চার উইকেট নিয়ে নায়ক মরিসও।
১ জুন, ২০১৪।
১৬ মে, ২০১৫।
বছরখানেকের পিঠোপিঠি দু’টো তারিখ। একটা আইপিএল ফাইনাল। একটা প্লে অফে ওঠার ফাইনাল। প্রায় একই হাড়হিম করা দু’টো প্রেক্ষাপট, কেকেআরের সামনে সেই একই টার্গেট, প্রতিপক্ষের এক মহাযোদ্ধার আবারও সেঞ্চুরি করে যাওয়া, এবং আবারও একটা স্বপ্নের হাতছানি।
সময় কত কিছু পাল্টে দেয়। গত এক বছরে ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদী নামক এক রাজনৈতিক মহীরূহের আবির্ভাব ঘটল। বিশ্ব ফুটবলে পতন ঘটল ব্রাজিল-সাম্রাজ্যের। বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ওলটপালট হয়ে গেল নেপাল। এবং কেকেআরের ভাগ্যও বদলে গেল।
চিন্নাস্বামী ফাইনালে অবিশ্বাস্য স্কোর তাড়া করে এক বছর আগে রূপকথা ছুঁয়েছিল কেকেআর। ঋদ্ধিমান সাহার সেঞ্চুরির জবাবে কোনও এক মণীশ পাণ্ডের ব্যাট থেকে বেরিয়েছিল ৯৪। এক বছর পর ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে শেন ওয়াটসন ৫৯ বলে ১০৪ করে গেলেন। কিন্তু কেকেআরের এগারো থেকে আজ একটাও ‘মণীশ পাণ্ডে’ বেরোল না। আন্দ্রে রাসেল আর ইউসুফ পাঠান যতক্ষণ ছিলেন, কেকেআরের আশাও ততক্ষণ ছিল। কিন্তু দুশো তাড়া করে জিততে গেলে একটা ৩১ বলে ৫৫-র জুটির পক্ষে আর কতটা টানা সম্ভব?
আন্দ্রে রাসেল বোধহয় নিজের হাত দু’টোকে জীবনে ক্ষমা করতে পারবেন না। তাঁর ‘মিসহিট’ ধবল কুলকার্নির হাতে চলে যেতে দেখা গেল, ব্যাটটাকে প্রায় আছড়ে ফেললেন রাসেল। বোধহয় নিজেও বুঝে গিয়েছিলেন যে, রূপকথার ওখানেই শেষ। আসলে এ-ওয়াই জুটিতে যতটা ভয়ঙ্কর, একাকী বোধহয় ততটা নয়। ‘মাস্ল’ রাসেল আর পাঠান যখন ক্রিজে জুটি বাঁধলেন, কেকেআর ৭৭-৩। জিততে চাই ১২৩, হাতে বল ৭১। টসের সময় যে পিচ নিয়ে নভজ্যোত সিধু রসিকতা করে বলেছিলেন “গরু ভেড়া ছেড়ে দিলেও ব্রেবোর্নের ঘাস শেষ হবে না,” ততক্ষণে সেই উইকেট হয়ে উঠেছে ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ আর বোলারদের কবরস্থান। রাসেল শুরুটা যে ভাবে করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল মাঠে অনুপস্থিতির মেগা সিরিয়াল শেষ করা শাহরুখ খানের ব্রেবোর্নে আসা আজ সার্থক হচ্ছে। রানটা কিছুক্ষণের মধ্যেই চড়চড়িয়ে আরও বেড়েটেড়ে দশ ওভারে ৯৭-৩ হয়ে গেল! অবিকল তো আইপিএল সেভেন ফাইনাল। সেই তো ওভার পিছু দশ করে দেখছে কেকেআর!
কিন্তু এ বার মরিয়া চেষ্টাটাই বেরোল শেষ পর্যন্ত। রূপকথার প্রত্যাবর্তন নয়।
মুশকিল হল, টুর্নামেন্ট থেকে মোটামুটি ছিটকে যাওয়ার পরেও টিমটার উপর চাবুকের শাসন ব্যবহার করা যাবে না। কারণ কেকেআর আজ হেরে গেলেও, আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে হেরেছে। প্লে অফে ওঠার রাস্তায় ও রকম ‘আলেকজান্ডার’ সম স্কোর দেখেও ঘাবড়ে না গিয়ে ‘পুরু’ হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। আর গোটা টুর্নামেন্টে একমাত্র চেন্নাইয়ে সিএসকের কাছে হার বাদে কেকেআরের কোনও হারই অগৌরবের নয়। স্কোরবোর্ড যা-ই বলুক, কেকেআর প্লে অফ যাক না যাক, অতি বড় কেকেআর-বিরোধীরা বলতে পারবেন না টিমটা গত বার ফ্লুকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
আজ কেকেআর পারল না তিনটে কারণে। যে ভুলগুলো প্লে অফ নির্ণায়ক যুদ্ধে হওয়াটা উচিত নয়।
এক) সুনীল নারিন নন, আজহার মেহমুদ: কোন যুক্তিতে নাইট ম্যানেজমেন্ট এটা করে বসল, একমাত্র উত্তরটা তারাই দিতে পারবে। হাস্যকর সিদ্ধান্ত। উইকেট যতই সবুজ হোক, নারিন নাম-মাহাত্ম্যের প্রভাব এখনও বিপক্ষের মননে কাজ করে। কেকেআর ব্যাটিং কোচ জাক কালিস পরে বলে গেলেন, নারিনের ফর্ম এ বার আগের মতো নেই। তার উপর উইকেটটাও অন্য রকম ছিল। ভাল। কিন্তু একটা ব্র্যাড হগ তো ছিলেন। যিনি আগুনে ফর্মে। তা হলে কোন যুক্তিতে ‘বুড়ো’ আজহার মেহমুদ? তা-ও আবার এক মাস বসে থাকার পর এ ম্যাচেই প্রথম! আর তাতে যা হওয়ার, তা-ই হল। ব্যাট হাতে ৭ বলে ৬। আর বল-টল করে তিন ওভারে দিলেন মাত্র ৪১!
দুই) কেকেআর টপ অর্ডারের টানা ব্যর্থতা: তিনটে নাম। রবিন উথাপ্পা। মণীশ পাণ্ডে। এবং কিছুটা অধিনায়ক গম্ভীর স্বয়ং। রবিন উথাপ্পাকে গোটা মরসুম ধরে এক-আধটা ম্যাচ বাদ দিলে তাঁকে মোটেও ‘রবিনহুড’ মনে হয়নি। গম্ভীর শুরুতে ফর্মে ছিলেন। শেষের দিকে থাকলেন না। মণীশ পাণ্ডে—তাঁকে দেখলে সবচেয়ে দুঃখ লাগবে। ২১ বলে ২১-এর যে ইনিংসটা একশো তিরিশ-চল্লিশের ম্যাচে ফুটনোট হতে পারত। দুশো তাড়া করার ম্যাচে সেটাকে টেস্ট স্কোরের মতো দেখাল।
এবং এঁদের সঙ্গে কারণ নম্বর চার—এক দক্ষিণ আফ্রিকান মিডিয়াম পেসার। নাম, ক্রিস মরিস। যিনি এ বার আইপিএলে ধারাবাহিক ভাল করে যাচ্ছেন। চোদ্দো নম্বর ওভারটায় তিনি মাত্র ২ দিয়ে তুলে নিলেন রাসেল আর সূর্যকুমার যাদবকে। তার পরেও যে রান আসেনি তা নয়। বল কিছুটা পিচ্ছল হয়ে পড়াতেই হয়তো ওয়াটসনরা ক্রমাগত ওয়াইড বল করে গেলেন আর কেকেআরের উপর চাপ নিজেরাই কমাতে থাকলেন। কিন্তু হ্যাঁ, রাসেল আর তাঁর কিছু পরে পাঠানের ফিরে যাওয়ায় অ্যাক্সেলরেটর থেকেও যেন পা সরে গেল কেকেআরের। পরের দিকে সাকিব আল হাসান বা অপ্রত্যাশিত ভাবে উমেশ যাদব মরিয়া চেষ্টা করলেও দুশোর গণ্ডি টপকানো তাঁদের ডিএনএ-তে নেই।
সব মিলিয়ে চরম হানাহানির যুদ্ধে পাওয়া গেল এমন একটা টিমকে যে ক্লান্ত। বিপর্যস্ত। জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও যারা শেষ পর্যন্ত থমকে যায়। যে টিমটা দু’শো তাড়ায় নেমে প্রথম দশ ওভারে প্রায় একশো তুলেও শেষ পর্যন্ত শেষ করে গম্ভীরের গম্ভীর মুখ দিয়ে। আক্রমের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার দৃশ্যপট দিয়ে। লিগ টেবলে এখনও চারে থেকে ব্যাগপত্তর গোছায় ঘরের ফ্লাইট ধরার।
ঠিকই আছে। স্বপ্ন মানুষ দেখে যেমন, স্বপ্ন দেখার বোধহয় শেষও থাকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
১৯৯-৬ (ওয়াটসন ১০৪ ন.আ, রাসেল ৩-৩২)
কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৯০-৯ (ইউসুফ ৪৪, মরিস ৪-২৩)