সচিন নেই এ বার, কিন্তু কোহলি তো আছে!

সেক্টর টোয়েন্টি সিক্সে সামান্য খোঁজাখুঁজির পর স্কুলটাকে আবিষ্কার করা গেল! সেক্রেড হার্ট সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

চণ্ডীগড় শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০৩:৪১
Share:

রহস্যময় মোহালি। চটে ঢাকা পিচ কী নিয়ে অপেক্ষা করছে? পিচ কিউরেটর দলজিৎ সিংহের ভরসার হাত কি ধোনির উপর?— শঙ্কর নাগ দাস

সেক্টর টোয়েন্টি সিক্সে সামান্য খোঁজাখুঁজির পর স্কুলটাকে আবিষ্কার করা গেল! সেক্রেড হার্ট সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল!

Advertisement

চণ্ডীগড়ে সেক্টর সেভেন্টিনে ‘ব্লু আইস’ লাউঞ্জ বারটা কোথায়, সেটা বার করার জন্য সামান্য খোঁজাখুঁজিরও দরকার নেই। একেবারে চোখের সামনে।

দ্বিতীয় লোকেশনটার মালিক সিদ্ধার্থ রক্ষিত। এমনই কুখ্যাত তিনি যে বারে গলা ভেজাতে আসা সান্ধ্য কাস্টমার আজও ফিসফিস করে, আছে এখানে? এসেছে? না কি এখনও তিহাড়ে? লাউঞ্জ বার মালিকের ডাকনামেই অবশ্য তাঁকে আপামর ভারতবাসী ঘৃণা করে থাকে। মনু শর্মা— জেসিকা লালের আততায়ী!

Advertisement

প্রথম লোকেশনটা ঠিক উল্টো। ওই স্কুলেই সত্তর দশকে নার্সারি থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করা একটা ফর্সা, লম্বা, ফুটফুটে মেয়েকে তার বাবা-মা ডাকতেন লাডো বলে। কারও প্রাণ নেওয়া দূরে থাক, মেয়েটি পরবর্তী কালে নিজের জীবনের বিনিময়ে বিপন্ন বিমানযাত্রীদের প্রাণ বাঁচিয়ে পরিবার এবং তাঁর জন্ম দেওয়া শহর চণ্ডীগড়কে চিরবগর্বিত করে। নীরজা ভানোট!

নীরজা যে বছর হাইজ্যাককারীদের বুলেটে মারা যান, সে বছরই মোহালি স্টেডিয়ামের নকশা তৈরি। আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরু আরও ছয় বছর বাদে। নীরজা এবং মনু যেমন অনুভূতির স্নায়ুকেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী স্রোত সৃষ্টি করে থাকেন, মোহালি ক্রিকেট মাঠও তাই! ভারতকে একাধিক বার দারুণ জিতিয়েছে। আবার কাঁদিয়েওছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সৌরভকে সহজতম টেস্ট জিততে দেয়নি। আজহারের টিমের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জেতা শুধু বরবাদই করে দেয়নি রক্ত ঝরিয়ে দু’জনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। আবার পাকিস্তানকে হারিয়ে এ হেন মোহালি উইকেটই তো বিশ্বকাপ ফাইনালে পাঠিয়েছে দলকে। দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো টিমের বিরুদ্ধে টেস্ট জয় উপহার দিয়েছে।

কোটি কোটি টাকার প্রশ্ন, রোববার টিম ইন্ডিয়ার জন্য তার বাইশ গজ কোন রূপে ধেয়ে আসবে? নীরজা না মনু?

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সকালে কলকাতা থেকে ফোনে যা বলছিলেন, তার মর্মার্থ; তিনি এই টিম নিয়ন্ত্রণকারী হলে পিচ যেমন আছে, তেমন স্বাভাবিক রেখে দিতেন। ‘‘না, সামান্য টার্নিংও করতে যেতাম না। এমনিতেই কয়েকটা ম্যাচ উইকেটের ওপর হয়েছে। তার ওপর একটা ম্যাচেও যেখানে আমাদের ব্যাটিং ভাল হচ্ছে না, সেখানে ঝুঁকি নেওয়ার কী দরকার?’’ বলছিলেন তিনি।

কিন্তু এই টিম ইন্ডিয়া তো তাঁর নয়। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বা এই সব নীতিগত সিদ্ধান্তের মালিক রবি শাস্ত্রীর।

তাঁরা যদি স্বাভাবিক পিচই অর্ডার করে থাকেন তা হলে চটের কাপড় দিয়ে দিনভর সারফেস ঢাকা রয়েছে কেন? সাধারণ মোহালি পিচে তো সেই সত্যযুগ থেকে সারা দিন রোদ খাওয়ানো হয়েছে। জল দেওয়া হয়েছে। না কি ঘোর কলিযুগে মোহালি টি-টোয়েন্টি পিচও ক্রিকেটের নবতম অভিব্যক্তি মেনে বানানো হচ্ছে— মাইল্ড টার্নার?

শুনলাম ভারতীয় দলে কর্তাব্যক্তিদের ভাবনা হল, আমরা ঘূর্ণি পিচে হালফিল খারাপ ব্যাট করছি ঠিকই কিন্তু এই সারফেসে যদি আমরা খারাপ খেলি শ্বেতাঙ্গ অতিথিরা খারাপতর হবে। কাজেই ওদের খামোখা ভাল উইকেট দিতে যাব কেন?

কারও কারও মনে হচ্ছে, ধোনির এই টিমটাই যদি মাত্র ক’মাস আগে অস্ট্রেলিয়ান সারফেসে স্টিভ স্মিথদের ৩-০ উড়িয়ে দিতে পারে, তা হলে এখানে এত চিন্তার কী আছে?

টিম ইন্ডিয়া সেই অতীতকে নিশ্চয়ই উপেক্ষা করছে না। কিন্তু খুব পুষ্টিকর হিসেবেও কেন দেখছে না, কারণটা পরিষ্কার। সর্ষো কি শাগ, মক্কি কি রোটির দেশে কাল বিপক্ষে যে বিদেশি এগারো নামবে তার অনেকেই সেই সিরিজে ছিলেন না। ওয়ার্নার খেলেন মাত্র একটা ম্যাচ। স্টিভ স্মিথও তাই। হ্যাজলউড, কুল্টার নাইল, অ্যাডাম জাম্পা এঁরা তো খেলেনইনি।

এঁদের মধ্যে লেগ স্পিনার জাম্পাকে নিয়ে ভারতীয় স্ট্র্যাটেজি ম্যাচের হাইলাইটস প্যাকেজ তৈরি করা উচিত! শেন ওয়ার্নের আদলে নিজেকে গড়েছেন জাম্পা। এক রকম অ্যাকশন। কাকতালীয় ভাবে ওয়ার্নের টেস্ট অভিষেকের বছরেই তাঁর জন্ম। বাবা ট্রাক ড্রাইভার। মা সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। সিডনি মাঠ থেকে আড়াই ঘণ্টা দূরে তাঁর মফস্বলের বাড়ি থেকে রোজকার ক্লান্তিহীন সফরে তিনি এই জায়গায় পৌঁছেছেন। আফ্রিদি আর উমর আকমলের মতো স্পিন-ঘাতকদের এই পিচেই তিনি কী ভাবে বোকা বানালেন কাল হাতেনাতে দেখা গেল। কিন্তু রোহিত শর্মা কী রায়না স্পিনের বিরুদ্ধে আরও দানবীয়। সাধারণ গাড়ির চেয়ে তাঁর বাবার ট্রাকের টায়ার যেমন অনেক বেশি মজবুত, তেমন।

বুমরাহ আর হার্দিককে কী ভাবে অজিরা খেলেন, সেটাও খুব ইন্টারেস্টিং হতে বাধ্য। আইপিএল খেলতে খেলতে অস্ট্রেলীয়দের এমন হয়েছে যে তন্দুরি চিকেন খাওয়াটা যেমন সহজাত হয়ে গিয়েছে। আর ওয়ার্নের মতো দেশ থেকে বেক্ড বিনসের অর্ডার দিতে হচ্ছে না। তেমনই নিচু বাউন্সের ভারতীয় পিচে যখন-তখন পুল মারাটা আর কোনও সমস্যা নয়।

বসন্তের এই আরও রঙিন চণ্ডীগড়ে দেখছি প্রচুর টুরিস্টের আনাগোনা। তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কেউ যাচ্ছেন মানালি, কেউ সিমলা। কেউ ইদানীং জনপ্রিয় হওয়া সিমলা থেকে দেড় ঘণ্টা আরও উঁচুতে নারখাণ্ডা। কিন্তু অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে পর্যটনের কোনও অবকাশই নেই। লাইন একটু এ দিক-ও দিক হয়েছে কী, পাশের শিবালিক পাহাড়ে চলে যেতে পারে। বুমরাহর ইয়র্কার ম্যাচে ভারতের খুব গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হবে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মহারোমাঞ্চকর শেষ ডেলিভারির পর হার্দিক পাণ্ড্য ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন পিনআপ বয়। তাঁর বান্ধবী দেশের পূর্বাঞ্চলের কি না, তা নিয়েও গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি এমন নিষ্ঠুর ফর্ম্যাট যে খ্যাতি তৈরি হয় এক ওভারে, ভেঙে চুরচুর হয়ে যেতে লাগে একটা বল।

ধোনি নেহাত উইনিং কম্বিনেশন ভাঙেন না। নইলে নেহরার জায়গায় চটের বোরখায় ঢাকা সারফেসের ওপর পঞ্জাব দা পুত্তর হরভজন সিংহ চিত্রনাট্য হিসেবে দারুণ জমাটি হত!

কালকেরটা অঘোষিত, কিন্তু পরিষ্কার বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। পাঁচ বছর আগেরটা ছিল ঘোষিত বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। একে তো ভারত-পাকিস্তান। দেশের প্রধানমন্ত্রী-সহ একশোর ওপর ভিভিআইপি সমাগম। তার ওপর পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে থাকা সচিন তেন্ডুলকর। এমন গমগমে ছিল সেই ৩০ মার্চ, ২০১১ যে এ বারে মনে হচ্ছে নিত্য জনসমুদ্রে অভিষিক্ত বিখ্যাত দুর্গাপুজোর মণ্ডপে এক মাস বাদে কালীপুজো কভার করতে এসেছি।

ভারতীয় দলের শরীরী ভাষা অবশ্য বলছে গমগমে কি না, তা দিয়ে কী আসে যায়? ওটা খাদ ছিল, পড়ে গেলে বিশ্বকাপ-মৃত্যু। এখানেও তাই। ওখানে সচিন ছিলেন, এখানে কোটি স্বপ্নের সওয়ার হয়ে কোহালি!

কী দাঁড়াল? দাঁড়াল সেই রাম নেই, সেই অযোধ্যা আছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement