গোলের জোয়ারে সবুজ-মেরুন। মধ্যমণি জেজে। মঙ্গলবার।
গোল করেই ড্যারেল ডাফি লম্বা দৌড় লাগালেন সেই দিকে, যেখান থেকে এসেছিল সনি নর্ডির ফ্রি-কিক। তাঁর পিছনে তখন ধাওয়া করছে পুরো বাগান ব্রিগেড। হাইতি স্ট্রাইকার যেন সেই মাহেন্দ্র মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সোনালি চুলের মিডিওকে ঘিরে শুরু হয়ে গেল গোল-উৎসব। অর্ধেক ভরা গ্যালারিতে তখন শব্দব্রহ্ম। গোলের সেই শুরু। তার পর শুধুই বাগান-ঝড়। এবং সেটা যখন থামল তখন মেঘমুক্ত সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। সঞ্জয় সেনের টিমের মতোই।
বেশ কয়েক বছর আগে ব্যা-ভা জুটিকে নিয়েও তো এ রকমই উন্মাদনা দেখা যেত সবুজ-মেরুনে।
ব্যারেটো আর ভাইচুং জুটির স্ফূলিঙ্গে এ দিনের মতো কত ‘মিনার্ভা’ ধ্বংস হয়েছে সে সময়। মঙ্গলবার সরোবর বাগানে যেন আবির্ভাব হল আর এক জুটির। যাঁকে বাগান সমর্থকরা আদর করে বলতেই পারেন ‘ডা-স’! জেজে জোড়া গোল করেছেন ঠিকই, কিন্তু ডাফি আর সনি—এঁরা দু’জনেই তো মঙ্গলবার বাগানের বড় জয়ের প্রধান কারিগর।
ব্যারেটোর সঙ্গে জুটি বেঁধে মোহনবাগানে খেলার সময় ভাইচুংকে বহু বার বলতে শোনা গিয়েছে, ব্যারেটোর মতো ফুটবলার থাকার জন্যই অনেক সুবিধে পাচ্ছেন তিনি। এ দিন ম্যাচের পর যেমন বলে গেলেন ডাফিও। ‘‘সনি অনেক বড় মাপের প্লেয়ার। ওর মতো ফুটবলার পাশে থাকলে সব সময় সেটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ। ও থাকলে খেলাটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। আমি আর সনি ফ্রি-কিক থেকে এ রকম গোল করা প্র্যাকটিস করেছিলাম। সেটা কাজে লেগেছে।’’
সনি এ দিন নিজে গোল পাননি ঠিক, কিন্তু ডাফি-জেজেদের দিয়ে গোল করিয়েছেন। মোহনবাগানের মূল আক্রমণ তো হচ্ছিল লেফট উইং ধরেই। মানে সনির পা থেকে। আবার টিমের প্রয়োজনে আক্রমণে গতি আনতে নিজের জায়গা ছেড়ে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে এসেও অবলীলায় খেলে গিয়েছেন বাগানের ‘নতুন ব্যারেটো’। তবে নিজের পারফরম্যান্সে পুরোপুরি খুশি হতে পারেননি সনি। ম্যাচের পর তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘‘ডাফি ভাল স্ট্রাইকার। কম দিনেই ওর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। তবে আমি মাত্র পাঁচ দিন প্র্যাকটিস করে খেলতে নেমেছিলাম। সেরাটা দেওয়া তাই বাকি রয়েছে।’’ বাগান হার্টথ্রবের কথাতেই ইঙ্গিত, মিনার্ভার মঞ্চে যে ঝড় এ দিন শুরু হল আগামী দিনে তা সুনামি করে তোলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন।
বাগান-কোচ অচেনা পঞ্জাব দলটির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়েই ঝাঁপিয়েছিলেন। চার বিদেশির সঙ্গে নামেন দেশের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড জেজে-ও। এবং সঞ্জয় সেনের সেই স্ট্র্যাটেজি সফলও। সনি-বলবন্তরা সহজ সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে হাফ ডজন গোল হতেই পারত। যেটা দেখার তা হল, আই লিগে শুরুতেই জয়ের হ্যাটট্রিকের পর দু’টো জিনিস পরিষ্কার। এক) টিমে গোল করার লোক বেড়েছে। দুই) গত বারের চেয়ে এ বার রক্ষণ ভাল খেলছে। এখনও গোল খাননি প্রীতম-আনাসরা।
সরোবরে ডাফি-ম্যাজিক।
জেজে ফর্মে ফিরলে গোল পাবেন জানাই ছিল। কিন্তু যেটা জানা ছিল না তা হল, বাগানে গোলের ফুল ফোটাতে শুরু করেছেন ডাফিও। সালগাওকর ফেরত স্ট্রাইকারকে বুড়ো বলে কটাক্ষ করা হচ্ছিল কলকাতা লিগের পর। সেই সমালোচকদের যেন বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলেন ৩২ বছরের স্কটিশ স্ট্রাইকার। আই লিগে তিন ম্যাচে তাঁর চার গোল। শতাংশের হিসাবে একশোরও বেশি সাফল্য। গতবার গোয়ার ক্লাবের হয়ে এগারো গোল করেছিলেন। এ বার কোথায় থামবেন কে জানে? দশ দলের আই লিগে তো এ বার মিনার্ভার মতো দুর্বল দলের ছড়াছড়ি। জেজেকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া হলেও ডাফিতে মুগ্ধ বাগান কোচ বলে দেন, ‘‘এ দিনের নায়ক ডাফি। ও শুরুটা ভাল করেছে। তবে জেজেও প্রথম ম্যাচেই জোড়া গোল পেয়েছে। এটাও আমাকে স্বস্তি দিয়েছে।’’ এর সঙ্গে সঞ্জয় অবশ্য যোগ করেছেন, ‘‘তবে আমি টিমগেমে বিশ্বাস করি। এই টিমে মেসি-রোনাল্ডো নেই।’’
বয়সকে হারিয়ে ডাফি-দৌরাত্ম্যের দিনে চমকে দিলেন জেজে লালপেখলুয়া। সবে চোট সারিয়ে ফিরেছেন। মিজো স্ট্রাইকার গত দু’বছর সবুজ-মেরুন জার্সিতে প্রচুর গোল করেছেন। এ বারও শুরুটা তাঁর ভাল হল। বলবন্ত সিংহকে বসিয়ে এ দিন জেজেকে নামিয়েছিলেন বাগান কোচ। সম্ভবত সে জন্য গোল পেতে পাহাড়ি ছেলের আকুতি ছিল আরও বেশি। সেটা কাজেও লাগিয়েছেন। জেজে অবশ্য কোচের মতো টিমগেমের কথাই বলে গেলেন। ‘‘দু’মাস পর চোট সারিয়ে মাঠে নেমেছি। গোল পেয়ে ভাল লাগছে। তবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ টিমের তিন পয়েন্ট পাওয়াটা।’’ জেজের মতো ডাফিও বললেন, ‘‘সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে পারলে ভাল লাগবে। তার চেয়েও বেশি ভাল লাগবে মোহনবাগানকে আই লিগে চ্যাম্পিয়ন করতে পারলে।’’
সরোবরে জয়ের ফুল ফুটিয়ে বাগান যাচ্ছে জোড়া অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে। ডাফি-জেজে-সনি ত্রিফলায় যে ভাবে প্রতিপক্ষকে বিঁধতে শুরু করেছে মোহনবাগান, তাতে সঞ্জয় ব্রিগেড অশ্বমেধের ঘোড়া হয়ে শহরে ফিরলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মোহনবাগান: দেবজিৎ (শিল্টন), প্রীতম, এডুয়ার্ডো, আনাস, শুভাশিস, কাতসুমি, প্রণয়, শৌভিক চক্রবর্তী (বিক্রমজিৎ), সনি, জেজে, ডাফি (বলবন্ত)।
ছবি: উৎপল সরকার