বিবর্ণ বোধনে কাপের ঢাকে কাঠি

টেনশন দিবসের আগে জরিমানা আর সাত ফুটে বন্দি পাক-ভারত

অ্যাডিলেড সেন্ট্রাল মার্কেটে ঢালাও বিক্রি হচ্ছে এখন একটা জিনিস। যার নাম ভ্যালেন্টাইনস্ ডে কার্ড। কিন্তু না মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দল। না মিসবা-উল-হকের সৈন্যসামন্ত। কারও সময় নেই প্রেমদিবস নিয়ে মত্ত হওয়ার। বরঞ্চ তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তো আরও একটা দিবস একান্ত ভাবে তাঁদের জন্য হাজির হচ্ছেটেনশন দিবস! আর রোববার সেই উপমহাদেশীয় টেনশন দিবসের প্রাক্কালে পাকিস্তান নতুন বিতর্ক তুলে দিয়েছে তাদের আট প্লেয়ারকে রাতে হোটেলে দেরি করে ফেরার জন্য শাস্তি দিয়ে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:৫৩
Share:

সাত ফুটের মহম্মদ ইরফানের প্রতিষেধক খুঁজতে ধোনিদের নেটে অভিনব অনুশীলন। ছবি: দেবাশিস সেন।

অ্যাডিলেড সেন্ট্রাল মার্কেটে ঢালাও বিক্রি হচ্ছে এখন একটা জিনিস। যার নাম ভ্যালেন্টাইনস্ ডে কার্ড।

Advertisement

কিন্তু না মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দল। না মিসবা-উল-হকের সৈন্যসামন্ত। কারও সময় নেই প্রেমদিবস নিয়ে মত্ত হওয়ার। বরঞ্চ তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তো আরও একটা দিবস একান্ত ভাবে তাঁদের জন্য হাজির হচ্ছেটেনশন দিবস!

আর রোববার সেই উপমহাদেশীয় টেনশন দিবসের প্রাক্কালে পাকিস্তান নতুন বিতর্ক তুলে দিয়েছে তাদের আট প্লেয়ারকে রাতে হোটেলে দেরি করে ফেরার জন্য শাস্তি দিয়ে। এঁদের মধ্যে শাহিদ আফ্রিদি, উমর আকমল, আহমেদ শেহজাদ-সহ অন্তত পাঁচ জন নিয়মিত দলের সদস্য। সিডনিতে গত সোমবার ডিনার থেকে এঁরা দেড় ঘণ্টা দেরিতে ফেরেন। পরের দিন ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ। টিম ম্যানেজার নাভিদ চিমা রাতের কার্ফু লঙ্ঘন করার জন্য এঁদের প্রত্যেককে তখনই চল্লিশ হাজার টাকা স্পট ফাইন করেন। আর হুঁশিয়ারি দেন, দ্বিতীয় বার হলে সোজা প্রথম ফ্লাইটে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পাকিস্তানি ক্রিকেটার রাত সাড়ে এগারোটায় ফেরার জন্য ফাইন দিয়েছে শুনলে ইমরান-মিয়াঁদাদেরা মূর্চ্ছা যেতে পারেন। আক্রমরাও। জনান্তিকে এঁরা কেউ কেউ বলে থাকেন, এরা তো তবু দেরি হলেও ফেরে। আমরা ফিরিনি!

Advertisement

দিন বদলেছে। সময় বদলেছে। আইসিসি বদলেছে। আসলে এমন দ্রুততম শাস্তি দেওয়ার মুখ্য কারণ হল রোববার অ্যাডিলেডে টেনশন দিবস নিয়ে তীব্র উৎকণ্ঠায় রয়েছে পাকিস্তান। নিজেদের মুলুকে তাদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তোমরা কিন্তু ০-৫ পিছিয়ে। আর চুনকালি মাখিও না। করাচির কিছু জুয়াড়ি নাকি একমাত্র টিমকে উৎসাহব্যঞ্জক বার্তা পাঠিয়েছে যে, তোমরা এ বার জিতলে আমরা অনেক টাকা মুনাফা করব। কারণ ফাটকা বাজারে ভারত এমন ফেভারিট যে বাজির দর পুরোটাই ওদের ওপর। পাকিস্তানের ওপর কম টাকা লাগিয়ে বেশি জেতার সুযোগ রয়েছে।

