বিপর্যস্ত নাদাল। বুধবারের রোলাঁ গারো। ছবি: এএফপি।
রোলাঁ গারোয় নাদালকে শুধু স্ট্রেট সেটে হারতেই নয়, ৫-৭, ৩-৬, ১-৬ উড়ে যেতে দেখার পর আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, ক্লে কোর্ট সম্রাটের সাম্রাজ্যের পতনই ঘটে গেল বুধবার। তা-ও কিনা তার জন্মদিনের দিনই!
আনন্দবাজারেই আমার আগের লেখায় বলেছিলাম, এ মরসুমে একটাও ক্লে কোর্ট টুর্নামেন্ট না জিতুক, ফরাসি ওপেনে অন্য নাদালকে দেখা যাবে। ভবিষ্যদ্বাণীর কারণ ছিল, রোলাঁ গারো ওর কাছে নিজের বাড়ির ছাদে খেলার মতোই। এতটাই ও স্বচ্ছন্দ ফিলিপ শাঁতিয়ের বা সুজান লেংলেন কোর্টে। ভেবেছিলাম, নিজের পাড়ায় একজন সুপার চ্যাম্পিয়নের ইগো তাকে তার খারাপ ফর্মেও অনেকটা টেনে নিয়ে যাবে। প্রথম চার রাউন্ডে আমার ভাবনাটা অনেকটা মিলেও গিয়েছিল। নাদাল কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল বেশ দাপটের সঙ্গেই।
কিন্তু জকোভিচ ওকে এ দিন আউটপ্লেড করে দিল। সত্যি বলতে জকোভিচ যতই বিশ্বের এক নম্বর হোক না কেন, আমি ফেডেরার-নাদালেই বরাবর মজে থাকা এক প্রাক্তন টেনিস প্লেয়ার। বুধবারই প্রথম টিভিতে জকোভিচের খেলা খুব মন দিয়ে দেখলাম। আর অবাক হয়ে গেলাম, নাদালের যেটা সেরা অস্ত্র, যেটা সামলাতে ফেডেরার পর্যন্ত নাকানিচোবানি খেয়েছে বারবার, সেই ফোরহ্যান্ড হেভি টপ স্পিনকেই কী অবলীলায় কাউন্টার অ্যাটাক করল জকোভিচ। বাঁ-হাতি নাদালের ওই শটটা ডানহাতি প্লেয়ারের ব্যাক হ্যান্ডে ভয়ঙ্কর স্পিন করতে করতে আসে বলে রিটার্নে প্রচণ্ড সমস্যা হয়। বিশেষ করে ফেডেরারের মতো সিঙ্গল হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ডে।
জকোভিচকে সেখানে দেখলাম নাদালের ওই হেভি স্পিনের উপরই পাল্টা ডাবল হ্যান্ডেড ভলি, টপ স্পিন, ডাউন দ্য লাইন মারতে। এ দিন তিনটে সেটেই দেখা গিয়েছে জকোভিচ মোটামুটি একটা জায়গায় দাঁড়িয়েই খেলে চলেছে। আর নাদাল বেসলাইনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। যার উল্টোটাই রোলাঁ গারোয় এত দিন আমরা নাদালের ম্যাচে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। নইলে কী আর ২০০৫ থেকে ৩ জুন ২০১৫ পর্যন্ত ফরাসি ওপেনে নাদাল মাত্র দু’টো ম্যাচ হারে! এগারো বারে ন’বার ক্লে কোর্ট গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হয়!
কিন্তু সম্রাটের পতনটা এমন বিচ্ছিরি ভাবে হল যে, ভেবে খারাপ লাগছে। অর্জুনের গাণ্ডীবই ভেঙে গেলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর যে রকম দশা দাঁড়াবে, রোলাঁ গারোয় নাদালের ফোরহ্যান্ড টপ স্পিনের বিষ খুইয়ে যেন তেমনই অবস্থা হয়েছিল! জকোভিচ টেনিসের সর্বকালের অন্যতম সেরা মুভার। কোর্টে এতটাই তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করে, প্রতিটা বল এত আগেভাগে ‘মিট’ করে যে রিটার্নের জন্য গড়পরতা প্লেয়ার তো বটেই অনেক সেরা প্লেয়ারের চেয়েও সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় বেশি পায়। যেটা এ ধরনের বিশ্বমানের মেগা লড়াইয়ে সেই প্লেয়ারের পক্ষে বিরাট প্লাস। আর সেই ব্যাপারটা এ দিনের ম্যাচে বারবার পার্থক্য গড়ে দিয়েছে নাদালের সঙ্গে জকোভিচের। ওর রিটার্ন এমনিতেই দুর্দান্ত। আর সেটার পিছনে মূল কারণ ওর দুর্ধর্ষ ফিটনেস। মনে রাখবেন নাদাল যদি বুধবারই ২৯-এ পা দিয়ে থাকে, তা হলে জকোভিচেরও কিন্তু আঠাশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে।
আর একটা কথা। নাদালকে এ দিন ফরাসি ওপেনে এমন জঘন্য হারতে দেখে টেনিসমহলে গেল গেল রব উঠছে। সেটাই স্বাভাবিক। যেহেতু ও তর্কাতীত ভাবে সর্বকালের সেরা ক্লে কোর্ট প্লেয়ার। কিন্তু যদি একটু গভীর ভাবে ভাবা যায়, তা হলে দেখা যাবে, ইদানীং কালে নাদাল যদি কারও কাছে ধারাবাহিক ভাবে হেরে থাকে, তা হলে তার নাম জকোভিচ। দু’জনের শেষ সাতটা ম্যাচের ছ’টাই হেরেছে নাদাল। এমনকী বছর তিনেক আগে নাদালের সেরা সময়েও অস্ট্রেলীয় ওপেনে পাঁচ সেটের ম্যারাথন যুদ্ধে ওকে জকোভিচ হারিয়েছিল।
তবে রোলাঁ গারো— নাদালের সাম্রাজ্যে ঢুকে তাঁকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো বীরত্ব দেখানোর তাৎপর্যই আলাদা। যে জন্য জকোভিচের এই জয়টাও আলাদা। এর পরে আর পুরনো নাদালকে আবার দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ক্লে কোর্টেই এমন জঘন্য হার! উইম্বলডনে ঘাসের কোর্টে আরও কোনও আশা দেখছি না নাদালের। এমনও মনে হচ্ছে, ক্লে কোর্টেও সম্রাটের শাসনের মেয়াদ শেষ!
যেমন এর পরে সেমিফাইনালে অ্যান্ডি মারের বিরুদ্ধে তো বটেই, ট্রফি জয়ের ক্ষেত্রেও আমার এখন এক নম্বর ফেভারিট জকোভিচ। যেমন মেয়েদের ট্রফি সেরেনা উইলিয়ামসের হাতে যেন এখনই দেখতে পাচ্ছি। তেত্রিশেও ওর খেলায় যে রকম প্রচণ্ড পাওয়ার, দশ-বারো বছরের ছোট প্রতিপক্ষরাও এঁটে উঠতে পারছে না। সেমিফাইনাল লাইন-আপ এ দিন যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ফাইনালে সেরেনা বনাম ইভানোভিচ হবে বলেই মনে হচ্ছে। আর সেখানেও সেরেনা পরিষ্কার ফেভারিট আমার মতে।