ইউরোপ মাতাচ্ছেন কন্তে।
ফাঁকা গ্যালারি। তারকাহীন দল। ম্যাচ গড়াপেটা। নিম্নমানের টিআরপি।
বর্তমানের ইতালীয় সেরি এ বলতে আমরা যা বুঝি।
এক সময় ফুটবলের পীঠস্থান মানা হত এই লিগকে। একটা সময় এই লিগে খেলা মানেই তাঁর হাতে ব্যালন ডি’অর উঠতই। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতালীয় ক্লাবেরা লড়াই করত। রুদ খুলিট, মার্কো ফান বাস্তেন, দিয়েগো মারাদোনার মতো ফুটবল আইকনদের লড়াই দেখতে মুখিয়ে থাকত সারা বিশ্ব।
সেই সোনার সংসারে এখন যেন বিতর্কের আগুন। ফুটবলারদের সঙ্গে সমর্থকদের ঝামেলা। ম্যাচ গড়াপেটা। অর্ধেক ক্লাব ঋণের দায়ে জর্জরিত। তারকা বলতে হাতেগোণা কয়েক জন। ইপিএলের গ্ল্যামার ও লা লিগার তারকাখচিত ব্যালন ডি’অর জয়ীদের সঙ্গে ম্যাচে দশ গোল খেয়ে বসে রয়েছে সেরি এ।
জাতীয় দল চেষ্টা করছে। কিন্তু স্পেন, জার্মানির সঙ্গে লড়াই করার মশলা কোথায়?
ঘরের মাঠে ইতালীয় ফুটবল হেরে বসে আছে। ঘরোয়া লিগে কোনও বড় নামের ফুটবলার টানতে পারছে না। আইএসএলের গ্যালারিও ইতালির কয়েকটা মাঠের থেকে বেশি ভর্তি থাকছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও ইতালীয় ক্লাবগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে। যতটুকু চেষ্টা করছে সেই জুভেন্তাস।
আর একটা লড়াইয়ে কিন্তু জিতছে ইতালি— কোচের লড়াইয়ে।
লেস্টারকে রূপকথার প্রিমিয়ার লিগ জেতানো হোক বা রিয়াল মাদ্রিদকে লা ডেসিমা। ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে তাদের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ জেতানো থেকে বায়ার্নের ঘরের মাঠে তাদের হারিয়ে চেলসির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা— প্রতিটা অবিস্মরণীয় কীর্তির পিছনেই রয়েছে একটা ইতালীয় মগজ।
কার্লো আন্সেলোত্তি থেকে ক্লদিও র্যানিয়েরি। রবের্তো মানচিনি থেকে আন্তোনিও কন্তে। ইতালি মানেই তো কোচেদের কারখানা। হতে পারে কোনও ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলার বেরোচ্ছে না ইতালি থেকে। শেষ সেই ফাবিও কানাভারো। কিন্তু ইতালির কোচেরাই তো বিশ্বের সেরা সমস্ত ফুটবলার তৈরি করছেন।
কন্তের মতোই ইউরোপ মাতাচ্ছেন র্যানিয়েরি।
ইউরোপীয় লিগ থেকে অনেক মাইল দূরে থাকা আইএসএলেও তো কোনও এক ইতালীয় মগজই দিল্লি ডায়নামোসকে শীর্ষে তুলে বসে আছেন। জিয়ানলুকা জামব্রোতার কোচিংয়ে খেলা সৌভিক চক্রবর্তীও মনে করছেন ইতালীয় কোচেরা যেন অন্য ধাঁচেরই। ‘‘আমার খুব ভাল লাগে জামব্রোতা স্যারের কোচিংয়ে খেলতে পারাটা। খুব শান্ত স্বভাবের। সমস্যা হলে বুঝিয়ে বলেন,’’ বললেন সৌভিক। জামব্রোতার কোচিংয়েও সেই ইতালীয় শৃঙ্খলা আর ডিফেন্স সংগঠনের ব্যাপারটাও খুঁজে পান সৌভিক। ‘‘আমরা আক্রমণে যাব। কিন্তু প্রথমে ডিফেন্স সংগঠন। পুরোটাই ব্যাকলাইন থেকে তৈরি হবে,’’ বলছেন দিল্লির ফুটবলার।
হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। সারা বিশ্ব জানে ইতালীয় কোচ মানেই তো ডিফেন্স আগে সামলাব। এখন তার উপরে আবার আক্রমণেও অনেক বেশি ডিরেক্ট আজুরি কোচেরা। ক্লিনশিটও যেমন রাখছেন, আবার গোল-উৎসবও উপহার দিচ্ছেন গ্যালারিকে। মোহনবাগানের আই লিগ জয়ী কোচ সঞ্জয় সেনও তাই মনে করছেন, ‘‘ইতালীয় কোচেরা বরাবর ডিফেন্সে মন দেয়। ওরা আগে ব্যাকলাইন সামলায়। কিন্তু এখন অনেক বেশি ডিরেক্ট হয়েছে। কাউন্টারে খেলছে।’’
মেসিদের গ্রহে অবশ্য যে ইতালীয় মগজের টিআরপি এখন সবচেয়ে বেশি তার সৌজন্যে চেলসি ফের চ্যাম্পিয়নের মেজাজে। বেঁটেখাটো চেহারার সেই আন্তোনিও কন্তে। মরসুম শুরুতে সবার ধারণা ছিল, চেলসির ডিফেন্সের ওষুধ বের করতে করতেই গোটা মরসুম কেটে যাবে। আর্সেনাল, লিভারপুলের বিরুদ্ধে হারের পর তো সেই আশঙ্কা আরও বেড়ে যায় সবার।
কিন্তু একটা মোক্ষম চাল। সবাই কুপোকাত। ৩-৪-৩ ফর্মেশনে পাল্টে দেওয়া। আর তাতেই চেলসিও অপ্রতিরোধ্য ছন্দে। শেষ পাঁচে পাঁচটাতে জয়। কোনও গোল খায়নি। লিভারপুলের থেকে মাত্র এক পয়েন্ট পিছনে দু’নম্বরে। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের মতো দলকে ৪-০ হারানো। তার থেকেও বেশি তাৎপর্যের পাঁচটা ক্লিনশিট দাভিদ লুইজের মতো ডিফেন্ডারকে নিয়েও। হ্যাঁ ৭-১-এর দাভিদ লুইজ। সঞ্জয়ও বলছেন, ‘‘সাধারণত নতুন ফর্মেশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। কিন্তু কন্তে কী রকম কোচ তা ইউরোতেই বোঝা গিয়েছে। তিন ম্যান ব্যাকলাইনে খেললে ফরোয়ার্ডে থাকা প্লেয়ারদের নামতে হয় না। তাতে সুবিধা হয়। অনেক কিছু শেখার আছে এই সব কোচেদের কাছ থেকে।’’
কন্তে ছেড়েও বাকি ইতালিয়ান কোচেরাও তো এখন রেনেসাঁ ম্যান। ক্লদিও র্যানিয়েরির হাত ধরে প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল লেস্টার সিটি। এ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো টুর্নামেন্টেও গ্রুপ টপকানোর মুখে ‘শেয়াল’রা। কার্লো আন্সেলোত্তি বায়ার্নের হয়ে নিজের চতুর্থ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ তাড়া করছেন। মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি জুভেন্তাসকে ইউরোপিয় শক্তি করার চেষ্টায় রয়েছেন।
তাই তো, ডিফেন্স সংগঠনের সঙ্গে ডিরেক্ট ফুটবল মিশিয়ে ইতালিয়ানরাই এখন ‘স্পেশ্যাল ওয়ান।’