সাদা কোটদ্বয়ের ভুল সিদ্ধান্তে কোহলির ভারত নাটকীয় চ্যালেঞ্জে

ক্রিকেটের মহাকাশে ১৪ অগস্টের বিশেষ তাৎপর্য কী? যদি বলেন ইমরান-আক্রমদের দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন—দশে মাইনাস পেলেন। চোদ্দো অগস্ট হল ওভালে ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট ক্রিকেটে শেষ ইনিংসের চির স্মৃতিবিজড়িত দিন। আর উনিশ বছর বয়সি সচিন তেন্ডুলকরের ম্যাঞ্চেস্টারে প্রথম যুগান্তকারী টেস্ট সেঞ্চুরির তারিখ।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

গল শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২২
Share:

গল মাঠের গোটা দিন। চণ্ডীমলের সেঞ্চুরির হুঙ্কার। বিপর্যস্ত বিরাট।

ক্রিকেটের মহাকাশে ১৪ অগস্টের বিশেষ তাৎপর্য কী?

Advertisement

যদি বলেন ইমরান-আক্রমদের দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন—দশে মাইনাস পেলেন।

চোদ্দো অগস্ট হল ওভালে ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট ক্রিকেটে শেষ ইনিংসের চির স্মৃতিবিজড়িত দিন। আর উনিশ বছর বয়সি সচিন তেন্ডুলকরের ম্যাঞ্চেস্টারে প্রথম যুগান্তকারী টেস্ট সেঞ্চুরির তারিখ।

Advertisement

চোদ্দো অগস্ট মানেই পরম নাটকীয় কিছু ঘটবে। আর ঘটে ক্রিকেট-বিজ্ঞান ও যুক্তিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে এই পরম্পরা শুক্রবারের গলও রেখে দিল! হুড়মুড়িয়ে ভারতের দিকে হেলে যাওয়া ম্যাচ হঠাৎ উল্টে এমন অবস্থায় চলে এসেছে যেখানে পাড়ায় পাড়ায় স্বাধীনতা দিবসের প্রভাতফেরি শেষ হওয়ার পরপরই জানা হয়ে যাবে কোহলি ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁর প্রথম টেস্ট জিতছেন কি না?

খাতা-কলমে জেতা উচিত। শ্রীলঙ্কার যা বোলিং আক্রমণ—একা রঙ্গনা হেরাথকে সামলে দিলে বাকি ৯ উইকেটে ১৫৩ রান ওঠাটা মোটেও আশ্চর্যের নয়।

আম-ভারতীয় সমর্থকের আশঙ্কাটা তবু জারি থাকছে পাঁচ ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলায়। তার মধ্যে এক স্পেশ্যালিস্ট কে এল রাহুল আবার আউট। অদ্ভুত রাহুলের টেস্ট ইনিংসগুলো— ৩, ১, ১১০, ১৬, ৭, ৫। আরও এক স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মার শ্রীলঙ্কা অ্যাভারেজ কি না ৪। শনিবারের রুদ্ধশ্বাস মঞ্চ তাঁকে নায়ক হতে অতর্কিত আহ্বান করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সুযোগ রোহিত নিতে পারবেন?

হরেদরে সেই কোহলি আর ধবনের ওপর ১-০ জিতে যাওয়ার ব্যাপারটা ঝুলে থাকল! গলে এমনিতে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করে জেতার সবচেয়ে বড় টার্গেট ৯৯। হ্যাঁ, ছাপার ভুল নয় ৯৯। তবে কোহলি নিশ্চয়ই সদর্থক ভাবতেই পারেন যে, সব যুগে নতুন ইতিহাস, নতুন কীর্তি স্থাপিত হয় স্বভাবসিদ্ধ পুরনোকে চাপা দিয়ে!

চোদ্দো অগস্টে সত্যি বোধহয় ক্রিকেট মাঠের ওপর কিছু ভর করে! সেটা ব্র্যাডম্যানের শেষ ইনিংসে শূন্য থেকে শুরু করে আজকের মতো ক্রিকেটমাঠে বাঁদর ঢুকে পড়া। মাঠের ঠিক পাশে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে রাজনৈতিক দলের র‌্যালি থেকে টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন রাশি রাশি বেলুন পিচের ওপর থেকে উড়তে থাকা সবই ঘটতে পারে।

গল মাঠটা সত্যি অদ্ভুত! চারপাশটা কার্যত খোলা। শুধু উল্টো দিকের দুর্গের ওপর থেকে নয়। পিছনের বাসস্টপে অপেক্ষারত যাত্রীও ফাঁক দিয়ে নিখরচে টেস্ট ম্যাচ দেখতে পারে। সিটি ট্যুর অপারেটররা ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘোরাফেরার সময়ও অনেক সময় এখানকার রেলিংয়ের ধারে নামিয়ে দেয়, পাঁচ মিনিট খেলা দেখে নিন। তার চেয়েও আশ্চর্যের, ক্রিকেট টেস্ট চলাকালীন ঠিক পাশেই খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিংঘেকে র‌্যালি করার অনুমতি দেওয়া। ধর্মতলার ঠিক মোড়ে কেসি দাশের দোকানের সামনে মমতার র‌্যালি চলছে আর গ্র্যান্ড হোটেলের সামনেটা হয়েছে বাইশ গজ। সেখানে টেস্ট ম্যাচ চলছে। এমন কখনও কেউ দেখেছে নাকি ভাবতে পারবে?

সোমবার শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচন তো বোঝা গেল কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসে কি এমন নজির আছে যে, ব্যাটসম্যান পাশে ব্যাট করার সময় দুমদুম মাঠের ওপর বাজি পুড়ছে। ধবন আর নৈশপ্রহরী ইশান্তের পাশ দিয়ে এক একটা বেলুন উড়ে উড়ে যাচ্ছে। এক বলের খেলায় ব্যাটসম্যানের মনঃসংযোগের তো সেখানেই দফারফা হয়ে যাওয়ার কথা!

লাঞ্চের সময়ও আপাত অবাস্তব পরিস্থিতি। শ্রীলঙ্কা ততক্ষণে ভয়ঙ্কর বিপন্ন। ১০৮ রানে ৫ উইকেট। ইনিংস পরাজয় এড়াতে ৮৫ রান। সঙ্গা-ম্যাথেউজ আউট মানে ধরে নেওয়া হচ্ছে সেটাও বাঁচবে না। এরই মাঝে প্যাভিলিয়নের ডিজে গান বাজাতে শুরু করলেন—এক দিন পাখি উড়ে যাবে আকাশে/ ফিরবে না সে তো আর।

শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট মাঠে বাংলা গান! এটা ঋদ্ধিমানের সম্মানে নাকি? লাঞ্চের পর আর জানার চেষ্টাই করা গেল না গানটা দিনের এমনই প্রতীকী হয়ে দাঁড়াল! দীনেশ চণ্ডীমল ছয় নম্বরে নেমে এতক্ষণ বাঁদরনাচ নাচছিলেন ভারতীয় স্পিনারদের বলে। দু’বার তিনি কট। আম্পায়াররা দেননি। একবার ডিআরএস না থাকায় হক আই এবং ট্র্যাকারবিহীন টিভি সম্প্রচার তাঁর সাহায্যে আসে। কিন্তু সেই চণ্ডীমল হঠাৎ তীব্র কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করে দেবেন, কে ভেবেছিল। গানের কথা অনুযায়ী তখন পাখি মোটেও উড়ছে না। উড়ছে ক্রিকেট বল। কখনও স্লগ সুইপ মারছেন। কখনও চামচে করে তুলে দিচ্ছেন। কখনও সুইচ হিট করছেন অশ্বিনকে। হঠাৎই মাঠকে চাগিয়ে দিয়ে তিনি যেন লোক টানা শুরু করলেন। সঙ্গার ইনিংস দেখবে বলে যারা হয়তো অফিসে বস্‌কে আগাম বেরোবে বলে রেখেছিল, তারা এমন প্রতি-আক্রমণ দেখতে দৌড়ে এল। খাতা খুলে দেখছি ১৬৯ বলে তিনি অপরাজিত ১৬২ করে গেলেন। এমনই ওয়ান ডে সুলভ সেই স্ট্রোকের ঔজ্জ্বল্য আর পাশবিকতা যে, অরবিন্দ ডি সিলভাকে মনে করাচ্ছিল!

লাঞ্চ থেকে চায়ের মধ্যে ভারতের টেস্ট জিতে লাকি স্টাম্পগুলো উপড়ে নেওয়ার কথা। অথচ এই সময়ের মধ্যে গড়ে ওভারপিছু সাড়ে পাঁচ করে রান হল। যে টিমটা সকালে প্রথম বলে উইকেট খুইয়ে ৫ রানে ৩ উইকেট ছিল। তার পর ৯৭ রানে ৫ হল। তারা করে ফেলল কিনা ৩৬০-৮। চণ্ডীমল তাঁর একশো বা দেড়শো কোনওটাতেই ভারতীয় টিমের একজনেরও কেন হাততালি পেলেন না, সহজবোধ্য। তারা মনে করে এটা তাঁর তৃতীয় বা চতুর্থ ইনিংস। কিন্তু স্কোর-বইয়ে তো চণ্ডীমলের রানটাই লেখা থাকবে, সাদা কোটদ্বয়ের অবিশ্বাস্য বৈকল্যের কথা থাকবে না।

শেষ সেশনে যখন টিম ফিল্ডিংয়ে নামছে কোহলি মাঠের কোণে ডেকে নিলেন সবাইকে। হাডল চলল অন্তত চার মিনিট। ভারত অধিনায়ক ততক্ষণে দৃশ্যতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। স্পিনারের জন্য একমাত্র স্লিপ অজিঙ্ক রাহানে দুর্দান্ত ফিল্ডিং করছেন। ঝাঁপিয়ে নেওয়া পরের পর ক্যাচে যজুবেন্দ্র সিংহের আটত্রিশ বছর পুরনো বিশ্বরেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ জেতার ক্যাচ যে হাতে এসেও গলে যাচ্ছে। গল মাঠ তখন উদ্দীপ্ত। শ্রীলঙ্কা যদি দু’শো রানের লিড নিতে পারে তা হলে তো ভারতের টেস্ট জেতার পাখি সত্যিই উড়ে গিয়ে আর ফিরবে না।

রাতে খেলা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে চণ্ডীমলের চেয়ে বেশি করে টেস্টের আম্পায়ারিং নিয়ে আলোচনা চলল ক্রিকেটমহলে। একটা টেস্টে এতগুলো ভুল এখনকার দিনে প্রায় হয়ই না। আন্তর্জাতিক প্যানেলের দুই আম্পায়ারেরই এত খারাপ খেলা পরিচালনা অচিন্তনীয়। ভারতের মাঠে এই টেস্ট হলে তবু একটা অজুহাত থাকত। সেখানে অনেক জনতার উচ্চকিত আওয়াজে স্পিনারের বিরুদ্ধে ব্যাট-প্যাডের আওয়াজ আলাদা করা যায় না। গলে তো সেই সমস্যা নেই। তা হলে স্পিনারের বলে এত ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে কী করে? নাকি আন্তর্জাতিক প্যানেলে আম্পায়ারের সংখ্যা কম বলে মুষ্টিমেয়র ওপর বেশি চাপ পড়ছে? ম্যাচের ফল যা-ই হোক এই সত্যিটা থেকেই যাবে যে অন্তত ছ’টা সিদ্ধান্ত ভারতের বিরুদ্ধে গিয়েছে।

ভারতীয় টিম হোটেলে অবশ্য এখন আর কেউ আম্পায়ারিং নিয়ে ভাবতে বসছে না। একমাত্র লক্ষ্য গলের ইতিহাস বদলে দিয়ে অপারেশন ১৫৩। তা হলেই স্বাধীনতা দিবসে জাতিকে স্মরণীয় জয় উপহার দেওয়া যাবে।

বলা যায় না হয়তো কেউ কেউ গুগল খুলে দেখছেও, আচ্ছা ১৫ অগস্টের কী তাৎপর্য ক্রিকেট-পরম্পরায়? আদৌ কিছু আছে? না সেখানে তার আগের দিনের মতো মোটেও ওলটপালট হয় না— ফেভারিটরাই স্বাভাবিক নিয়মে জেতে?

শ্রীলঙ্কা

প্রথম ইনিংস ১৮৩।

ভারত

প্রথম ইনিংস ৩৭৫।

শ্রীলঙ্কা

দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৫-২)

সঙ্গকারা ক রাহানে বো অশ্বিন ৪০

ম্যাথেউজ ক রাহুল বো মিশ্র ৩৯

চণ্ডীমল ন.আ. ১৬২

থিরিমান্নে ক রাহানে বো অশ্বিন ৪৪

মুবারক ক রাহানে বো হরভজন ৪৯

হেরাথ ক রাহানে বো মিশ্র ১

কৌশল ক ঋদ্ধিমান বো ইশান্ত ৭

প্রদীপ বো অশ্বিন ৩

অতিরিক্ত ১৯

মোট ৩৬৭।

পতন: ০, ১, ৫, ৯২, ৯৫, ২২০, ৩০২, ৩১৯, ৩৬০।

বোলিং: অশ্বিন ২৮.২-৬-১১৪-৪, মিশ্র ১৭-২-৬১-৩,

হরভজন ১৭-০-৭৩-১, অ্যারন ৭-০-৩৯-১, ইশান্ত ১৩-০-৭৭-১।

ভারত

দ্বিতীয় ইনিংস

রাহুল এলবিডব্লিউ হেরাথ ৫

ধবন ন.আ. ১৩

ইশান্ত ন.আ. ৫

অতিরিক্ত

মোট ২৩-১।

পতন: ১২।

বোলিং: প্রসাদ ২-১-২-০, হেরাথ ৩-০-১৩-১, কৌশল ৩-১-৮-০।

ছবি: পিটিআই ও দেবাশিস সেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement