিকেই তাকাতে চাই না। শুধু দাবা খেলে যেতে চাই।
প্র: কিংবদন্তি বিশ্বনাথন আনন্দ ঠিক কী ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁর কিশোর ভক্তকে?
প্রজ্ঞানন্দ: আমি আনন্দ স্যরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ ওঁর অ্যাকাডেমিতে আমাকে স্থান দেওয়ার জন্য। সারাক্ষণ উনি আমাকে পরামর্শ দিয়ে চলেছেন, পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। সব সময়ই আনন্দ স্যরের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আমার। অমূল্য সব পরামর্শ উনি আমাকে দিয়েছেন। আমার কোচ রমেশ স্যরও খুব সাহায্য করেন। উনিও আনন্দ স্যরের সঙ্গে আমার খেলা নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলে চলেছেন। কোথায় আমার দুর্বলতা সেগুলো নিয়ে ওঁরা অনেক আলোচনা করেন, যাতে আমি খুঁতগুলো দ্রুত সারিয়ে তুলতে পারি। যাতে আমার খেলাকে আরও পরিশীলিত করতে পারি। আনন্দ স্যরের থেকে প্রত্যেক দিন শিখছি, ওঁর পরামর্শ মতো উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমি ভাগ্যবান এমন এক জন কিংবদন্তিকে পেয়েছি আমাকে পথ দেখানোর জন্য!
প্র: যদি আনন্দ স্যরের একটা মূল্যবান পরামর্শ বেছে নিতে হয়, যা মাথায় গেঁথে গিয়েছে সারাজীবনের জন্য, কোনটাকে বাছবে?
প্রজ্ঞানন্দ: অনেক উপদেশই পেয়েছি আনন্দ স্যরের থেকে, যা মহামূল্যবান আমার কাছে। তবে সব চেয়ে বেশি করে যেটা মাথায় থাকবে, তা হচ্ছে, প্রতিযোগিতা চলাকালীন গণমাধ্যম বা অন্য কোথাও তোমাকে নিয়ে কী বলা হচ্ছে, সে দিকে নজর দিয়ো না। নিজের পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই ব্যাপারটা আমাকে প্রভাবিত করেছে।তাই এই উপদেশটা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছি। তবে সঙ্গে যোগ করতে চাই আবার, আনন্দ স্যরের অনেক অমূল্য পরামর্শই আমি পেয়েছি, পাচ্ছি। প্রার্থনা একটাই, আনন্দ স্যরের সেই সব পরামর্শকে কাজে লাগিয়ে যেনএগিয়ে যেতে পারি।
প্র: সামনের রাস্তায় কেমন ধরনের চ্যালেঞ্জ আশা করছ? সাম্প্রতিক দারুণ ফলাফলের জন্য প্রতিপক্ষরা কি এ বার আরও হোমওয়ার্ক করে আসবে না প্রজ্ঞানন্দকে খেলার সময়?
প্রজ্ঞানন্দ: আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবব না। নিজের খেলার উপরে মনোনিবেশ করব। ফোকাসটা থাকবে নিজের শক্তি, দুর্বলতার উপরে। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, প্রতিপক্ষরা আমার সম্পর্কে সচেতন হয়ে খেলতে নামবে। কিন্তু তাদের সেই হোমওয়ার্ক বা স্ট্র্যাটেজির প্রভাব নিজের উপরেপড়তে দেওয়া যাবে না। আমি তাই নিজের ফর্মুলা মেনেই চলব। নিজের সেরাটা দাও, তারপরে দেখো কী হয়।
প্র: মধ্যরাত পেরিয়ে আড়াইটের সময় দাবা প্রতিযোগিতা শেষ করে সকাল সাতটায় উঠে স্কুলে গিয়ে পরীক্ষায় বসা। দেশের খেলাধুলোয় নতুন বিস্ময় বালকের কি তা হলে এই রুটিনই চলবে এখন?
প্রজ্ঞানন্দ: চললে আমার আপত্তি নেই। অভিযোগ করছি না। বরং আমি খুশি যে, দু’টো দিকই সামলাতে পেরেছি। মাঝরাত পর্যন্ত জেগে দাবায় ভাল ফলও হয়েছে, তাই অতিরিক্ত ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়িনি, বরংউপভোগই করেছি।সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।