ভিড়ে ঠাসা মেলবোর্নে যেন ফাইনালের ড্রেস রিহার্সাল

মেলবোর্ন সিবিডি-র রাস্তাঘাট হঠাৎ যেন মেট্রো সিনেমার পাশের গলি হয়ে গিয়েছে! এমন থিকথিকে ভিড়! সিবিডি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে খুব প্রচলিত শব্দ। সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট। সিটি সেন্টার এবং সংলগ্ন শিল্পবাণিজ্যের জায়গাগুলো। অধুনা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের তেমনই একটা অভিব্যক্তি চালু হয়েছে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৫২
Share:

ভারত অধিনায়কের সঙ্গে কোহলির অটোগ্রাফও নিলেন এক ভারত সমর্থক। শুক্রবার।

মেলবোর্ন সিবিডি-র রাস্তাঘাট হঠাৎ যেন মেট্রো সিনেমার পাশের গলি হয়ে গিয়েছে! এমন থিকথিকে ভিড়!

Advertisement

সিবিডি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে খুব প্রচলিত শব্দ। সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট। সিটি সেন্টার এবং সংলগ্ন শিল্পবাণিজ্যের জায়গাগুলো। অধুনা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের তেমনই একটা অভিব্যক্তি চালু হয়েছে। বিজনেস এন্ড আর ক্রিকেট এন্ড। ক্রিকেট এন্ড হল এখনকার সময়টা। যখন ক্রিকেট চলে, কিন্তু ফলের বাইরে সুদূরপ্রসারী কোনও প্রভাব চলে না। যেমন এই গ্রুপ লিগের খেলাটেলাগুলো। পরে গিয়ে কোনও গুরুত্ব নেই।

বিজনেস এন্ড হল যখন থেকে আসল ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু। মানে যখন থেকে নকআউট শুরু। তা বিজনেস এন্ড প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত হওয়ার আগেই মেলবোর্নের বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট কিন্তু আলোড়িত! এমসিজির ঠিক উল্টো দিকের সেই বিখ্যাত হোটেল হিলটন অন দ্য পার্ক, (নতুন নাম পুলম্যান) যেখানে বিরানব্বইয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের আস্তানা ছিল, তার লবিতে অনর্গল বাংলা শুনে আশ্চর্য লাগল। দ্রুত আবিষ্কার করা গেল ভারতের নানান প্রান্ত থেকে ক্রিকেট-অতিথিরা এখানে আগত। অন্য বার ট্র্যাভেল এজেন্সি এই যে খেলা ও দেশ দেখাতে লোক নিয়ে আসে, তাদের আগমনের সময় থাকে টুর্নামেন্টের শেষ দিকে। কিন্তু এ বার ধোনির ভারতের শীতকালীন ফর্ম দেখে অনেকেই আর টুর্নামেন্টের ব্যবসায়িক অর্ধে খেলা দেখার ঝুঁকি নিচ্ছেন না।

Advertisement

ভিড় শুধু ভারতীয় পর্যটকদের জন্যই নয়। এখানে চিনা নববর্ষ একটা বিশাল ব্যাপার। এমসিজির এক কিলোমিটারের মধ্যে চায়নাটাউন। সেই নতুন বছর হয়ে গিয়েছে দিন কয়েক হল। কিন্তু হ্যাংওভার এখনও চলছে। রাতের দিকে আবার এমসিজির দিক থেকে এক দঙ্গল ভিড়কে বার হতে দেখা গেল। ট্র্যাফিক বন্ধ করে-টরে মোটামুটি তাদের রাস্তা পার করানো হল। কিন্তু এরা এল কোন অনুষ্ঠান থেকে? ভারতের তো নেট প্র্যাকটিস অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে জাংশন ওভালে। দক্ষিণ আফ্রিকারও রাতে প্র্যাকটিসের কোনও ব্যাপার নেই। সকালেই হয়ে গিয়েছে। অনিল কুম্বলের আন্তর্জাতিক হল অব ফেমে উন্নীত হওয়া? সেটাও তো ঘটছে শনিবার দুপুরে। তা হলে? শুনলাম ভিড়টা আসছে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন টেনিসের এলাকা রড লেভার এরিনা থেকে। ওখানে মাঝেমধ্যেই আমাদের নেতাজি ইন্ডোরের মতো কনসার্ট থাকে। শুক্রবার রাতেও ছিল!

শহরের মাল্টিপ্লেক্সে রমরম করে চলছে হলিউডের মহাবিতর্কিত হয়ে পড়া ছবি ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে।’ রাত সওয়া দশটার শোতেও ভাল টিকিট পাওয়ার উপায় নেই। বাইরে উইকএন্ডের গ্যাঞ্জাম। হোটেল-রেস্তোরাঁ গমগমে। শনিবার রাতে নাকি আরও জমকালো হবে কারণ ধোনিদের হোটেল থেকে আধ কিলোমিটারের মধ্যে ফেডারেশন স্কোয়ারে বসবে হোয়াইট নাইট। সারা রাত ব্যাপী গানবাজনা, খাওয়া-দাওয়া, আনন্দের মেগা-ফেস্টিভ্যাল। এ দিন থেকে কাগজে তার জন্য নির্দেশিকা বার হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। রাতের ওই বারো ঘণ্টা কী করবেন, কী করবেন না। হোয়াইট নাইটের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রোববার আবার মেগা ম্যাচ।

যতই খাতায়-কলমে ব্যবসায়িক অর্ধের বাইরের ম্যাচ হোক না কেন, শহরে সার্বিক গণ-উপস্থিতি আর বাতাবরণ-টরন মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে কার্যত ২৯ মার্চ ফাইনালের ড্রেস রিহার্সাল। তা দু’পক্ষই তত দিনে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হোক বা যোগ্যতায় থেকে যাক না কেন!

