তৃপ্তি: ম্যাচ সেরার ট্রফি নিয়ে মোহনবাগান সমর্থকদের সঙ্গে নিজস্বী ড্যানিয়েল সাইরাসের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
গলি থেকে রাজপথে উঠে রাজার মতো মাঠ ছাড়ার গল্প লেখা যেতে পারে মোহনবাগানের ড্যানিয়েল সাইরাসকে নিয়ে।
সালভা চামোরোর সঙ্গে কলকাতা লিগ ও ডুরান্ড কাপে ব্যর্থ ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর স্টপার সাইরাসকে ছেঁটে ফেলার জন্য তীব্র চাপ ছিল কিবু ভিকুনার উপর। সবুজ-মেরুনের স্পেনীয় কোচ রাজি হননি। সেই সাইরাসই বৃহস্পতিবার অসাধারণ একটি গোল করে আলোর রোশনাই ছড়িয়ে রং মশাল হলেন। গ্যালারির সামনে গিয়ে ‘ভাইকিং ক্ল্যাপ’-এর নেতৃত্ব দিয়ে মাঠ ছাড়তে দেখা গেল তাঁকে।
অ্যারোজের আকাশ মিশ্রেরা যখন ম্যাচ শেষে মাঠেই কান্নায় লুটিয়ে পড়েছেন, তখন ম্যাচ সেরার ট্রফি নিয়ে উচ্ছ্বাসে লাফাচ্ছেন সাইরাস। ম্যাচের পরে গোল নিয়ে উচ্ছ্বসিত দেখাল কিবুকেও। বলে দিলেন, ‘‘দুর্দান্ত গোল। আমি ওর পারফরম্যান্সে দারুণ খুশি। ড্রেসিংরুমে তো ও-ই সবার নেতা।’’
সাইরাস যদি গোল করে দলকে জেতান তা হলে শেষ মিনিটে মোহনবাগানের পরিত্রাতার ভূমিকায় হাজির হলেন পাপা বাবাকর জিয়োয়াহা। নিজে গোল করতে না পারলেও, সেনেগালের স্ট্রাইকার নিজের গোল লাইনে দাঁড়িয়ে দলের নিশ্চিত পতন আটকালেন। দুই বিদেশির দুই কৃতিত্বে লিগ টেবলের শীর্ষে থেকে গোল মোহনবাগান। ছয় ম্যাচে ১৩ পয়েন্ট নিয়ে।
‘মিশন কাশ্মীর’ দুর্দান্ত ভাবে সফল হওয়ার পরেও কল্যাণী স্টে়ডিয়াম উপচে পড়েনি। যা অবাক করার মতোই ঘটনা। হয়তো ঝিরঝিরে বৃষ্টি বা মিছিলে রাস্তা আটকে যাওয়ার জন্য অনেকেই শিল্প-শহরে আসার ঝুঁকি নেননি। যে হাজার নয়েক দর্শক খেলা দেখতে এসেছিলেন, তাঁরা দুর্দান্ত একটি গোল দেখলেন। সম্ভবত এ বারের আই লিগের সেরা গোলটি এ দিনই করলেন সমালোচনায় বিদ্ধ সাইরাস। ব্রায়ান লারার দেশের হয়ে ৭৬টি ম্যাচ খেলা সাইরাসকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াও উত্তাল হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই ফুটবলারই প্রায় কুড়ি গজ দূর থেকে বাঁ-পায়ের দুর্দান্ত ভলিতে এমন একটা গোল করলেন, যা ইউরোপীয় ফুটবলেই দেখা যায়। ম্যাচের ১৮ মিনিটে নংদাম্বা নওরেমের শট এক অ্যারোজ ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে উঁচু হয়ে পড়েছিল। সেই বল মাটিতে পড়ার আগেই সাইরাসের ভলি। প্রচন্ড জোর ছিল শটে। গোলটা করেই গ্যালারির দিকে দৌড়ে গেলেন কিবুর দলের সব চেয়ে বড় চেহারার ফুটবলার। কার্যত মুক্তির আনন্দের এই দৌড় দেখে গ্যালারির আপ্লুত দর্শকেরাও তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। সাইরাস গোলটি উৎসর্গ করলেন, তাঁর স্বদেশীয় ফুটবলার স্যাডন উইনচেষ্টারকে। যিনি মাস খানেক আগেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ঝলসে গিয়েছিল শরীর।
নেরোকা এবং চার্চিলের বিরুদ্ধে সম্মুগম বেঙ্কটেশের দলের খেলা দেখে সমীহ করেছিলেন অনেকে। কিন্তু এ দিন দ্বিতীয়ার্ধের কিছুক্ষণ ছাড়া বাকি সময়টা বিক্রম প্রতাপ সিংহদের দল বিশেষ ‘বিক্রম’ দেখাতে পারেনি। প্রথমার্ধে তো আট জনে রক্ষণ সামলাতে দেখা গেল অ্যারোজের জার্সিতে দেশের যুব দলকে। সাইরাসের গোল ছাড়া দুই অর্ধ মিলিয়ে মোহনবাগান অন্তত তিনটি নিশ্চিত গোলের সুযোগ পেয়েছিল। সুহেরের একটি শট উড়ে গিয়ে বাঁচান অ্যারোজ-গোলকিপার লালরামবুকা। ফ্রান মোরান্তে এবং সাইরাসের শট ও হেড পোস্টে লেগে ফিরল। প্রচুর সুযোগ পেলেও মোহনবাগান যে দারুণ খেলেছে এমন নয়। বরং বিদেশিহীন একটা দলের বিরুদ্ধে বেইতিয়া, সুহের, গঞ্জালেসদের একেবারেই অগোছাল লেগেছে। ভূস্বর্গ থেকে দুর্দান্ত ফুটবল খেলে ফেরার পরে সমতলে নেমে কিবুর ছেলেরা যেন নিজেদের ছন্দটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। মোহনবাগানের স্পেনীয় কোচ অবশ্য বললেন, ‘‘দলের খেলায় আমি খুশি। কঠিন ম্যাচ ছিল। তবুও গোলের অনেক সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ করে প্রথমার্ধে ছেলেরা দারুণ খেলেছে।’’
সুভাষ ভৌমিকের মতো সফল কোচ কল্যাণীতে এসে উদ্বুদ্ধ করে যাওয়ার পরেও অ্যারোজ শুরুতে গুটিয়ে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে মনবীর সিংহ, গিবসন সিংহেরা ‘হুঙ্কার’ দেওয়া শুরু করতেই কেঁপে গেল মোহন-রক্ষণ। সেটা এতটাই প্রবল ছিল যে অ্যারোজের মিডিয়ো রকি জনের জার্সি টেনে ধরে হলুদ কার্ড দেখেন বেইতিয়া।
মোহনবাগানের এর পরের ম্যাচ লুধিয়ানায়। পঞ্জাব এফ সি-র বিরুদ্ধে। সেখানে এখন প্রায় কাশ্মীরের মতো ঠান্ডা। দেখার, পঞ্জাব-জয় করে ডার্বির আগে বেইতিয়ারা শীর্ষস্থান ধরে রেখে ইস্টবেঙ্গলকে চাপে ফেলতে পারে কি না?
মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, আশুতোষ মেহতা (লালরাম চুলোভা), ফ্রান মোরান্তে, ড্যানিয়েল সাইরাস, ধনচন্দ্র সিংহ, নংদাম্বা নওরেম (শেখ ফৈয়াজ), জোসেবা বেইতিয়া, শেখ সাহিল (ব্রিটো পি), ফ্রান গঞ্জালেস, পাপা বাবাকর জিয়োয়াহা, সুহের ভি পি।
ইন্ডিয়ান অ্যারোজ: লাললুবিয়াক লুয়া জভ্গতে, হরপ্রীত সিংহ (আমন ছেত্রী), আকাশ মিশ্র, হেন্দ্রি আন্তোনি, বিক্রম প্রতাপ সিংহ, গিবসন সিংহ, রিকি জং সাবঙ্গ (টেলেন সুরঞ্জিত সিংহ), বিকাশ উমানম, আর ডি হরপিমাম, মনবীর সিংহ (হরমনপ্রীত সিংহ), আয়ূষ অধিকারী।