জরিমানাটা অভ্যন্তরীণ রেখে তাই পাকিস্তান অ্যাডিলেডে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিক করেছিল। কিন্তু আফ্রিদিদের শাস্তি দেওয়াটা শুক্রবারের কাগজে বার হলে তারা বেশ অস্বস্তিতেই পড়বে। আফ্রিদি এ দিন অ্যাডিলেড বিমানবন্দরে পা দেওয়া মাত্র ফক্স নিউজের ক্যামেরা তাঁকে ধরতে গিয়েছিল। ফক্স এখানে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল ব্রডকাস্টার। প্লেয়ার তার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য। আর আফ্রিদি যথেষ্ট মিডিয়া-স্যাভি। তিনি ধোনি নন যে দিনের পর দিন মিডিয়া ম্যানেজারকে নির্দেশ দেবেন, ম্যাচের আগের দিন ছাড়া টিমের কেউ মিডিয়ার সামনে যাবে না। কিন্তু আজ দেখলাম রিপোর্টার দেখামাত্র এক-আধটা কথা বলেই আফ্রিদি সভয়ে সরে গেলেন।

পাকিস্তান আসলে এ বার দু’টো বিশ্বকাপ খেলছে! রোববার ভারতের সঙ্গে খেলাটা হল প্রথম বিশ্বকাপ! এক ম্যাচের! তার পর তাদের অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ শুরু। শুনলাম এই টিমের অনেকে গজগজ করতে শুরু করেছেন, আমাদের অবস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো। পূর্বসুরিদের জন্য ওদের চোকারের ট্যাগ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। আর আমরাও পূর্বসুরিদের ইন্ডিয়া ম্যাচ হারার দায় বয়ে বেড়াচ্ছি।

অ্যাডিলেডে পাকিস্তান হারলে কম-বেশি গোটা টিমই বিপন্ন হবে। কিন্তু বড় রকম বিপর্যয় পড়তে পারে আহমেদ শেহজাদের কেরিয়ারে। কয়েক মাস আগেই তিনি বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিলকরত্নে দিলশানকে বলে যে, মুসলিম হয়ে যাও। তা হলে সোজা বেহস্তে যাওয়ার রাস্তা পাকা হয়ে যাবে। সোমবার সিডনিতে আফ্রিদি-সহ শেহজাদরা আসলে গিয়েছিলেন নাইট ক্লাবে। সেখানে মুশকো চেহারার এক তরুণের সঙ্গে শেহজাদ তর্ক জুড়ে দেন। তরুণটি তাঁকে বলেছিল, মুসলিম ধর্মে এই সব মদ খাওয়া, নাইট ক্লাবে যাওয়া নেই। তর্কাতর্কি হতে হতে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বাকিরা তাঁকে ছাড়িয়ে আনে। শোনা যাচ্ছে, শেহজাদের জরিমানা হয়েছে অন্যদের চেয়ে বেশি। সত্তর হাজার টাকা। টিমে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, দু’টো ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ জিতে আমরা যতই ভাল ছন্দে থাকি, রোববারেরটা হারলে সব গেল। শেহজাদ আর বাকি টুর্নামেন্ট খেলবে কি না সন্দেহ।

ভারতও যথেষ্ট নার্ভাস। গত তিন মাসে প্রথম ম্যাচ জিতেছে সে দিন আফগানিস্তানকে অ্যাডিলেড ওভালে হারিয়ে। আত্মবিশ্বাস বলতে অধিনায়ক-সহ টিমের বাকিদের কিছু নেই। একইসঙ্গে তারা জানে, রোববার অ্যাডিলেডে জিতলে একটা পাথর ওপর থেকে সরে যাবে। সকালে স্থানীয় কলেজে টিমের প্র্যাকটিস ছিল। কলেজটার নাম সেন্ট পিটার্স। কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের চেয়ে একটু বড় সাইজের মাঠ। ভারতীয়রা সেখানে সাড়ে তিন ঘণ্টা প্র্যাকটিসের পর আবার ব্যাটসম্যানরা ওভালে এলেন আর একপ্রস্থ নকিংয়ের জন্য। সচরাচর দেখাই যায় না টিম ফুল নেট করার পর আবার সিকিউরিটি অফিসার নিয়ে তারকা ব্যাটসম্যানরা নিজের উদ্যোগে অন্য মাঠে চলে আসছেন।

ওহ্ বলা হয়নি, ভারতীয় নেটে এ দিন নতুনত্ব লক্ষ্য করা গেল। তেন্ডুলকরের ঢঙে কোহলির থ্রো ডাউন নেওয়া নয়। সে তো কিছু দিন ধরেই চলছে। নতুনত্ব হল, একটা স্টুলের ওপর দাঁড়িয়ে সেই হাইট থেকে ব্যাটসম্যানকে বল করা। প্রথমে মনে হচ্ছিল, প্র্যাকটিসে কোনও বোলিং মেশিন নেই বলে কি স্টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বল ছোঁড়া হচ্ছে? তার পর দেখা গেল, না। হাইটটা তো বোলিং মেশিনের চেয়েও উঁচু করা হয়েছে। দ্রুত বোঝা গেল এটা সাত ফুট এক ইঞ্চি পাকিস্তানি পেসার মহম্মদ ইরফানের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়ার জন্য।

অপেক্ষমান মিডিয়ার প্রথমেই প্রশ্ন জাগে আইডিয়াটা কার? সরকারি ভাবে জানার উপায় নেই। ভারতীয় মিডিয়া ম্যানেজার তো বোর্ডের নির্দেশে প্লেয়ারদের সঙ্গে হাই-হ্যালোও করতে দিচ্ছেন না। ধরে নেওয়া যায় আইডিয়াটা কোচ ডানকান ফ্লেচারের। ফ্লেচারকেও এ দিন বাড়তি উদ্যোগ নিতে দেখা গেল। সেটা থেকেই বোধহয় এমন ধারণা। কেউ বললেন, নির্ঘাৎ শাস্ত্রীর বুদ্ধি! আর রাতে খবর পেলাম, কেউ নন। আইডিয়াটা ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারের।

ভারত-পাক মুখোমুখির আগেই অবশ্য বিশ্বকাপের প্রথম বল মাটিতে পড়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে। তার পর মেলবোর্নে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। দু’টোই কঠিন ম্যাচ। হাড্ডাহাড্ডিটা কোথায় বেশি হবে বলা কঠিন। তবে উদ্বোধনে ক্রাইস্টচার্চ এ দিন টেক্কা দিয়ে গেল মেলবোর্নকে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে আনা ছাড়াও হ্যাডলি-ফ্লেমিং-ম্যাকালাম সহ বেশ কিছু অলিম্পিক সোনাজয়ীকে তারা জড়ো করেছিল। যাঁরা জৌলুসে কম হয়েও আন্তরিকতায় হৃদয় স্পর্শ করে গেলেন। পাশাপাশি অস্ট্রেলীয় উদ্বোধনে না থাকলেন সে দেশের হেভিওয়েট কোনও রাজনীতিবিদ, না প্রাক্তন তারকারা। দশ দেশের অধিনায়ক বাদে বাকিটা যা হল, তাকে বলা যেতে পারে জলসা। দশ হাজার লোকের জায়গা। ফ্রি এন্ট্রি। তাতেও চার হাজারের বেশি ভিড় হল না। যার বেশির ভাগই প্রবাসী ভারতীয়। কোথায় রিচি বেনো! কোথায় ইয়ান চ্যাপেল! কোথায় স্টিভ ওয়! কোথায় ডেনিস লিলি! সবচেয়ে বড় অনুপস্থিতি স্বয়ং আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন।

বিশ্বকাপ ফুটবল, অলিম্পিক বা চায়নার এশিয়ান গেমসের পাশে রাখলে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এ বারের বোধন পাড়ার অনুষ্ঠান! হতমান উদ্যোক্তাদের এখন মান বাঁচাতে পারে একমাত্র রোববারের সংঘর্ষ! ম্যাচটা যদি মারকাটারি হয়, তা হলে সে দিন উদ্বোধন বিপর্যয় কারও মাথাতেও থাকবে না!

আর ভারতীয় ক্রিকেট বিপণন জগতের সঙ্গে যুক্ত লোকেরা এবং হোস্ট ব্রডকাস্টার অবশ্যই চাইছে, শুধু মারকাটারি নয়, ভারত জিতুক। অন্য বারের মতো বিশ্বকাপের বাজারই ওঠেনি। পাকিস্তান ম্যাচ বাদ দিয়ে ক্রীড়াবিপণন জগতে স্পনসরের আগ্রহ নিতান্তই কম। অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে যতই কমেন্ট্রি করানো হোক, রোববার ভারত হারলে স্পনসর-উৎসাহ আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। সত্যিই যেন দু’টো বিশ্বকাপ হচ্ছে। যার প্রথমটা রোববারে শুরু, রোববারেই শেষ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement