কথায় বলে রাজনীতির ময়দানে কোনও কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। ক্রিকেটের ময়দানেও কি তাই? নইলে গোটা পাকিস্তানকে তাক লাগিয়ে রবিবার ইমরান খানের তীব্র সরকার-বিরোধী করাচির জনসভায় কেন উপস্থিত থাকবেন জাভেদ মিয়াঁদাদ?
ইমরান রাজনীতিতে যোগ দেন আজ থেকে আঠারো বছর আগে। এই আঠারো বছরে আঠারো মিনিটও ইমরানের রাজনীতির জন্য কখনও খরচ করেননি মিয়াঁদাদ। বরঞ্চ কটাক্ষ করে বলতেন, ও হল ইংলিশ ওয়েদারের মতো। কখনও এটা বলছে, কখনও ওটা বলছে। সেই লোকের রাজনীতি নিয়ে কথা বলে লাভ কী? এমনকী মিয়াঁদাদ এমনও লিখেছিলেন, আমরা প্লেয়াররা ওকে ট্যাক্সির মিটার বলে বিদ্রুপ করতাম। খালি নিজের ক্যানসার হাসপাতালের জন্য টাকা তুলছে। মিটার বাড়াচ্ছে।
ইমরান আবার বলতেন, এই জীবনের একুশটা বছর মিয়াঁদাদের সঙ্গে যে কাটিয়েছি, এটাই এনাফ! যখন তাঁকে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, নিজের আত্মজীবনীতে মিয়াঁদাদ লিখেছেন, ইমরানের সঙ্গে রাজনৈতিক পার্টনারশিপ হবে না কে বলতে পারে? তখন ইমরান তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, পার্টনারশিপ যা হওয়ার ছিল শেষ হয়ে গিয়েছে।
রবিবার তাই মহসিন খান যে ইমরান খানের জনসভায় হাজির হয়েছিলেন, তাতে কেউ এতটুকু আশ্চর্য হয়নি। এমনকী লন্ডন থেকে এমকিউএম সর্বাধিনায়ক শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন, তাতেও কোনও বিস্ময়ের রোল ওঠেনি। কিন্তু শরিফ হটাও আন্দোলনে ইমরানের পাশে যোগ দিচ্ছেন মিয়াঁদাদ, তাতে আম পাকিস্তান ক্রিকেটমহলে তুমুল কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, পাকিস্তান বোর্ডের ডিরেক্টর জেনারেল পদ থেকে মিয়াঁদাদকে বর্তমান সরকার হটিয়ে দেওয়ায় তিনি আজ তথাকথিত ‘শত্রু’র সঙ্গে হাত মেলালেন। নইলে ঐতিহাসিক ভাবে ইমরানের বিরোধী ক্রিকেট-মুখ হিসেবেই পাক সরকার তাঁকে ব্যবহার করে এসেছে। সে সরকারের প্রধান বেনজির ভুট্টোই হোন, কি পরভেজ মুশারফ।
ইমরান করাচিতে কাল উদাত্ত কণ্ঠে শরিফ হটাও ডাক দিয়ে বলেছেন, “ওহে শরিফ, জনগণের ঢেউ দেখছ? এ বার সৌদি আরবও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমেরিকাও পারবে না।” ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিয়াঁদাদ ঝুঁকে পড়েন তাঁর প্রাক্তন নেতার দিকে। বলেন, “বন্ধু প্রত্যেকটা ভাষণের আগে তিন মিনিট দুয়া করে নেবে, তাতে তোমার বক্তৃতা আরও ঝাঁঝাল হবে।” এটা বলার সময় মিয়াঁদাদের মুখটা মাইক্রোফোনের কাছাকাছি থাকায় এই কথাটাও সবাই শুনতে পেয়েছেন।
চাঞ্চল্য তাতে আরও বেড়েছে। দুই সুপারস্টারের অতীত সম্পর্ক যেমন ছিল, তাতে এ রকম ভজঘট পার্টনারশিপ টিকে থাকবে? ইসলামাবাদে দীর্ঘ নওয়াজ ঘেরাও কর্মসূচির পর এই প্রথম পাকিস্তানে কোনও শহরে সভা করছিলেন ইমরান। গোটা পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম ছিল সেখানে। এই রকম হাইপ্রোফাইল সভায় যাওয়া মানে বকলমে সরকারের ঘোষিত শত্রু হয়ে যাওয়া। মিয়াঁদাদ এত বড় ঝুঁকি কী ভাবে নিলেন, অনেকে বুঝে উঠতে পারছেন না। হঠাৎ করে ইমরানের প্রতি তাঁর কী ভাবে প্রেম গজাল, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।
করাচিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের ফোন করে জানা গেল, জাভেদ যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন একটা সময় ইমরান নাগাড়ে হাসছিলেন। যা দেখে অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছিল, শিক্ষিত সমাজে মিয়াঁদাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইমরান নিজেই অনেক বার কটাক্ষ করেছেন। এমনকী একটা ঘটনার কথাও লিখেছেন যে, ইংল্যান্ডে এক মহিলা এসে মিয়াঁদাদকে জিজ্ঞেস করেন, ইকুয়েটর পাকিস্তান থেকে কত দূরে? তখন মিয়াঁদাদ নাকি বলেন, কোয়েটা? কোয়েটা তো পাকিস্তানের মধ্যেই! তাই ইমরানের হাসি দেখে অনেকেরই মনে হচ্ছিল, এটা কি আনন্দের হাসি? নাকি শ্লেষের?
ইমরান বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সচিবকে পাওয়া গেল। তাঁকে পাওয়া গেল না। করাচিতে মিয়াঁদাদের ফোনও বেজে গেল। ক্রিকেটমহলের অন্য ব্যক্তিত্বদের কাছে অবশ্য পার্টনারশিপটা ঐতিহাসিক ভাবে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। বিরানব্বই সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপের আগে এ রকমই পার্টনারশিপ হয়েছিল দুই সুপারস্টারের। সেই বিশ্বকাপটা কিন্তু জিতেছিল পাকিস্তানই।
২০১৫-এ আবার এই দুই দেশে বিশ্বকাপ। তার আগে ফের একত্র ইমরান-জাভেদ। ময়দানটা শুধু বদলে গিয়েছে, এই যা!