(বাঁ দিকে) শাহরুখ খান। সঞ্জীব গোয়েন্কা (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
‘হার কর জিতনেওয়ালো কো বাজ়িগর ক্যাহতে হ্যায়’।
অভিনয়জীবনের প্রথম দিকে ‘বাজ়িগর’ সিনেমায় শাহরুখ খানের মুখে এই সংলাপ শোনা গিয়েছিল। এই সংলাপের শক্তি কতটা, তা হয়তো তখনই বুঝতে পেরেছিলেন বলিউড বাদশা। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও নিয়েছিলেন। যা তাঁর পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রমাণিত। কলকাতা নাইট রাইডার্সের কর্ণধার হারতে হারতে জিততে শিখেছেন। লখনউ সুপার জায়ান্টসের কর্ণধার জিততে জিততে হারতে শিখছেন! শিল্পী আর শিল্পপতির পার্থক্য। এটাই বোধ হয় আসল।
দিল্লির মধ্যবিত্ত ছাপোষা পরিবারে জন্ম শাহরুখের। সাধারণ জীবন, আরও সাধারণ যাপন। জীবনের প্রতি পরতে প্রতিকূলতা, অবহেলা, বঞ্চনা তাঁকে শিক্ষা দিয়েছে। ব্যর্থতা দেখেছেন। জীবন তাঁকে অনেক আগেই অভ্যস্ত করে দিয়েছে। জীবন তাঁকে শান্ত থাকতে শিখিয়েছে। ব্যর্থতায় ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে। মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে শিখিয়েছে।
জীবন শিখিয়েছে গোয়েন্কাকেও। না শিখলে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি হওয়া যায় না। ব্যবসাকে রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায় না। কলকাতায় বেড়ে ওঠা গোয়েন্কার প্রথম জীবন তুলনায় সহজ। বিত্তশালী পরিবার শুধু নয়, দেশের অন্যতম ধনকুবের পরিবারও বটে। তাঁর বাবা প্রয়াত রমাপ্রসাদ গোয়েন্কা ছিলেন একাধিক সংস্থার মালিক। অভাব, বঞ্চনা, অবহেলা তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি। মধ্যবিত্তের সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়নি।
পড়াশোনা শেষ করে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছেন গোয়েন্কা। নিজে পরিশ্রম করেছেন। তার থেকেও বেশি নির্ভর করেছেন পেশাদারদের উপর। ব্যবসায়িক মানুষ। লাভই তাঁর কাছে শেষ কথা। বিনিয়োগ করেন মুনাফার জন্য। পেশাদারদের নিয়োগ করেন সেরা পারফরম্যান্স করার জন্য।
ব্যবসা শাহরুখও করছেন। না হলে কে আর কষ্টার্জিত অর্থ ক্রিকেটে বিনিয়োগ করে। ক্রিকেট নয়, আইপিএল। বিশ্বের অন্যতম দামি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। তবু আগে তিনি শিল্পী। খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, যশ সব কিছুই তাঁকে দিয়েছে অভিনয়। গোয়েন্কাও সব পেয়েছেন। অনেকটাই জন্মসূত্রে। শাহরুখও নিশ্চিত ভাবে মুনাফার কথা ভাবেন।
শাহরুখ এবং গোয়েন্কা নিজেদের ক্ষেত্রে সফল। উজ্জ্বলতম মুখ। দেশজোড়া পরিচিতি। পার্থক্য, শাহরুখ শিল্পী। তিনি জানেন, সব সিনেমা বাণিজ্যসফল হয় না। সব সিনেমায় তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয় না। তাঁর জীবনে ব্যর্থতা এবং সাফল্য হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। হারতে হারতে জিততে শিখেছেন। সে জন্য তাঁর কাছে জয়ের স্বাদ বেশি মধুর। তাই শ্রেয়স আয়ারেরা ২৬১ রান তুলে হেরে গেলেও শান্ত থাকতে পারেন। হতাশ হলেও হাসিমুখে ক্রিকেটারদের হতাশা মুছে দিতে পারেন। সাজঘরে ছুটে যান। ক্রিকেটারদের সাহস দেন। কলকাতা নাইট রাইডার্স আবার জয়ে ফেরে।
দল খারাপ ভাবে হারলে ছুটে যান গোয়েন্কাও। সাজঘরে নয়, মাঠে। হতাশা লুকিয়ে রাখতে পারেন না। ক্ষোভে ফেটে পড়েন। লোকেশ রাহুলদের পাশে দাঁড়াতে পারেন না। কাঠগড়ায় দাঁড় করান ক্রিকেটারদের। ফলাফলের কৈফিয়ত চান। মাঠে দাঁড়িয়ে ব্যালান্স শিট মেলানোর চেষ্টা করেন নিখাদ শিল্পপতি। তাঁর কাছে খেলোয়াড়দের দক্ষতার গুরুত্ব কম। চান সাফল্য, শুধু সাফল্য। ব্যর্থতা তাঁর অভিধানে নেই।
শাহরুখ জানেন, ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়। ব্যর্থতা আসলে নতুন শুরুর সঙ্কেত। যে শুরু এনে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। গোয়েন্কা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির ব্যবসায়িক দিকের কথা ভাবেন। দলের ব্যর্থতা কোষাগারে কতটা প্রভাব ফেলবে, সম্ভবত তা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে। অতএব সব দিচ্ছি, তাই ফলাফল দিতে হবে। বহুজাতিক মানসিকতা।
পেশাদারিত্ব? আইপিএলের দুই মালিকই পেশাদার। তবু একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। সেটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে আইপিএলে। ব্যাটারের যে চারে ক্রিকেটীয় শিল্প আছে, সেই শটে গোয়েন্কার আগ্রহ কম। ব্যাটারের যে চার জয় এনে দেবে, সেই চারে তাঁর আগ্রহ বেশি। আগ্রহ কম নেই শাহরুখের। জয় তিনিও চান। দলের সাফল্য চান বলেই গৌতম গম্ভীরকে ফিরিয়ে এনেছেন। টাকার অঙ্ক নিয়ে ভাবেননি। সম্মান দিয়ে রেখে দিয়েছেন চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতকেও। আর গোয়েন্কা সাফল্যের খোঁজে লখনউয়ের মেন্টর, কোচ সব বদলে দিয়েছেন। ঠিক যেমন মরসুমের মাঝে জুয়ান ফেরান্দোকে সরিয়ে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কোচ করেছিলেন আন্তোনিয়ো লোপেজ হাবাসকে, তেমনই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে সরিয়ে জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে এনেছিলেন লখনউয়ে। মোহনবাগান আইএসএল শিল্ড জিতেছে। আইপিএলে লখনউ পারছে না। দুই প্রতিযোগিতার পার্থক্য সম্ভবত বোঝেননি। তিনি আসলে জিততে জিততে হারতে শিখছেন।
শাহরুখ শিখে এসেছেন। গোয়েন্কা ঠেকে শিখছেন। সিনেমায় রি-টেক আছে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা সামাল দিতে গোয়েন্কারও ভাড়া করা জেনারেটর আছে। কিন্তু রি-টেকে পরিশ্রম শাহরুখেরই। ঘাম ঝরে তাঁরই। জেনারেটর চালানোরও পরিশ্রম, ঘাম আছে। কিন্তু তা ঝরে গোয়েন্কার শ্রমিকদের।
ব্যালান্স শিট আর ক্রিকেটের স্কোর শিট তো এক নয়।