এমন আবহে আগের ক’দিন জনশূন্য থাকা জাংশন ওভালের ভারতীয় প্র্যাকটিসেও যে ভিড় হবে, তাতে আর বিচিত্র কী! এমনকী ভারতীয় টিম বাস বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও তাদের এমন ডাকাডাকি আর আবেগঘন প্রতিক্রিয়া, যেন ভারতেরই কোনও শহরে ঘটছে। বিরাট কোহলি এ দিন প্র্যাকটিসে তাঁর নতুন রোনাল্ডো ছাঁট সমেত হাজির। ফেসবুকেও তাঁর ভক্তসংখ্যা এ দিন দু’কোটি ছাড়িয়েছে। কিন্তু তাঁকে এ সব নিয়ে প্রশ্ন করবে কে? প্লেয়ারদের কাছে যাওয়ার আগে একটা দড়ি টেনে দেওয়া রয়েছে। তাতে যে দূরত্বটা সেটা ক্যামেরার টেলিলেন্স দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু ইংল্যান্ডের কি আজকের পর পিটারসেনকে ফেরানো উচিত? ফেসবুক ভক্তসংখ্যা নিয়ে কী ভাবছেন? বা হঠাৎ রোনাল্ডো ছাঁট কাটলেন কেন? জিজ্ঞেস করতে চাইলে রীতিমতো চেঁচাতে হবে। ধরেই নিতে হবে ম্যাচের আগের দিন ছাড়া ভারতীয় প্র্যাকটিসে যা যা ঘটবে তা ভিশন ওনলি। অডিওর কোনও ব্যাপার নেই।

ভারতই গোটা বিশ্বকাপে একমাত্র দেশ যারা এমন সাংবাদিক দমন নীতি নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা মজা করে বলছেন, আমাদের চুক্তিতে আছে মিডিয়ার সঙ্গে বাধ্যতামূলক কথা বলতে হবে। আর একই টুর্নামেন্টে ভারতীয়দের চুক্তিতে আছে বাধ্যতামূলক কথা বলবে না। এ দিন নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড ম্যাচের বিরতিতে বিদেশিরা নিজেরাই তো ভারতের মিডিয়া বয়কটের প্রসঙ্গ তুলে টিভিতে তীব্র সমালোচনা করছিলেন। অবশ্য সাংবাদিকেরা যা জিজ্ঞেস করতে পারতেন না, তা কোহলিকে শুনিয়ে দিল ফ্যানরা। অনুষ্কা কোথায়? আসবে না? অনুষ্কাকে বলবেন, ও কিন্তু খুব ভাল মেয়ে। বিরাট একবার কড়া চোখে তাকালেন। কিছু না বলে বাসে উঠে গেলেন।

ভারতীয় প্র্যাকটিস অবশ্য চারিত্রিক ভাবে ভিশন ওনলি হলেও এমন কিছু সংকেতবাহী ছিল যে ‘অদৃশ্য অডিও’ পাওয়া গেল! এ দিন আর নেট নয়, মাঠ খুলে ম্যাচ পরিস্থিতির মতো প্র্যাকটিস হল। দু’জন দু’জন করে একটা সেটে ব্যাটসম্যানরা নামলেন। প্রথমেই দুই টেলএন্ডার। ক্লোজ ম্যাচে তাঁদের সাহায্য অনেক সময়ই লাগে অথচ তাঁদের ব্যাটিং অনুশীলন দেওয়ার কথা কারও মনে থাকে না। মোহিত-উমেশদের তাই আজ সবার আগে ব্যাট দেওয়া হল। ওটা দেখাই তো অডিও!

ছয় ফুট চার ইঞ্চির নাথন প্যাট্রিককে যেমন বুম লাগিয়ে ইন্টারভিউ করার আগেই জানা সম্ভব ছিল যে, তাঁকে কেন আনা হয়েছে? প্যাট্রিক স্থানীয় ক্লাব পর্যায়ের পেসার। উচ্চতার জন্য ভারতীয় নেটে ডাক পেয়েছেন। অ্যাডিলডে যেমন সাত ফুটের মহম্মদ ইরফানের জন্য স্টুলের ওপর কাউকে তুলে বল ছোড়া হয়েছিল, এখানে প্যাট্রিকই তো সেই স্টুল! তাঁর আর মর্নি মর্কেলের সমান হাইট।

বলতে ভুলে গেছি, শহরে আগত এত সব পর্যটকের ভিড়ে আরও এমন একটা নাম শনিবার যোগ হচ্ছে যিনি থাকলে ক্রিস রজার্স এত সহজে রোববার নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফেভারিট বাছতেন না। দু’দলের শেষ বিশ্বকাপ সাক্ষাতে তাঁর যে সেঞ্চুরিও ছিল। প্রিয় বন্ধু কুম্বলে যে সময় হল অব ফেমে ভূষিত হবেন এমসিজিতে, তারই কাছাকাছি সময়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পাওয়া উচিত তাঁকে!

সচিন রমেশ তেন্ডুলকর! আচ্ছা তিনিও কি টুর্নামেন্টের বিজনেস অর্ধে আসার ঝুঁকি নিলেন না?

ছবি: দেবাশিস সেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement