গোলের হেড বেলেনকোসো।
আটলেটিকো দে কলকাতা-২ (বেলেনকেসো, পিয়ারসন)
এফসি গোয়া-১ (মন্দার)
খেলাটা শেষ হওয়ার মাত্র মিনিট কয়েক আগে আটলেটিকো দ্বিতীয় গোলটা না করতে পারলে হতাশই হতাম।
হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ থেকে গোয়া যদি এক পয়েন্টও এ দিন নিয়ে যেত, একদমই খুশি হতাম না। যে টিমটা গোটা টুর্নামেন্টে আগাগোড়া খোঁড়াচ্ছে, বিশ্বখ্যাত জিকো যে টিমের তিন বছরের পুরনো কোচ হয়েও ঠিক পজিশনে ঠিক ফুটবলার খেলানোর সাহস দেখাতে পারছেন না, সেই টিম যদি কলকাতাকে আটকে দিত কী ভাবে আর খুশি হতাম!
রবীন্দ্র সরোবরে এই ম্যাচটায় জিকো এমন একজনকে ডিফেন্সিভ স্ক্রিন বানিয়েছিলেন, যে কখনও ওই জায়গায় খেলেইনি। এ দিন গোয়াতে ফিরতি ম্যাচেও রাইট ব্যাকে রাজু গায়কোয়াড়কে বসিয়ে নামিয়ে দিলেন কোনও এক কিনান আলমিদাকে! শুরু থেকেই নড়বড় করছিল জিকোর দলের ডিফেন্স। একগাদা অযোগ্য বিদেশিতে যে টিমটা ভর্তি, সেই গোয়া এই ম্যাচ থেকে পয়েন্ট নিয়ে গেলে ময়দানের একজন ফুটবল অনুরাগী হিসেবে কষ্ট পেতাম।
শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই কষ্টের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দেব ইয়ান হিউমকে। কলকাতার উইনিং স্কোরার পিয়ারসনকে নয়। ওদের কোচ জোসে মলিনাকে তো নয়ই।
কেন?
কলকাতার দ্যুতিকে যখন নব্বই মিনিটের মাথায় ফাউল করা হল, হিউম বলটা বসিয়েই চট করে বাড়িয়ে দেয় দ্যুতিকেই। আসলে হিউম দেখে নিয়েছিল ওই মুহূর্তে গোয়ার মিডল থার্ডে রোমিও ফার্নান্ডেজ একা। বরং রোমিওর আশেপাশে গোটা তিন এটিকে প্লেয়ার। আর হিউমের ওই তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে শুরু মুভ থেকেই পিয়ারসনের গোলটা। যেখান থেকে সেমিফাইনালের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করল কলকাতা। অন্তত আমার মতে।
এটিকে উঠে এল দুইয়ে
• মুম্বই: ১৩ ম্যাচে ২২ পয়েন্ট
• কলকাতা: ১২ ম্যাচে ১৮ পয়েন্ট
• দিল্লি: ১১ ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট
• পুণে: ১২ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট
• কেরল: ১১ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট
• নর্থ-ইস্ট: ১১ ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট
কলকাতার সেমিফাইনাল অঙ্ক
১. শেষ দুইয়ের মধ্যে একটা জিতলেই শেষ চারে।
২. শেষ দু’টো ড্র হলে পুণে, নর্থইস্ট, কেরলের রেজাল্টের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
৩. দু’টো ম্যাচেই হারলে শেষ চার কঠিন। সে ক্ষেত্রে তলার দিকে থাকা টিমগুলোকে পয়েন্ট নষ্ট করতেই হবে।
কিন্তু কলকাতা চার ম্যাচ পর জয়ে ফেরার দিনেও যে ওদের স্প্যানিশ কোচ মলিনার জয়গান গাইতে পারছি না! একটাই কারণে। মলিনা কিছুতেই ওর গা থেকে ডিফেন্সিভ জ্যাকেটটা খুলে ফেলতে পারছে না। দু’দলের কাছে ম্যাচটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেমিফাইনালের দিকে এগোতে গোয়াকে হারাতেই হত মলিনার কলকাতার। উল্টো দিকে জিকোর কাছে ছিল ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচ। সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে। সে রকম একটা ম্যাচের প্রথমার্ধটা দাপিয়ে খেলার পরেও দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা হঠাৎ এতটা রক্ষণাত্মক কেন? সেই পুরনো রোগ।
একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিই। প্রথমার্ধে কলকাতা ন’টা কর্নার পেয়েছে। গোয়া সেখানে চারটে। দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতা পেল দু’টো। আর গোয়া পাঁচ-পাঁচটা কর্নার! বিপক্ষের এই চাপ থেকে বেরোতে কেন মলিনা শুধু ডিফেন্স আঁকড়েই থাকল? পস্টিগাকে আরও আগে তুলে নিতে পারত। কারণ পস্টিগা বলটাই তাড়া করছিল না। এক গোলে পিছিয়ে গোয়া দ্বিতীয়ার্ধে ৩-৫-২ ছকে পুরোদস্তুর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে দেখেও মলিনা কেন দ্যুতি আর হিউমকে অত দেরিতে (৮০ মিনিট) নামাল? খেলার প্রায় শেষ মিনিটে হিউম ফ্রি-কিক থেকে বুদ্ধি করে বলটা না বাড়ালে তো এ দিনও সেই ড্র থাকত ম্যাচ! গোয়ার মন্দারের ১-১ করার গোলের সময়ও তো দেখলাম ওকে কলকাতার কেউ ব্লক করল না। রোজ রোজ দ্বিতীয়ার্ধে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি কলকাতার। যার দায় এ দিন শেষমেশ জিতলেও এড়াতে পারেন না মলিনা।
এটিকে-র গোল-উৎসব।
এরই মধ্যে কলকাতা দলের একটা ব্যাপার অবশ্য ভাল লেগেছে আমার। লেফট উইংয়ে অবিনাশ কেন নয়, সেই প্রশ্ন দিন কয়েক দিন আগে আনন্দবাজারে নিজের কলমে তুলেছিলাম। এ দিন ওকে প্রথম এগারোয় এটিকে কোচ রাখায় ভাল লাগল। আসলে অবিনাশ আর লেফট ব্যাক রবার্ট দু’জনেই বাঁ পায়ের ফুটবলার। বাঁ দিক দিয়ে কলকাতার এই জোড়া ফলার আক্রমণ রোখার কোনও অ্যান্টিডোট খুঁজে পায়নি গোয়া। অবিনাশের ‘ইঞ্চ পারফেক্ট’ ক্রস থেকেই তো বেলেনকোসোর কলকাতাকে এগিয়ে দেওয়া।
ম্যাচ শেষে টিভিতে জিকোর মতো লোকের করুণ মুখটা দেখে অবশ্য খারাপ লাগছিল। তিন বছরে এক বারও কলকাতাকে হারাতে পারলেন না প্রবাদপ্রতিম ব্রাজিলীয়। ফুটবল-জ্ঞানে জিকো আর আমার মধ্যে এক আলোকবর্ষেরও দূরত্ব। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে একটুআধটু কোচিং করানোর সুবাদে একটা কথা অন্তত বুঝি, যে ম্যাচ আমার কাছে ‘মাস্ট উইন’ সেই ম্যাচে শুরু থেকেই ভরপুর আক্রমণাত্মক হতে হবে আমাকে। জিকো সেখানে এ দিন গোয়ার সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে রেখেছিলেন দুই ব্রাজিলিয়ান রিকার্লিসন আর ত্রিনদাদেকে। যারা না রাখতে পারল মিডফিল্ডের ‘শেপ’। না কাড়তে পারল সেকেন্ড বলটা। ট্যাকলিং, ডিস্ট্রিবিউশন কিচ্ছু দেখলাম না ওদের থেকে। যতই ব্রাজিলিয়ান হোক, আদতে এই সব তৃতীয় সারির ফুটবলার দিয়ে দল ভরালে গোয়া আর জিতবে কী ভাবে? বেলেনকোসো যখন গোলটা করছে, ছ’গজের বক্সে অনায়াসে হেড করে চলে গেল। ওর ধারেকাছে কেউ নেই তখন। কাট্টিমণি ছাড়া গোয়ার কাউকে দেখে মনে হল না জেতার ইচ্ছে নিয়ে নেমেছিল। গোয়ার গোলের নীচে কাট্টিমণি না থাকলে ম্যাচটা কলকাতা ৫-১ জিততেও পারত। জিকো ষাট মিনিটেরও পরে রাজু আর রবিনকে নামিয়ে ৩-৫-২ করলেন। ফুটবলে এই ছকে রপ্ত হওয়া কঠিন। এ রকম চাপের ম্যাচে জিকো এই ছক পকেট থেকে বার করছেন মানে তো তাঁর দল রপ্ত এই কঠিন ছকে! তা হলে সেটা শুরু থেকে করলেন না কেন?
তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? কোচেদের মগজ-টগজ কিচ্ছু নয়। হিউমের ওই তাৎক্ষণিক বুদ্ধিই বৃহস্পতিবারের ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট!
আটলেটিকো দে কলকাতা: দেবজিৎ, প্রীতম, অর্ণব, তিরি, রবার্ট, বোরহা, পিয়ারসন, লারা (হিউম), পস্টিগা (দ্যুতি), অবিনাশ (জুয়েল), বেলেনকোসো।
ছবি: আইএসএল।